পেঁয়াজ নামটা শুনলেই প্রথমে এর ঝাঁঝের কথা মাথায় আসে। এটা এমন একটা উদ্ভিদ যা কাঁচা বা রান্না সবভাবেই খাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পেঁয়াজের ব্যবহার হয়। তাই কমবেশি সবাই পেঁয়াজ চেনে।
রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করলে স্বাদ বেড়ে যায়। এছাড়া কাচা পেঁয়াজেরও রয়েছে ভিন্ন স্বাদ। এজন্য ঝাঁঝ থাকা সত্ত্বেও এটা কাঁচা খাওয়ারও প্রচলন আছে।
পেঁয়াজের ঝাঁঝটা বেশি বের হয় কাটার সময়। তখন চোখে পানি চলে আসে। এই ঝাঁঝ এত বেশি যে অনেকেই পেঁয়াজ কাটতে চান না। তবুও পেঁয়াজ খোসা ছাড়িয়ে কেটে খেতে হয়। কারণ এই ঝাঁঝালো পেঁয়াজের অনেক ঝাঁঝালো গুণ রয়েছে। তাই পেঁয়াজ খাওয়া উচিত।
পেঁয়াজ কি ও এর প্রকারভেদ
পেঁয়াজ হলো অ্যামেরিলিস পরিবারের ভেষজ জাতীয় উদ্ভিদ যার মূল খাওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালিয়াম সিপা। পৃথিবীতে চাষ করা প্রাচীনতম উদ্ভিদের মধ্যে এটি একটি। সম্ভবত ভারত, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম এগুলো চাষ করা হতো। কিন্তু এখন সারা বিশ্বেই চাষ করা হয়, প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে।
একটি পেঁয়াজের মূল থেকে এক বা একাধিক পাতাহীন ফুলের ডাল গজায় যা ২.৫-৬ ফুট উঁচু হয়। এটিকে পেঁয়াজ কলি বলে।এর ডগায় গুচ্ছাকারে ছোট সাদা ফুল হয়। এই ফুল থেকে বীজ হয় এবং নতুন গাছের বংশবিস্তার হয়।
বেশিরভাগ পেঁয়াজ জমি থেকে তুলে বাজারজাত করার আগে সামান্য শুকানো হয়, যার ফলে তাদের চামড়া বা খোসা শুষ্ক এবং কাগজের মতো পাতলা হয়ে যায়। এই পেঁয়াজ ঘরেই অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায় স্বাভাবিক আবহাওয়ায়। তবে পেঁয়াজ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত আকারেও পাওয়া যায়।
যেমন সেদ্ধ করে, আচার বানিয়ে যা ক্যান বা বয়ামে প্যাক করে রাখা হয়। আর সুপারশপে কাটা বা খোসা ছাড়ানো হিমায়িত আস্ত পেঁয়াজ পাওয়া যায়। আবার পেঁয়াজের শুকনো গুঁড়ো এবং রসও প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হয়।
প্রকারভেদ
পেঁয়াজের প্রায় ডজনখানেক প্রকার রয়েছে। এসবের স্বাদ ও রঙেও রয়েছে ভিন্নতা। সাধারণ রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হলুদ বা বাদামি পেঁয়াজ। বাজারে এই পেঁয়াজের সহজলভ্যতা বেশি। হলুদ পেঁয়াজ স্বাদে মিষ্টি এবং ঝাঁঝে ভারসাম্যপূর্ণ। যত বেশি সময় রান্না করা হয় খাবার ততই মিষ্টি বা সুস্বাদু হবে।
আরেকটি জাত হলো সাদা পেঁয়াজ। এতে পানির পরিমাণ বেশি ফলে এটা ভাজলে খুব মচমচে হয়। তীব্র স্বাদের এই সাদা পেঁয়াজ মেক্সিকান রান্নায় বিশেষ করে সালসা, চাটনি রেসিপিতে ব্যবহৃত হয়।
লাল পেঁয়াজ দেখতে গাঢ় বেগুনি রঙের এবং একটু শক্ত। রান্নায় ব্যবহার করলে এর আসল রঙটা থাকে না। তাই এই পেঁয়াজটা কাঁচা অবস্থায়ই সালাদ, সালসা, বার্গার এবং স্যান্ডউইচের টপিং হিসাবে ব্যবহার করলে আসল স্বাদ উপভোগ করা যাবে।
এরপরে আরেকটি জাত হলো সুইট অনিয়ন বা মিষ্টি পেঁয়াজ। সুইট অনিয়নের কিছু সাধারণ জাতের মধ্যে রয়েছে ওয়াল্লা ওয়াল্লা, ভিডালিয়া এবং মাউই পেঁয়াজ। এগুলি হলুদ পেঁয়াজের চেয়ে আকারে বড় ও দ্রুত পচনশীল।
এগুলোতে অন্যান্য পেঁয়াজের তুলনায় তীক্ষ্ণ স্বাদ অনুপস্থিত এবং সত্যিই বেশ মিষ্টি স্বাদ আছে। এগুলো পাতলা করে কেটে সালাদ, স্যান্ডউইচের ভেতর ব্যবহার করলে ভালো লাগে।
