উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে একত্রে সাধারণত ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হয়ে থাকে। রাজ্যগুলো হলো অরুণাচল, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা। এই উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলার মূল কারণ হলো এই অঞ্চলের সাতটি রাজ্যের ভৌগলিক অবস্থান।
উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাকৃতিক দৃশ্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, উৎসব এবং ঐতিহ্য ইত্যাদি অসংখ্য পর্যটককে আকর্ষণ করে। আজকের প্রবন্ধে, ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য সম্পর্কে আলোকপাত হবে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাস
উত্তর-পূর্ব ভারতের উদ্ভূত হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়। ১৮৩৯ থেকে ১৮৭৩ সালের মধ্যে এটি বঙ্গ প্রদেশের একটি অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, উত্তর-পূর্ব অঞ্চল আসাম, মণিপুর এবং ত্রিপুরা নিয়ে গঠিত হয়।
ঘটনাক্রমে আসামের বৃহত্তর অঞ্চল থেকে অন্যান্য রাজ্যগুলো গঠিত হয়। ব্রিটিশ রাজত্বকালে আসামের রাজধানী ছিল শিলং। পরে ১৯৭২ সালে, মেঘালয় গঠিত হয় এবং শিলং রাজ্যের রাজধানী হয়। অবশেষে আসামের রাজধানী দিসপুরে স্থানান্তরিত করা হয়।
সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের সংক্ষিপ্ত তথ্য
অরুণাচল
- অরুণাচল রাজ্যের রাজধানী ইটানগর।
- এই প্রদেশের সরকার ইটানগরের বাইরে অবস্থিত।
- ইটানগরের সবচেয়ে বেশি কথ্য ভাষা নিশি।
- ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের মধ্যে অরুণাচল বৃহত্তম রাজ্য।
- অরুণাচল রাজ্য পূর্ববর্তী নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি (NEFA) অঞ্চল থেকে খোদিত হয়েছিল।
- অরুণাচল রাজ্য ভারতের ২৬টি প্রধান উপজাতি এবং ১০০টি উপ-উপজাতির বসবাস রয়েছে।
- এই রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% লোকের পেশা কৃষি। মোট চাষকৃত এলাকার ১৭% সেচের আওতায় রয়েছে।
- ভারতের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান ‘নামদাফা’ এই রাজ্যে অবস্থিত। তাছাড়া, এই রাজ্যের মোট বনভূমি প্রায় ৬২%।
- অরুণাচল রাজ্যে প্রধান উৎসব হলো লোসার উৎসব, শীতকালীন পাংসাউ উৎসব ইত্যাদি।
- শাল, মোড়ক এবং স্কার্ট হলো এই রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
- বিখ্যাত খাবার হলো বাঁশের কান্ড, মোমোস, পিকা-পিলা ইত্যাদি।
- প্রধান নৃত্যের মধ্যে রয়েছে ওয়াঞ্চো নৃত্য, দ্য ইদু মিশমি নাচ, দিগারু মিশমি নৃত্য এবং খম্পতি নৃত্য।
- হিন্দি এবং ইংরেজি অরুণাচল রাজ্যের সরকারী ভাষা।
আসাম
- আসামের রাজধানী দিসপুর। দিসপুর হলো গুয়াহাটির একটি উপশহর।
- ১৯৭৩ সালে, দিসপুরকে আসামের রাজধানী করা হয়। তবে, আসাম থেকে মেঘালয় রাজ্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত শিলং ছিল আসামের রাজধানী।
- আসাম সরকারের মূল ক্ষমতার কেন্দ্র হলো দিসপুর।
- আসাম সচিবালয়ের আয়োজকও হলো দিসপুর।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- আসামের সরকারী ভাষা অসমীয়া এবং বোড়ো।
- আসাম তিনটি জেলা নিয়ে বরাকের উপত্যকায় অবস্থিত। বাংলা হলো তাদের সরকারী ভাষা এবং সিলেটি হলো সাধারণ বা প্রচলিত ভাষা।
- আসাম চা এবং সিল্কের জন্য বিখ্যাত।
- আসামে এক শিংবিশিষ্ট ভারতীয় গন্ডারের দেখা পাওয়া যায়।
- আসামদের প্রধান উৎসব হলো বিহু, যা ফসল কাটার উৎসব। তারা জানুয়ারি মাসে মাঘ বিহু, এপ্রিল মাসে রোঙ্গালি বিহু এবং অক্টোবর মাসে কাটি বিহু মোট তিনবার বিহু উৎসব পালন করে থাকে।
- ওজাপালি, দেবদাসী এবং সাতরিয়া আসামের প্রধান নৃত্য।
মণিপুর
- ইম্ফল মণিপুরের রাজধানী।
- ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি মণিপুর প্রদেশ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- ইম্ফল পূর্ব ভারতে অবস্থিত।
- রেড হিলস-এ ইন্ডিয়া পিস মেমোরিয়াল ইম্ফলের কাছাকাছি অবস্থিত। এটির মহান ঐতিহাসিক একটি তাৎপর্য রয়েছে, কারণ এটি সেই জায়গা যেখান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় ন্যাশনাল আর্মির সহায়তায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।
- মণিপুরের অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। এইজন্য মণিপুর রাজ্যকে সোনার দেশ বা সুবর্ণভু বলা হয়।
- পার্বত্য অঞ্চলের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় ৪৪% এবং উপত্যকার কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় ৬০% সম্পূর্ণভাবে কৃষি, পশুপালন, মৎস্য ও বনায়ন কাজের উপর নির্ভরশীল।
