কথায় আছে ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।’ জ্ঞানপিপাসু মানুষজন সবসময় জ্ঞানের নতুন নতুন উৎসের সন্ধানে অন্বেষণ করে বেড়িয়েছেন বিদেশ-বিভূঁই। তাই, উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশ গমনের প্রচলন বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। প্রতি বছর শুধুমাত্র পড়াশোনা করার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমায়। যদিও প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর পড়াশোনার ধাঁচ একটু ভিন্নধর্মী। তবে একই সাথে কম খরচ এবং বিশ্বসেরা পড়াশোনার মান চাইলে ইউরোপের দেশগুলোই সবার সেরা।
সেখানকার প্রায় প্রতিটি দেশেই মিলবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় সাথে তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার সুযোগ। বহু ভাষা-ভাষী এবং বহু সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে থেকে পড়াশোনা করতে চাইলে ইউরোপ-ই হবে বেস্ট চয়েস। হোক ব্যাচেলর, মাস্টার্স অথবা পিএইচডি ডিগ্রি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলো কখনোই নিরাশ করবে না। শুধুমাত্র থিওরিটিক্যাল পড়াশোনায় নয়, গবেষণাধর্মী কিংবা হাতে-কলমে ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্যেও এসব দেশ সেরা। কোন দেশ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় হবে কার জন্য উপযুক্ত – এমন ভাবনা সবার মাথাতেই আসে। তাদের জন্যই আজকের আয়োজন।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপকে বেছে নেয়া উচিত কেন?
যে কারোর মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, পড়াশোনার জন্যে ইউরোপ-ই কেন কিংবা ইউরোপের পড়াশোনার মধ্যে এমন ভালো কোন দিকটা আছে? ইউরোপে প্রায় চল্লিশটিরও অধিক দেশ আছে। যার দরুন যে কেউই চল্লিশের বেশি কৃষ্টি-সভ্যতা-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিচরণ করতে পারবে। সন্দেহ নেই, তাতে ছাত্র-ছাত্রীর অন্তর্দৃষ্টি এবং মানসিকতা সমৃদ্ধশালী হবে। ইউরোপে পড়াশোনা করার কিছু সুবিধাজনক দিক হচ্ছে –
- প্রথমত, সার্টিফিকেট যদি হয় কোন বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের তবে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের থেকে একধাপ এগিয়ে থাকা যায় চাকুরীর সিরিয়াল লিস্টে কিংবা জীবনযাপনের মান উন্নয়নে।
- আমেরিকার তুলনায় ইউরোপে পড়াশোনার খরচ তুলনামূলক কম। এছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ এর ব্যবস্থাও আছে, যা খরচটা কমাতে সাহায্য করে।
- ইউরোপের দেশগুলো তুলনামূলক ছোট এবং পাশাপাশি হবার কারণে এক দেশ থেকে আরেক দেশ ভ্রমণটা খুবই সহজ। তাছাড়া, যাতায়াতও খুব সহজলভ্য। ফলস্বরূপ, স্টুডেন্ট হয়েও ভ্রমণ করাটা খুব একটা দুঃসাধ্য কিছু না।
এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক ইউরোপ সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিস্তারিত –
১. ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি। ১০৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘The Lord is my Light’ এই স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ইংরেজি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বিবেচনায় বিশ্বের সব থেকে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃত।
২০২২ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুযায়ী সারা বিশ্বে এটির অবস্থান দ্বিতীয়। বর্তমানে এখানে প্রায় ৪৮ ধরনের আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম চালু আছে। এখানে কলা, যন্ত্রবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়।
২. ইউনিভার্সিটি অফ ক্যামব্রিজ
১২০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধরা হয় বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দিক বিবেচনায়। লন্ডন থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার উত্তরে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়টির একক কোন ক্যাম্পাস নেই এবং এর কলেজগুলো সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৮,০০০ এর অধিক শিক্ষার্থী, প্রায় ৯,০০০ কর্মী, ৩১টি কলেজ, ১৫০টি বিভাগ, অনুষদ, স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগে গঠিত। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং ২০২২ অনুযায়ী এটি সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে।
৩. ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন
লন্ডনে অবস্থিত বিশ্বমানের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির লক্ষ্য বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এবং ব্যবসায় শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উৎকর্ষ সাধন করা। ১১৫ বছরের পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৭ সালে। কিউএস র্যাঙ্কিং ২০২২ অনুযায়ী সারা বিশ্বে এটির অবস্থান ৭ম।