বারমুডা পেঁয়াজ দেখতে চেপ্টা ও বড়। এগুলো গ্রিলড রেসিপির জন্য দুর্দান্ত। এছাড়া আরও কিছু পেঁয়াজের প্রকারভেদ হলো পার্ল, শ্যালট, স্ক্যালিয়ন, টর্পেডো, স্প্যানিশ অনিয়ন।
পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা পেঁয়াজের পুষ্টিমান হলো:
ক্যালোরি: ৪০
পানি: ৮৯%
প্রোটিন: ১.১ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট: ৯.৩ গ্রাম
চিনি: ৪.২ গ্রাম
ফাইবার: ১.৭ গ্রাম
চর্বি: ০.১ গ্রাম
পেঁয়াজের ঝাঁঝ কেন হয়?
পেঁয়াজ মাটির নিচে জন্মে বলে ভূগর্ভস্থ কোন কীটপতঙ্গ ও প্রাণী যাতে এটির ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য এতে রয়েছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আর এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটির জন্যই মানুষ পেঁয়াজ কাটার সময় কাঁদে মানে চোখে পানি আসে। যখন পেঁয়াজ কাটা হয় তখন এর কোষও কেটে যায় এবং কাটা কোষ থেকে অ্যালিনেজ নামক একটি এনজাইম নিঃসৃত হয়।
পেঁয়াজের রাসায়নিক উপাদান অ্যামিনো অ্যাসিড অ্যালিনেজকে অ্যালিসিন নামক পদার্থে রূপান্তরিত করে। অ্যালিসিন অত্যন্ত হালকা এবং এটি উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আর এই বাতাস চোখের ঝিল্লিতে পৌঁছায় এবং জ্বালাতন করে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে চোখ নিজেকে রক্ষা করতে অ্যালিসিনকে ধুয়ে ফেলতে অশ্রু নির্গত করে যার ফলে কান্নার সৃষ্টি হয়।
পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গুণ
পেঁয়াজ যতই ঝাঁঝালো হোক বা চোখে পানি আনুক এর কিন্তু বহুমুখী গুণ রয়েছে। এই গুণের জন্য পেঁয়াজ খাওয়া উচিত। পেঁয়াজের গুণগুলো হলো:
১. হৃদযন্ত্র ভালো রাখে
পেঁয়াজ খাওয়া উপকারী। বিশেষত কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমে ভালো প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে পেঁয়াজে থাকা কোয়ারসেটিন নামক পলিফেনল উচ্চ রক্তচাপ এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। গাঢ় রঙের পেঁয়াজ যেমন লাল পেঁয়াজে সর্বোচ্চ পরিমাণে কোয়ারসেটিন থাকে। পেঁয়াজের জাতের মধ্যে যেগুলো ‘টিয়ারলেস পেঁয়াজ’ সেগুলো হৃদরোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
২. ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
বর্তমান বিশ্বের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ক্যান্সার। এই রোগটি অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধি দ্বারা চিহ্নিত হয়। পেঁয়াজে ফিসেটিন, সালফার এবং কোয়ারসেটিন রয়েছে যা টিউমারের বৃদ্ধিকে হ্রাস করে। সেইসাথে টেস্ট-টিউব গবেষণায় ডিম্বাশয় এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের বিস্তারকে রোধ করে দেয়। তাই নিয়মিত কাঁচা লাল পেঁয়াজ খেলে পাকস্থলী, স্তন, কোলন এবং প্রোস্টেটের মতো বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পেতে পারে।
৩. রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে
টাইপ 2 ডায়াবেটিস একটি সাধারণ রোগ, যা প্রাথমিকভাবে রক্তে উচ্চ গ্লুকোজ থাকলে চিহ্নিত হয়। টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়ার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তবে কাঁচা পেঁয়াজ টাইপ 1 এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিস উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে।
