এটগার কেরেট: পরাবাস্তবতার জন্য জনপ্রিয় ইসরায়েলি লেখক

845
0

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপসহ পুরো বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তৎকালীন শিল্পীরা যুদ্ধের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনাকে দায়ী করেছিল। তাই, এসবের বিরোধিতার জন্য সব শিল্পী মিলে চিরাচরিত চিন্তাচেতনা আর ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন এক ধারা তৈরি করেন। যা প্রচলিত সব শিল্পচর্চার একদম বিপরীত বা এন্টিআর্ট। তাদের বিশ্বাস ছিল অতিরিক্ত যুক্তির ভারে মানুষের অবচেতন মন তীব্রভাবে অবহেলিত হয়। অর্থহীন আঁকাআকি আর যুক্তিহীন লেখালেখিতে নিমজ্জিত হয় সব শিল্পী। ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘ডাডা মুভমেন্ট’ বা ‘ডাডা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফরাসী কবি এবং সমালোচক আঁন্দ্রে বেটন। 

ব্রেটন পড়াশুনা করেছিলেন মনোবিদ্যা এবং চিকিৎসা নিয়ে। মানসিক অসুস্থতা ছিল তার অন্যতম আগ্রহের বিষয়। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের স্বপ্নের ব্যাখ্যায়; স্বপ্নের উৎপত্তির সঙ্গে অবচেতন মনের ধারণা সম্পর্কিত বিষয়টি তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এর সাথে মার্ক্সবাদ জড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। সামাজিক যুক্তির বেড়াজাল থেকে মনকে মুক্ত করার আন্দোলনের সঙ্গে সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। স্যুরিয়ালিজম শব্দটি সর্বপ্রথম ফরাসি লেখক গিয়োম এপোলেনেয়ার ব্যবহার করেছিলেন ১৯১৭ সালের দিকে। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে ব্রেটন ‘দ্য স্যুরিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং তাকে পরাবাস্তববাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, 

স্যুরিয়ালিজম হচ্ছে অবচেতন মনের ইচ্ছা যা যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়; এবং তা নৈতিকতা কিংবা সৌন্দর্যবোধেরও উর্ধ্বে। আর এই ধারা চিত্র, লেখালেখি কিংবা যে কোন মাধ্যমেই প্রকাশ পেতে পারে।  

দ্য স্যুরিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো; Image Source: Abe books

আমাদের এই বাস্তব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পরাবাস্তবতার। আর সেই পরাবাস্তবতার জন্য সাহিত্যে বিখ্যাত লোকেদের নাম আমরা প্রায়শই শুনি। শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাস এক বনলতা সেনকে খুঁজতে হাজার বছরের পথ পরিক্রম করেছেন। হুমায়ুন আহমেদ হিমুর চোখে দেখেছেন অদ্ভুত আর রহস্যময় এক দুনিয়া। শহীদুল জহির দেখেছেন কাকবিহীন এক মধ্য দুপুরের শহর। হারুকি মুরাকামি বলেন এক আকাশে দুই চাঁদের গল্প। এমনই একজন সাহিত্যিকের নাম এটগার কেরেট। ইসরায়েলি এই লেখককে ইসরায়েলের কাফকা নামেও অভিহিত করা হয়। 

এটগার কেরেটের লেখার মূল বিষয়বস্তু পরাবাস্তবতা। দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলোর মধ্যে গভীর এক জীবনবোধের গল্প বলাটাই এটগার কেরেটের ধাঁচ। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলে জন্ম নেন এই লেখক। তার জনমের সময়টাতেও ইসরায়েল যুদ্ধে লিপ্ত ছিল; যা জুন ওয়ার নামে পরিচিত। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে একজন ইসরায়েলি নাগরিক হিসেবে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে কাটিয়েছেন দুই বছর। ঠিক সেই সময়টাতে লেখালেখির প্রতি ঝোঁকটা চেপে বসে। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ চলাকালীন আবদ্ধ জায়গা থেকে নিজের পরিস্থিতি নিয়ে দ্য পাইপ নামে এক গল্প লেখেন। 

তাড়া করে ফেরা হলোকাস্টের স্মৃতি, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা, লক্ষ লক্ষ ইহুদির হত্যাকাণ্ডের জঘন্য ইতিহাস ক্ষণে ক্ষণে পীড়া দেয় কেরেটকে; কিন্তু এসবই যেন কেরেটের লেখার উপজীব্য বিষয়বস্তু। পরাবাস্তবতার আড়ালে এসব সত্যকে যেন অবাস্তব এক জগতের মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসেন এটগার কেরেট। সহজ ভাষায় ক্ষীণ বক্তব্যে যেন পুরো এক ইতিহাস বয়ান করেন লেখক। 