ইম্পেরিয়ালের একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক কমিউনিটি রয়েছে যেখানে যুক্তরাজ্যের বাইরে থেকে আসে ৫৯% শিক্ষার্থী এবং প্রায় ১৪০টি দেশ ক্যাম্পাসে প্রতিনিধিত্ব করে।
৪. সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (ETH) জুরিখ
১৬৭ বছরেরর পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৮৫৪ সনে। এই পাবলিক রিসার্চ প্রতিষ্ঠানটি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে অবস্থিত। সুইস ফেডারেল সরকার কতৃক প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে মূলত এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গনিতের উপর ফোকাস করে থাকে।
২০২২ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং অনুযায়ী এটির অবস্থান ৮ম। যেটি সারা বিশ্বের প্রায় ১৬৫০টিরও অধিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্য থেকে করা হয়েছে। ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে ১২০টিরও বেশি দেশের ২৪,৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, যার মধ্যে ৪,৪৬০ জন ডক্টরেট ডিগ্রি নিচ্ছেন।
৫. দি ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ
স্কটল্যান্ডে অবস্থিত ৪৩৯ বছরের পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৫৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুযায়ী এটির অবস্থান ১৬ তম। স্কটিশ এনলাইটমেন্টের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবছর প্রায় ৬০,০০০ এর অধিক স্নাতক ডিগ্রী অর্জনে আগ্রহীদের আবেদন এসে থাকে।
৬. ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টারডাম
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক প্রতিষ্ঠান যেটি ১৬৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির অবস্থান নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান আপাতত ৫৫ নম্বরে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি নেদারল্যান্ডসের তৃতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ইউরোপের বৃহত্তম গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৩১,১৮৬ জন ছাত্র, ৪,৭৯৪ জন কর্মী এবং ১,৩৪০ জন পিএইচডি শিক্ষার্থী।
৭. হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত এবং গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষার জন্য নিবেদিত। এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৩৮৬ সালের ১৮ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রায় বারোটি অনুষদ নিয়ে গঠিত এবং প্রায় একশটি বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পোস্ট-ডক্টরাল স্তরে ডিগ্রি প্রোগ্রাম অফার করে থাকে।
এটির অবস্থান জার্মানির ব্যাডেন-ওয়ার্টেমবার্গ অঙ্গরাজ্যের হাইডেলবার্গ শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে ৬৩ তম অবস্থানে আছে কিউএস ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং অনুযায়ী।
৮. সরবান ইউনিভার্সিটি
এটি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত একটি পাবলিক রিসার্চ ইউনিভার্সিটি। এটি একই সাথে ইউরোপ এবং বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি। ২০২১ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং অধ্যাপকেরা মিলে ৩৩টি নোবেল পুরষ্কার, ছয়টি ফিল্ড মেডেল এবং একটি ট্যুরিং পুরষ্কার জিতেছে।
কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০২২ সালে ৭২ তম অবস্থানে আছে।
৯. ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেন
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা এবং শিক্ষা প্রদান করে থাকে। এটি ১৪৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিউএস র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ৭৯ তম অবস্থানে আছে।
ডেনমার্কে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত।
১০. ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি রটারডাম
১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি রটারডাম একটি আন্তজার্তিক গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় যেটি রটারডামের প্রগতিশীল এবং বৈচিত্র্যময় শহরে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়েছে ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস রোটেরোডামাস এর নামানুসারে।
যিনি পনের শতকের একজন বিখ্যাত মানবতাবাদী এবং ধর্মতত্ত্ববিদ হিসাবে পরিচিত। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে ১৭৯ তম অবস্থানে আছে।
Feature Image: Nurun Naher Suhi
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. 10 Best Universities in Europe for International Students.
02. 10 Best Public Universities in Europe in 2022.
03. University of Amsterdam.