স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গ। শহরের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ক্রামন্ড নামে একটা সৈকত আছে। সেই সৈকতের এক কোণে কয়েকঘর জেলের বাস। সেখানেই হার্পার আর তার ছেলে রেমন্ড থাকে। রেমন্ডের মা নেই। বাবা-ছেলে একসাথে সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। ক্রামন্ডের কাছেই নৌকা নিয়ে মাছ ধরে সবসময়। বেশি দূরে যায় না। কিন্তু এবার বায়না ধরেছে রেমন্ড— একটু দূরে পোর্টোবেলোর সৈকতে যাবে মাছের খোঁজে। হার্পার কী আর করে? শান্ত সমুদ্র দেখে ছেলেকে নিয়ে একদিন রওনা দেয় প্রায় নয় মাইল দূরের পোর্টোবেলোর উদ্দেশ্যে।
পথে গ্রান্টন সৈকত, ব্ল্যাক লাইট পেরিয়ে এসে পাড় ধরে আগাচ্ছিল বাবা-ছেলের নৌকা। এমন সময় ভাঁটা লাগলো সমুদ্রে। নৌকা বাঁধতে গিয়ে রেমন্ড দেখে দূরে কোথা থেকে একটা আলো আসছে লালচে। বাবা জানায় ওটা একটা মৃত আগ্নেয়গিরির চিহ্ন। আরও জানায় ওখানে একটা বিশাল প্রাসাদ এখন। ওই আগ্নেয়গিরির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। রেমন্ড অবাক হয় খুব।
অবাক হওয়ার মতো কথা। আগ্নেয়গিরির ওপর কি একটা গোটা প্রাসাদ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? উত্তর হচ্ছে পারে। রেমন্ডকে অবাক করা সেই মস্তবড় প্রাসাদটি হচ্ছে এডিনবার্গ দুর্গ। একেবারে ওপরের আকাশকে যেন ছুঁতে চায়। আর এর ওপর থেকে এডিনবার্গ শহরকে খুব ভালোভাবে দেখা যায়।
ইতিহাস
৫৫.৯৪৮৬° উত্তর অক্ষাংশ ৩.১৯৯৯° পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ— এই ভৌগোলিক অবস্থানে আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এডিনবার্গ দুর্গের সাথে জড়িয়ে আছে রাজা-রাজড়া, সৈন্যসামন্তের ইতিহাস। এই দুর্গের যে পাহাড়ী ভিত্তি, তাতে খুঁজলে রাজা-রাণী, সৈন্যের পায়ের চিহ্ন তো পাওয়া যাবেই, পাওয়া যাবে ডাকাত-দস্যুর পদচারণাও।
১১০৩ সালে স্কটল্যান্ডের সেইন্ট মার্গারেটের সন্তান রাজা প্রথম ডেভিড ৪৪৩ ফিট উঁচুতে আজকের এডিনবার্গ দুর্গের মূল কাঠামো তৈরি করেছিলেন। এই দুর্গের নিচে আগ্নেয়গিরির যে অবশেষ তাকে ক্যাসল রক বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে পাথুরে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। আগ্নেয়গিরি আগ্নেয় শিলায় পরিণত হয়ে সবশেষে পাথর হিসেবে অবশিষ্ট রয়েছে। ওয়াচ টাওয়ারের সুবিধা থাকায় এডিনবার্গ দুর্গ সেনা সদস্যদের যুদ্ধযজ্ঞে বেশ কাজে এসেছিল অতীতে।
ইতিহাসের কুশীলব যারা
বহু শতাব্দীকাল ধরে রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এডিনবার্গ দুর্গ। এখন দুর্গের যেসব নজরকাড়া স্থাপত্যশৈলী দেখা যায় সেগুলোর কিছু কিছু রাজা প্রথম ডেভিড ১১৩০ সালেই নির্মাণ করিয়েছিলেন।
দুর্গের সবচেয়ে পুরনো ভবনের (দ্য চ্যাপেল) সাথে জড়িয়ে আছে রাণী মার্গারেটের নাম। বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এখনো এখানে হয়। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দ্য চ্যাপেলের ওপর দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ঝড় যায়। কিন্তু তাতেও এই ভবন ধসে পড়েনি। এই ব্যাপারটি দুর্গের ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে বিশেষত্ব যোগ করে।
রাজা চতুর্থ জেমসের সম্মানে দুর্গের গ্রেট হল নির্মিত হয়েছিল। তিনি অবশ্য বেশিদিন ভোগ করে যেতে পারেননি। আবার, রাজা ষষ্ঠ জেমসের জন্ম হয় দুর্গের রয়েল প্যালেসে। তিনি মাত্র তেরো মাস বয়সে স্কটল্যান্ডের রাজত্ব পেয়েছিলেন।
পর্যটকদের জন্য ঘুরে দেখার
আজকের দিনে এডিনবার্গ দুর্গ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সুরক্ষিত এক দুর্গ। আংশিকভাবে সেনাবাহিনীর জন্য সুরক্ষিত হলেও এখন পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটন স্পট এটি।
এডিনবার্গ দুর্গে সকাল-দুপুর-বিকেল ধরে দেড়, দুই অথবা তিন ঘণ্টার প্যাকেজ নিয়ে কিছু স্পট পর্যটকেরা দেখতে পারেন। এগুলোর মধ্যে আছে –