৪. হাড় মজবুত করে
বর্তমানে সারা বিশ্বে অস্টিওপোরোসিস একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ পুরুষ এবং মেনোপজ পরবর্তী মহিলাদের মধ্যে। গবেষণায় দেখা যায় যে পেঁয়াজ হাড়ের ক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং এমনকি হাড়ের ঘনত্বও বাড়িয়ে দিতে পারে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে যদি কেউ ৮ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ১০০ মিলিলিটার করে পেঁয়াজের রস খায় তাহলে তার হাড়ের খনিজ ঘনত্ব এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যপ্রণালি উন্নত হয়। এছাড়াও সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব বয়স্ক ব্যক্তি প্রায়শই পেঁয়াজ খান তাদের হিপ ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি ২০% এরও বেশি কমে যায় পেঁয়াজ কম খাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায়।
৫. হজম শক্তি বাড়ায়
পেঁয়াজ হলো ফাইবার এবং প্রিবায়োটিকের সমৃদ্ধ উৎস যা অন্ত্রের সর্বোত্তম স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রিবায়োটিক হলো অপাচ্য ধরনের ফাইবার যা উপকারী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভেঙে যায়। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রিবায়োটিক খাওয়ায় এবং অ্যাসিটেট, প্রোপিওনেট ও বুটাইরেট সহ শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, প্রদাহ কমায় এবং হজমশক্তি বাড়ায়। তাই দেখা যায় পেঁয়াজ খাওয়ার উপকারিতা অনেক।
৬. রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমায়
কাঁচা পেঁয়াজ নিয়মিত খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন ৮০-১২০ গ্রাম কাঁচা লাল পেঁয়াজ খেলে মোট LDL বা খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায়।
৭. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
পেঁয়াজের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের ক্ষতিকারক টক্সিন শরীর থেকে বের করে দেয়। এতে থাকা সালফার-যৌগ স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাকে উন্নত করে। এর নির্যাস হিপোক্যাম্পাস বজায় রাখে। তবে এই মেমরি ফাইটিং বৈশিষ্ট্যের একটি অংশ রান্না করার সময় হারিয়ে যেতে পারে। তাই পেঁয়াজ কাঁচা খাওয়াই ভালো।
৮. অ্যান্টি-এজিং সুবিধা
পেঁয়াজের রয়েছে অ্যান্টি-এজিং গুণ। যা ত্বকে অকালে বয়সের ছাপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী ক্ষতিকারক UV রশ্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে। যেহেতু পেঁয়াজ হলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও কোয়েরসেটিনের অন্যতম সমৃদ্ধ উৎস। ফলে এটি ত্বককে বলিরেখামুক্ত রাখে।
অন্যদিকে এতে থাকা ভিটামিন এবং সালফার ত্বককে রক্ষা করে, নরম ও কোমল রাখে। এছাড়া তাজা পেঁয়াজের রস ত্বকে ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। ফলে ত্বকের তারুণ্য এবং ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Best Onion Varieties. 02. Onion Nutrition. 03. Are Onions Good for You? 04. Amazing Health Benefits of Onions.