ঈদি: ঈদ সালামির আদ্যোপান্ত

399
0

পৃথিবীর সব ধর্মের উৎসবগুলোতে দেশ ও সমাজ ভেদে নানা ঐতিহ্য কিংবা রীতি-নীতি দেখা যায়। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় দুটি উৎসব হলো ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা।

ঈদ মানে আনন্দ। দীর্ঘ একমাস পানাহার বর্জন করার পর ইদ-উল ফিতরের দিনে মুসলিমগণ পানাহার করার অনুমতি পান। এই আনন্দের দিনকে কেন্দ্র করে মানুষকে দান সদকা, যাকাত প্রদান, উপহার দেওয়ার বিষয় পরিলক্ষিত হয়।

মুসলিমদের মনে সঞ্চার হয় এক নতুন প্রকার আনন্দ। আর এই আনন্দকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার অনেক দেশেই ‘ইদের সালামি’ অর্থাৎ, ইদের দিন পরিবার বা মহল্লার জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরকে সালাম করে বাচ্চাদের অর্থ কিংবা উপহার পাওয়ার সামাজিক রীতি রয়েছে।

ইদের এই সালামিকে আবার ‘ঈদি’ কিংবা ‘ঈদিয়াহ’ বলেও অভিহিত করা হয়। আজকের আয়োজন এই ইদ সালামি নিয়েই।

What is 'Al Eidiyah'?
বাচ্চাকে সালামি প্রদানকালের ছবি। Image Source:dubaipost.se

ইদ সালামির ইতিহাস ঘাটলে বিচিত্র তথ্য পাওয়া যায়। মধ্যযুগের শুরুর দিকে ফাতিমীয় খেলাফতের সময় বৃদ্ধ ও শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন ধরণের মিষ্টান্ন, অর্থ এবং কাপড় উপহার দেওয়া হতো। এরপর থেকেই ইদের জন্য পোশাক ও বিভিন্ন নতুন জিনিসপত্র কেনা বেচার প্রচলন হতে দেখা যায়।

তবে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে বিশেষ করে অর্থ প্রদান অর্থাৎ ইদের সালামি বা ঈদিয়া দেওয়া শুরু হয়। মূলত শিশুদেরকে বাবা-মা কিংবা পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা স্বল্প পরিমাণের অর্থ প্রদান করে আনন্দ দিতেন। শিশুরা এই অর্থ ইদের দিন ব্যয় করতো।

এছাড়াও, ধার্মিক কিছু উক্তির দিকে দৃষ্টি দিলেও ইদের দিন উপহার দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইসলামের শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইদের দিন উপহার বিনিময় করতেন বলে জানা যায়।

নবীর স্ত্রী হযরত আয়শা (রাঃ) দ্বারা বর্ণিত হয়েছে যে, নবী একে অপরের সাথে উপহার বিনিময় করার কথা বলেছেন যেন হৃদয় থেকে খারাপ অনুভূতি দূর হয়।

Turkish and Ottoman traditions for Eid al-Fitr: A time for gratitude | Daily Sabah
অটোম্যান সম্রাজ্যের সময়ে উপহার বিনিময়ের একটি অংকন। Image Source: Daily Sabah

এভাবেই ক্রমেই মুসলিম দেশ গুলো এবং ইউরোপের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উপহার বিনিময়ের রেওয়াজ দেখা যায়। সালামি বা ঈদিয়ার বিষয়টি এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে চোখে পড়ে। সালামি যে শুধুমাত্র অর্থ হতে হবে এমন কিছু কিন্ত নয়। আজকাল নানা বিষয়কেই সালামি বা ঈদিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে একে অর্থনৈতিকভাবে অর্থাৎ বিনিয়োগ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। শিশুরা যদি এক মাস রোজা রাখতে পারে তাহলে তাদের উপহার হিসেবে গেমিং কম্পিউটার কিংবা মোবাইল কিনে দেওয়াকেও সালামি বা ঈদিয়া হিসেবে দেখা হয়।

স্যামি বদরন নামক একজন এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বলছেন যে, গ্লোবালাইজেশনের দরুণ রমজানের ঐতিহ্য বা রীতি নীতির ও নতুন ধরণ এসেছে। তিনি বলছেন যে ইদের উপহারের বিষয়টি আজকাল বাণিজ্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে এই ঈদিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল পরস্পরকে নম্রতা দেখানো।

আরব আমিরাতের সরকার ঈদিয়াকে একটি জাতীয় বিষয় হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তারা ইদ উপলক্ষে নানা গিফট ভাউচার, ন্যাশনাল বন্ড এর ব্যবস্থা করে থাকে।

ন্যাশনাল বন্ডের লোগো। Image Source: The finance dean

যাই হোক, সালামির বিষয়টি শিশুদের জন্য আজও উৎসবের মতোই বলা চলে। শুধুমাত্র শিশু নয়, বয়সে ছোট হলে যে কেউ ই এখন জ্যেষ্ঠ সদস্য থেকে সালামি দাবি করে থাকে এবং জ্যেষ্ঠ সদস্যরাও খুব আনন্দের সহিত তা উপভোগ করে।

সালামি প্রদানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এখানে অর্থের পরিমাণ মুখ্য কোন বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে নতুন নোটের অর্থ পাওয়া। অনেকেই এই নোটকে ব্যবহার না করে স্মৃতি কিংবা সংগ্রহ হিসেবে যুগের পর যুগ রেখে দেয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইদ ও সালামি