- দি রয়্যাল প্যালেস – দুর্গের ভেতরের রাজকীয় বাসস্থান।
- স্কটিশ ক্রাউন জুয়েল্স অ্যান্ড দি স্টোন অব ডেস্টিনি – প্রিন্স এডওয়ার্ডের স্মৃতি বিজড়িত।
- দি গ্রেট হল – সেকালের অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা।
- স্কটিশ ন্যাশনাল ওয়্যার মিউজিয়াম – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত অজস্র স্কটের স্মৃতির ধারক।
- দি ওয়ান ও’ক্লক স্যালুট – একটা কামান। স্কটিশ সময় প্রতিদিন বেলা একটায় এই কামান দাগা হয়।
- সেইন্ট মার্গারেটস চ্যাপেল – ১১৩০ সালে নির্মিত। সমগ্র স্কটল্যান্ডেরই সবচেয়ে পুরোনো দালান এটি। ছোটোখাটো অনুষ্ঠান এখানে হয় আজকাল।
- মনস মেগ – বিশালাকার কামান। ১৪৫৭ সালে দ্বিতীয় জেম্স্কে এটি উপহার দেন বার্গান্ডির তৎকালীন ডিউক।
পর্যটকদের জন্য খাবার
এখানে যারা আসে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা আছে। রেডকোট ক্যাফেতে ভারী খাবারের ব্যবস্থা যেমন আছে। আছে হালকা খাবারও। আবার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিকেলের দিকে চা খেতে পারেন। দুর্গের একদম ওপরে ক্রাউন স্কয়ার। সেখানে আছে টি রুম। চায়ের সাথে হালকা নাস্তাও মিলবে।
জানেন কি?
- বিস্ফোরণের ভয় নেই। যে আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়ানো এডিনবার্গ দুর্গ, সেটি সর্বশেষ প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে বিস্ফোরিত হয়েছিল। আজকের দিনে ওই আগ্নেয়গিরি মৃত। সুতরাং নিশ্চিন্তে বিচরণ করা যায় দুর্গের ভেতরের স্থানগুলোয়। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত।
- এডিনবার্গ দুর্গে একটা হাতি বাস করতো। ১৮৩৮ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে আসে ৭৮তম হাইল্যান্ডার্স পদাতিক বাহিনী। সাথে করে নিয়ে আসে একটা হাতি। মজার ব্যাপার হচ্ছে হাতিটার মদ্যপানের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। ওর পায়ের আঙুল ন্যাশনাল ওয়ার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
- বিভিন্ন সময়ে প্রায় এক হাজার মানুষ বন্দি থেকেছে এডিনবার্গ দুর্গে। একুশজন ক্যারিবীয় দস্যুকে এখানে বন্দি রেখে একসময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া, আমেরিকার অনেককেই স্কটিশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এখানে বন্দি রাখা হয়েছিল।
- স্কটিশ সেনা সদস্যদের সঙ্গী হিসেবে কুকুর থাকতো সাথে। ডগ স্কোয়াড প্রতিরক্ষায় জরুরি। এরকম কুকুর মারা গেলে সেই সময় ওখানেই সমাধি রচনা করা হয়েছিল। এটা দুর্গে প্রবেশের মূল পথের পাশেই এক কোণে। সবার ওখানে যাবার অনুমতি মেলে না। সাধারণ মানুষ দূর থেকে কেবল ওখানকার ফুলের বাগানটাই দেখতে পায়। কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই।
- এডিনবার্গ দুর্গের মধ্যে ভূত আছে! তবে ভয়ের কিছু নেই। এটা একটা জনশ্রুতির ফল। বলা হয়ে থাকে, দুর্গের ভেতরে অজস্র সংকীর্ণ গলিপথ ছিল। সেই গলিপথের গোলকধাঁধায় যাতে হারিয়ে যেতে না হয় সেজন্য এক তরুণ বাঁশিওয়ালাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার কাজ ছিল বাঁশি বাজানো। তার বাঁশি শুনে অন্ধগলি কোথা থেকে কোথায় যেতে পারে তার একটা ধারণা হতো রক্ষকদের। একসময় বাঁশিওয়ালাকে আর দেখা গেল না কোথাও। তারপর, আজও নাকি বাঁশির সুর ভেসে আসে এডিনবার্গ দুর্গের বাতাসে। রীতিমতো অদ্ভুত! তাই না?
- রবার্ট ব্রুসের কথা মনে আছে? মাকড়সার জাল দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে রাজা রবার্ট ব্রুস? তিনি কিন্তু স্কটিস শাসক ছিলেন। বর্তমানে এডিনবার্গ দুর্গের গভর্নর রবার্ট ব্রুসেরই বংশধর। তার নাম অ্যালিস্টার ব্রুস।
Feature Image: brittanica.com References: 01. 10 Things You Didn't Know About Edinburgh Castle. 02. Edinburgh Castle. 03. Looking for some Edinburgh Castle Facts & History? 04. Visiting Edinburgh Castle: 9 Highlights, Tips & Tours. 05. EDINBURGH CASTLEDEFENDER OF THE NATION.