সভ্য সমাজ সৃষ্টির পর থেকে মানুষের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দের উদ্ভব হতে দেখা যায়। কেউ মত দেন গণতন্ত্র সর্বোত্তম পন্থা, আবার কেউবা বলেন যে দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য একনায়কতন্ত্রের বিকল্প নেই। এছাড়াও, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত বা কোনটি সেরা তা নিয়ে তো তর্ক যুদ্ধের অন্ত নেই।
তবে পৃথিবীতে এমন এক ব্যবস্থা আছে যেটা খুব নিরবেই দেশ বা সমাজকে শাসন করছে। এই শাসন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যেকোনো ক্ষেত্রেই হতে পারে। প্রথমত, ব্যবস্থাটি অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোর মতো লিখিত নয় এবং দ্বিতীয়ত এটি খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত। বলছি অলিগার্কির কথা। আজকের আলোচনা এই অলিগার্কিকে নিয়েই।
অলিগার্কি শব্দটি গ্রীক শব্দ অলিগারখিয়া (Oligarkhia) থেকে আগত। যার অর্থ দাঁড়ায় মুষ্টিমেয় মানুষের শাসন। এই অল্পসংখ্যক গোষ্ঠী বা ব্যক্তিদের শাসনকার্য কিভাবে হয় তার কোন নির্দিষ্ট নীতিবিধি নেই। তবে আধুনিক যুগে অলিগার্কিকে এমন এক শাসন ব্যবস্থাকে বুঝানো হয় যেটা মূলত গুটিকয়েক ব্যক্তির স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে ধনতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রকে কি অলিগার্কি বলা যায় কিনা? এক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, ধনতন্ত্র শুধুমাত্র এলিট ক্লাস দ্বারা শাসিত এক ব্যবস্থা অর্থাৎ এখানে ব্যক্তি হবে বিশাল সম্পদের অধিকারী। যেমন-সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনেকেই ধনতান্ত্রিক তথা প্লুটোক্রেসির সমর্থক বলতো। কেননা তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পূর্ব থেকেই এলিট ক্লাসের অন্তর্গত ছিলেন এবং সেই ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী দেশ চালাতে চেয়েছিলেন।
আবার অভিজাততন্ত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সেটি একটি প্রিভিলেজড শ্রেণির ব্যবস্থা যা আকারে ছোট হয়ে থাকে। এদেরকে প্রাচীন গ্রীস ‘নোবেল ক্লাস’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হতো। তবে অলিগার্কির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা অন্য কোন শ্রেণিগত বিষয় মুখ্য না। একজন অলিগার্ক ধর্মীয় নেতা, জমির মালিক, মিলিটারি অফিসার কিংবা ফেসবুকের জনক মার্ক জাকারবার্গের মতো ব্যবসায়ীও হতে পারে।
আধুনিককালে, অলিগার্কি বুঝাতে রাশিয়ান অলিগার্কদেরই বুঝানো হয়। বলা হয়ে থাকে এসব অলিগার্ক তাদের স্বার্থবিরোধী কাজ হলেই মানুষকে নিপীড়ন করতে এক পা’ও পিছু হটে না। তাদের কাছে নিজ সম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধি করাই মুখ্য। কিন্ত বর্তমান পৃথিবীতে তো কিম জং উন, পুতিন কিংবা জো বাইডেনদেরকেই দেশ পরিচালনা করতে দেখা যায়! এমনকি কেউ গণতন্ত্রপন্থী আবার কেউবা একনায়কপন্থী।
তাহলে অলিগার্করা যে আসলে দেশ চালায় সেই প্রমাণই বা কোথায়?
উত্তর হচ্ছে যে, এই গণতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র একটি পর্দা মাত্র। ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায় যে আমেরিকার মতো গণতন্ত্রের বুলিমাখা রাষ্ট্রও অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণেই। গণতন্ত্রের অন্যতম অংশ তথা নির্বাচন থেকে শুরু করে সব কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে হয়ে থাকে।
তবে মানুষের যে একদম অংশগ্রহণ নেই তা কিন্ত নয়। তাদের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র মতামত প্রদানেই। কিন্ত দেশের পলিসি তৈরির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সেখানে অলিগার্কদের ইচ্ছাকেই পূরণ করা হচ্ছে। অলিগার্করা সরাসরি সরকার পরিচালনায় না থাকলেও পেছন থেকে তারাই সরকার চালাচ্ছে।
আমেরিকার প্রতিরক্ষার বিষয়টি ধরা যাক। ২০২১ সালে জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেন যে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত চুক্তিগুলো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই হয়ে থাকে। মিডিয়াতে ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’-এর দোহাই দিয়ে স্বচ্ছ রাষ্ট্রের চিত্র তুলে ধরা হলেও সেই মিডিয়াই যে অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রিত সেটি মানুষ ভুলে যায়।
আগেই বলা হয়েছে যে, বর্তমানে অলিগার্কদের কথা শুনলে প্রথমেই রাশিয়ানদের কথা মনে পড়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর রাশিয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। বলে রাখা ভালো যে, এর পূর্বে দেশের সব সম্পদের মালিক ছিল সরকার। যাকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