এটগার কেরেট। Image Source: Martina Kenji/heebmagazine.com

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এই এক গল্পই তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এরপর লেখালেখি শুরু করলে বিশ্বখ্যাত সব পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়। এমনকি তার রচিত চিত্রনাট্যে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে; যা পুরষ্কারও অর্জন করে নিয়েছে। বর্তমানে লেখালেখির পাশাপাশি ইসরায়েলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করছেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক পত্রিকায়ই নানান সময়ে এটগার কেরেটের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। সেইসব সাক্ষাতকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোই অনুবাদ করে দেয়া হলো পাঠকদের জন্য। 

রেবেকা: আপনি হিব্রু ভাষায় লিখেন কিন্তু আমার সেই ভাষায় দক্ষতা নেই, তাই অনুবাদ পড়ি। কি মনে হয় আপনার লেখার কতটুকু পাচ্ছি? 

এটগার কেরেট: প্রথমত, হিব্রু হচ্ছে বেশ প্রাচীন একটা ভাষা। দুই হাজার বছরের প্রাচীন এই ভাষার আলাদা একটা মজা আছে, একটা নিজস্বতা আছে, একটা ঢঙ আছে আর আছে রীতিনীতি। অবশ্যই হিব্রু থেকে অন্য ভাষায় গেলে এই ব্যাপারগুলো প্রস্ফুটিত হবে না এইটাই স্বাভাবিক। তবে, আমার কপাল ভালো যে খুব ভালো অনুবাদকদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই তারা দারুণ প্রশংসনীয় কাজ করে। 

ড্যানিয়েলা: পাঠকেরা বলে আপনার লেখাগুলো বাস্তব যুক্তিসম্পন্ন তবে পরাবাস্তব একটা ব্যাপার আছে। আবার, আপনার চরিত্রগুলোও কেমন অগাছালো পরাবাস্তব ধাঁচের কিন্তু তাও কতটা শক্তিশালী আর দৃঢ়। কি বলবেন এই বিষয়ে? 

এটগার কেরেট: আসলে আমার কোন গল্পটা নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা জানাটা আমার জন্য জরুরী এই ক্ষেত্রে। কেননা, আমার বেশিরভাগ গল্প বাস্তবিক নয় তবে বাস্তব বিষয়গত অভিজ্ঞতায় আমি খুবই আগ্রহী। আমি প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরে গল্প লিখি না তবে হ্যাঁ আমি মৌলিক সত্য নিয়ে লিখি। আমি পৃথিবীর অস্তিত্বের সঠিক বিবরণ দেয়ার চাইতে মানব মনের আবেগের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতেই বেশ পছন্দ করি। 

পরাবাস্তববাদী লেখকের একটি পরাবাস্তব চিত্র। Image Source: unbound.com

ড্যানিয়েলা: কোন লেখকের লেখা আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে? 

এটগার কেরেট: কাফকা থাকবে সবার উপরে। কাফকা ছাড়া আমি কিছুই না। ইসরায়েলি নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে দুই বছরের সেবা প্রদান করতে হয় সেনাবাহিনীতে। আমার প্রশিক্ষণ চলাকালে আমি কাফকার “মেটামরফোসিস এবং অন্যান্য গল্প” বই পেয়েছিলাম। কোথায় পেয়েছিলাম বা কে দিয়েছিল ঠিক মনে নেই আমার। কেননা, ঐ দুই বছর একদমই সব ধরণের যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলাম আমি বা আমরা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইতিহাসের খারাপতম সৈনিকদের তালিকা করা হলে আমার নাম থাকবে সবার উপরে। 

মারাত্মক রকমের মানসিক বিপর্যস্তের শিকার হয়েছিলাম তখন। ঠিক সেই সময়টাতে কাফকার রচনা আমাকে প্রশান্তি দিয়েছিল। আমার কাছে মনে হয়েছিল, যতটা বিধ্বস্ত অবস্থায় আছি আমি তার চাইতেও অনেক বেশি বিধ্বস্ত আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে এইসব লেখা লিখেছিল কাফকা। তাই কাফকার রচনা সবসময়ই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে এবং এখনো দেয়। এছাড়া,  ইহুদি লেখক শ্যালোম অ্যালেইকেমের কথা বলতে পারি, যার তৈরি করা চরিত্রগুলো কোন বক্তব্য রাখে না কিন্তু অনেক কথা বলে। তারপর কার্ট ভনেগার্টের কথাও বলবো। 

অ্যালেক্স ক্লার্ক: ছোট গল্প নিয়ে আপনার চিন্তাধারা কি? 