- মণিপুরের অধিকাংশ জনসংখ্যা হলো মেইতেই। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩% তারাই।
মেঘালয়
- মেঘালয় সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ হলো ‘মেঘের আবাস।’
- শিলং মেঘালয়ের রাজধানী। প্রাথমিকভাবে এটি ১৮৭৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আসামের রাজধানী ছিল।
- আসাম থেকে মেঘালয়কে আলাদা করে শিলংকে মেঘালয়ের রাজধানী করা হয়।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- শিলং ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ নামে পরিচিত।
- ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের সদর দপ্তর শিলং-এ অবস্থিত।
- শিলংয়ের অধিকাংশ জনসংখ্যা স্থানীয় ভাষায় খাসি নামে কথা বলে।
- মেঘালয়ের প্রায় ৮০% লোক প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল।
- মেঘালয় রাজ্যের প্রধান উপজাতি হলো খাসিয়া। তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘কা পেম্বলাং নংরেম নৃত্য’ যা নংরেম নৃত্য নামেও পরিচিত।
মিজোরাম
- আইজল মিজোরামের রাজধানী।
- মিজোরাম নামটি ‘মিজো’ নামক শব্দ থেকে এসেছে। মিজোরা হল মিজোরামের আদি বাসিন্দা। মিজো ভাষায় ‘রাম’ শব্দের অর্থ জমি।
- মিজোরাম হলো একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। এটি ভারতের অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মধ্যে মণিপুর, আসাম এবং ত্রিপুরার সাথে সীমানার ভাগ রয়েছে।
- ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- এদের প্রধান ভাষা হলো মিজো, কুকি এবং ইংরেজি।
- মিজোরামের অধিকাংশ জনগণই খ্রিস্টধর্ম অনুসরণ করে।
- খ্রিস্টানদের মধ্যে, আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রেসবিটারিয়ান।
- মিজোরাম রাজ্যের প্রায় ৮০% লোক প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই, তাদের প্রধান খাদ্যশস্য হলো ধান, গম, ভুট্টা, আনারস, কলা ইত্যাদি।
- আইজলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল।
- এই রাজ্যের প্রধান প্রধান উৎসব হলো চাপচার কুট, মিম কুট, থালফাভং এবং বড়দিন।
নাগাল্যান্ড
- কোহিমা নাগাল্যান্ডের রাজধানী।
- নাগাল্যান্ডের মোট আয়তন ১৬,৫৭৯ বর্গ কিলোমিটার।
- কোহিমাকে নাগাল্যান্ডের রাজধানী ঘোষণা করা হয় পহেলা ডিসেম্বর ১৯৬৩। যখন এটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা অর্জন করে।
- ‘কেউহিরা’ থেকে কোহিমা নামটি এসেছে। কোহিমা শহরটি ‘কেউহিরা’ নামক গ্রামে অবস্থিত।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- কোহিমা গ্রাম ‘বড় বস্তি’ নামেও পরিচিত। কারণ এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাম।
- কোহিমা শহরটি নাগাল্যান্ডের বৃহত্তম শহর।
- নাগাল্যান্ডের অর্থনীতি প্রায় ৮৫% কৃষি খাতের উপর নির্ভরশীল।
ত্রিপুরা
- ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার আগরতলা থেকে কাজ করে।
- আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট।
- ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- মুম্বাই এবং চেন্নাইয়ের পরে, আগরতলাকে তৃতীয় আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।
- আগরতলার সরকারি রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা।
- ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হলো ত্রিপুরা।
- বাংলাদেশের সাথে ত্রিপুরার একটি আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।
- ত্রিপুরার ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলি হলো আসাম এবং মিজোরাম।
- ত্রিপুরা উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় জনবহুল রাজ্য।
- গড়িয়া পূজা, খারচি পূজা, কের পূজা এবং দূর্গা পূজা ত্রিপুরাদের প্রধান উৎসব।
- ধান প্রধান ফসল। তবে পাট, তুলা, চা এবং ফলমূল ত্রিপুরাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকারী ফসল।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর প্রসিদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে চেনার সময় এসেছে। এর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিষ্ময়কর স্থাপত্য যেকোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে।
Feature Image: timesofindia.com References: 01. The capitals-of-seven-sisters-of-India. 02. The North-Eastern-States-at-a-glance-seven-sisters-of-India. 03. The surprising-facts-seven-sisters-of-India. 04. The-seven-sisters-of-India. 05. The- seven-sisters-of-north-east-India.