হঠাৎ বিশ্বের পরাশক্তির এমন পতনের ফলে অর্থনীতিকে প্রাইভেটাইজেশন করা নিয়ে তৎকালীন সরকার দ্বিধায় পড়ে যায়। অর্থাৎ কমিউনিজম থেকে সরাসরি ক্যাপিটালিজমে যাওয়া এক দুস্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সমস্যা সমাধান করতে গিয়েই সরকার অলিগার্কদের জন্ম দিয়ে ফেলে।
‘শর্ট টার্ম ক্যাপিটাল ফ্লো’ চালুর ফলে রাশিয়ায় বিনিয়োগকৃত অর্থ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেত। ধরুন, আপনি আজ বাজারে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলেন। আগামীকাল সেই অর্থ দ্বিগুন হওয়ার সাথে সাথেই আপনি টাকা বিদেশে নিয়ে চলে গেলেন। এতে করে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিনিয়োগকৃত অর্থ উধাও হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক একই অবস্থা সদ্য পতন হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটে। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকার দেশের সব শিল্প কারখানাগুলোকে তার পছন্দের ব্যক্তিদের কাছে হস্তান্তর করে। এভাবেই কোন যোগ্যতা ছাড়াই রাশিয়াতে বিলিয়নারদের জন্ম হয়।
এদের মূল সমস্যা হচ্ছে যে, তারা নিজ দেশে অর্থ না রেখে বিদেশে পাচার করেছে। যার ফলাফল ভোগ করেছে রাশিয়ার সাধারণ মানুষেরা। অবস্থা এত বিপর্যস্ত হয় যে একটি রুটির দাম হাজার রুবল ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে।
চেলসি ফুটবল ক্লাবের সাবেক সত্ত্বাধিকারী ছিলেন এমন একজন অলিগার্ক। ২০০৩ সালের পূর্বে কেউ তাকে না চিনলেও হঠাৎ চেলসি ক্লাবকে ক্রয় করে রাশিয়ান অলিগার্কদের ক্ষমতার জানান দেয়।
যদিও বলা হয়ে থাকে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর অলিগার্কদের প্রভাব কমেছে। তবে, অনেকে মনে করেন যে পুতিনের একচ্ছত্রভাবে টিকে থাকার পেছনেও তাদেরই অদৃশ্য হাত আছে।
সার্গেই বরেসোভিস ইভানোভিচও এমন একজন অলিগার্ক। তিনি বর্তমানে স্পেশাল প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটিতে কাজ করছেন। এছাড়াও তার ছেলে দুনিয়ার অন্যতম ডায়মন্ড মাইন কোম্পানি আল রোসার সিইও।
এছাড়াও, বারব্যাংক (SberBank) এর মালিক ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ। তারা সবাই খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো আজকাল দাবি করছে যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এই অলিগার্কদের জন্যই পুতিন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ তো গেল ব্যবসায়ীদের অলিগার্ক হওয়া কথা। ব্যবসায়ী ছাড়াও যে দেশ শাসন করে থাকে তাদের অন্যতম উদাহরণ ইরানের ধর্মীয় নেতাগণ। ইরানকে ধর্মতন্ত্রের অলিগার্কি হিসেবে চিহ্নিত করতে দেখা যায়। ইরানের এই অবস্থা হয় ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে।
ধর্মীয় নেতারা ধর্মের দোহায় দিয়ে ক্ষমতায় বসে তাদের মতাদর্শে দেশ পরিচালনা করছেন। তাদের একজন সুপ্রিম লিডার আছেন এবং তার পরিবর্তে ভবিষ্যতে কে সর্বোচ্চ পদে বসবেন সেটাও নির্ধারিত।
তারা শুধুমাত্র ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় নয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও ইরানের এই ব্যবস্থাটি জনসম্মুখে দেখা যায়। তবে সেটিকে অলিগার্কি বলা হয়, কেননা পেছন থেকে আরো অনেকেই সরকারকে নিজ ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আফ্রিকার দিকে নজর দেওয়া যাক। বলা হয়ে থাকে জিম্বাবুয়ের আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট জিম্বাবুয়ের অন্যতম এক গোষ্ঠী যারা তাদের সম্পদ এবং নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে দেশের পলিসি পরিবর্তন করে থাকে।
তুরস্কের সাবান্সি এবং কোস (Koc) পরিবার, ইউক্রেনের ইগোর কলমইস্কি প্রমুখ ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনায় অদৃশ্য হাত দিয়ে রেখেছেন।
জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার
উক্তিটি ততক্ষণই বিদ্যমান যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটি অলিগার্কদের স্বার্থে আঘাত না হানে। অলিগার্কদের এই শাসন নতুন কিছু নয়। প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে আঠারো শতকে ফ্রেঞ্চ ক্যাথলিকদের উপর টরি অলিগার্কদের মধ্যেও এই শাসন দেখা যায়।
পৃথিবীতে অলিগার্কির চর্চা যে আরো বিস্তর হতে পারে সেই শঙ্কা থেকেই যায়। বিশেষত পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ব্যবসায়ীদেরই অলিগার্ক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আরো অন্যান্য বিষয় জড়িত থাকার সাথে সাথে মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ট্রেডার্সদের চাপে পদত্যাগ করেন তখন গণতন্ত্রের জয়ের সাথে অলিগার্কদের জয় নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
Feature Image: In these times Sources 01. The Tory Oligarchy. 02. How Did Russia's Oligarchs Rise to Power? 03. Oligarchy Examples in Different Countries. 04. The History of Oligarchs, from Ancient Greece to Modern Russia. 05. Us Run by oligarchy. 06. Study: US is an oligarchy, not a democracy.