এটগার কেরেট: বিগত ৩৩ বছর ধরে আমি ছোট গল্প লিখছি এবং এটা একদম অবারিত ধারায়। ব্যাপারটা আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে এখন, তার উপর আবার ক্যারিয়ার নামক একটা বিষয়বস্তু তো আছেই। আমার কাছে এটা বাস্তবতার সাথে লড়াই করার মতোই। 

আমার গল্পগুলো অদ্ভুত কোন এক জায়গা থেকে উঠে আসে। আমি কখনোই পূর্বে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করিনা কিংবা ভাবিনা কি হতে যাচ্ছে বা হবে। একটা ছোট গল্প লেখার চেয়ে একটা সংকলন লেখার মাঝে যে রূপান্তরটা সেই সম্পর্কে এতটুকুই বলবো যে, ঠিক ঐ সময়টায় আমি বুঝতে পারি কোথায় আছি, কি বিরক্ত করছে আমায় এবং আমার অভিজ্ঞতা কি! 

এটগার কেরেটের একটি গল্প অ্যাজমা অ্যাটাক; Illustration by Frances Cannon

রেবেকা সেকস: শুনেছি ইসয়ারেলে নাকি আপনার বই বেশ চুরি হয় বুকশপ থেকে? 

এটগার কেরেট: হ্যাঁ, ব্যাপারটা দুঃখজনক বটে। এমনকি আমি এমনও মেইল পেয়েছি যে, আমি যেন শীতকালে আমার বইগুলো প্রকাশ করি কারণ কোটের পকেটে একটা বই ঢুকিয়ে নেয়া অনেকটাই সহজ। হা…হা…!! 

সাংবাদিক: আছে না এমন একটা বই থাকে যেটা সবসময়ই পড়তে ভালো লাগে। এক্ষেত্রে আপনি কোন বইটার কথা বলবেন? 

এটগার কেরেট: কার্ট ভনেগাটের স্লটারহাউজ-ফাইভ এর কথা বলতেই হয় তাহলে। খুব সম্ভবত এটাই হচ্ছে আমার জীবনে সবচাইতে বেশি বার পুনরায় পড়া একটা বই। কতবার যে পড়েছি তার ইয়াত্তা নাই। দেশের যুদ্ধবিগ্রহের অভিজ্ঞতা যতবার নিয়ে হয়েছে আমাকে, ততবারই কেন যেন এই বইতে ফিরে যেতে হয়েছে আমাকে। 

এটগার কেরেট। Illustration by Jillian Tamaki.

সাংবাদিক: শৈশবের গল্প বলেন? 

এটগার কেরেট: ছোটবেলায় আমি তেমন একটা স্কুলে যেতাম না। আমার হাঁপানির সমস্যা ছিল। আর আমার বাবা-মাও চাইতো না আমি বাসার বাইরে যাই। বাড়িতে থাকার জন্য তাই আমি প্রায়শই অসুস্থ থাকার ভান করতাম। সেইসব দিনগুলোতে বাড়িতে থেকে সময় কাটানোর জন্য হাতের কাছে যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম। তাই, ছোটদের রূপকথার গল্প ছাড়াও স্যালিঞ্জারের ছোট গল্প এবং উইলিয়াম ফকনারের উপন্যাসও পড়া হয়েছে আমার।

ছোট থাকতে “হাকলেবারি ফিন” ছিল আমার সবচাইতে পছন্দের বই। যতদূর মনে পড়ে তখন আমার ৯ বছর এই এই বইটা পড়ে শেষ করেচিলাম। বইটা পড়া শেষে আমি বেশ খুশী হয়েছিলাম এই জন্যে যে, আমার দেশে কোনো দাস নেই। ঠিক একই দিন আমি বিকালে টাউন স্কয়ারে গিয়েছিলা ফালাফেল কিনতে; সেখানে দোকানের মালিককে দেখলাম একজন আরব কর্মচারীর উপর চিৎকার করছে; এরকমটা এর আগে কখনোই দেখিনি আমি; একজন মানুষ যে অন্য আরেকজনের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারে তাইই জানতাম আমি। ব্যাপারটা তাই আমাকে বেশ কষ্ঠ দিয়েছিল।এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক মুহূর্ত; পৃথিবীর অন্য অংশের গল্পগুলো যে আরো বেদনাদায়ক হতে পারে সেই সম্পর্কেও একটা ধারণা হয়েছিল। 

Feature Image: Graeme Robertson/The Guardian
তথ্যসূত্রসমূহ:

01. How the Surrealist Movement Shaped the Course of Art History.
02. Surrealism.
03. André Breton.
04. Etgar Keret: ‘For the past year I haven’t read any books.
05. Something Out of Something: Talking with Etgar Keret.
06. Etgar Keret: By the Book.