ভারতীয় উপমহাদেশে ইদের সালামির বিষয়টি আলাদা এক তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তান সব দেশের শিশু কিশোরদের জন্য এটি অনন্য এক ঘটনা।

এমন এক ঘটনার কথা পাকিস্তানী এক ব্যক্তি তার ইন্টারভিউতে স্মরণ করেন। পাকিস্তানে বাবা-মা ছাড়াও দাদা-নানাও তাদের পরিবারের ছোট সদস্যদের সালামি প্রদান করেন।

সেই সালামির অর্থ হয় চকচকে ও নতুন। অর্থ পাওয়ার পর সব শিশুরা একসাথে অর্থ গণনা করে কে কত টাকা পেয়েছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে বলে জানা যায়।

Eidiyah tradition goes online courtesy Covid - Oman Observer
ইদ সালামি নেওয়ার মুহূর্ত। Image Source: Oman Observer

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রায় একই। তবে সালামি নিয়ে উদযাপন উদ্দীপনা ইদের আগের থেকেই শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে সালামি নিয়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকে।

অর্থাৎ, শিশুদের সাথে তরুণরাও সালামি নিয়ে অনেক আগ্রহী বলা চলে। ইদের দিন সকালবেলা উঠেই শিশু কিশোররা নতুন জামা কাপড় পড়ে নামাজ আদায় করতে যায়। নামাজ শেষের সাথে সাথেই তারা সালামি আদায়ের লক্ষ্যে নেমে পড়ে। প্রথমে পরিবারের সদস্য এবং পরবর্তীতে প্রতিবেশি কিংবা অন্যান্য আত্নীয় স্বজনের বাসায় গিয়ে তারা সালামি নেয়।

এরপরেই শুরু হয় তাদের উৎসব। মহল্লা বা কলোনির শিশুরা তাদের নিজ নিজ টাকা দিয়ে তাদের পছন্দের খাবার, খেলনা কিনে থাকে কিংবা বড় ভাই-বোনদের সাথে বেড়াতে চলে যায় শিশু পার্কে। এভাবেই বাংলাদেশ ও আশেপাশের দেশসমূহে ইদে সালামি গ্রহণের রেওয়াজ চলে আসছে।

Rohingya refugees celebrate holiday amid memories of home | PBS NewsHour
শিশুদের উদযাপন। Image Source: PBS

এছাড়াও আজকাল অনলাইনেও সালামি আদান প্রদানের নতুন এক ধরণ দেখা যায়। এমনকি অনলাইন অর্থ আদান প্রদানের মাধ্যম যেমন-বিকাশ,নগদ এই দিনে বিশেষ ক্যাম্পেইন ও অফার দিয়ে থাকে। এর থেকে সালামি নামক বিষয়টির প্রভাব খুব ভালো করেই পরিলক্ষিত হয়।

এই ঈদিয়ার বিষয়টি বাণিজ্যিক বিষয়ে রুপ নিলেও মানুষের মধ্যে সহযোগীতা ও সম্প্রীতির তথ্য দিয়ে চলেছে। বর্তমানে সালামি হিসেবে ইদের দিনে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা হচ্ছে। আগেই বলেছি সালামি যে অর্থের সাথে সম্পৃক্ত এমন কিছু নয়। মানুষকে নতুন কিছু দেওয়া কিংবা ভালো অনুভূতি সৃষ্টি করাও এর মধ্যে পড়ে।

অপরিদকে,সালামির বিষয়টি ভ্রাতৃত্বও গড়ে তুলতে সহায়ক। ডিজিটাল এই যুগে শিশুরা এখন ঘরেই বন্দী। ইদের এই উৎসবের কারণেই মহল্লা বা পাড়া-প্রতিবেশীর শিশুরা একে অপরের সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে পারে যা শহুরে জীবনে নাই বললেই চলে।

How CBeebies explains Eid to kids as children celebrate Eid al-Fitr 2019 - Birmingham Live
দুজন শিশুর ইদ উদযাপন। Image Source: Birmingham live

মুদ্রার উলটো পিঠ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে,অনেকেই সালামিকে নেতিবাচক হিসেবেও দাবি করে থাকে। কারণ শিশুরা আজকাল জড়বাদী দুনিয়া কেন্দ্রিক শিক্ষা পাওয়ায় অর্থের পরিমাণের দিকে চোখ দেয়।

মূলত ঈদিয়ার মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত করা হয় না বলেই এই সমস্যার সৃষ্টি। সালামির মূল লক্ষ্য অর্থ নয় বরং উপহার আদান প্রদানে নিজেকে উপস্থিত রাখাই মুখ্য। ইদের আনন্দকে সবার সাথে ভাগাভাগি না করলে ব্যক্তি উৎসব পালনে ন্যায্যতা হারায়।

অর্থ হোক কিংবা অন্য যেকোন উপহার,সালামি হিসেবে যাই থাকুক না কেন এটি যেন পরবর্তী প্রজন্মকে ‘শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং’ এর বার্তা দেয় তা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পূরণ শুধুমাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তি বা জ্যেষ্ঠরা পালন করবে তা কিন্ত নয়।

বরং বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যারা কিনা এটির মাধ্যমে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে যাতে করে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ ইসলামের মূল শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারে।

 

 

Feature Image: dailysun.com  
References: 

01. How eidiyah – the tradition of giving cash. 
02. Eidiyah: What are the origins of money-giving to celebrate Eid? 
03. Interesting History Behind The Eidiyah. 
04. what do you know about eid feast?