মাত্র ৪০ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। সেই রহস্যে ঘিরে থাকা অকাল মৃত্যুর আজও কোনো কূলকিনারা হয়নি। মৃত্যুর ঠিক ৫ দিন আগে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ৫ দিন পর যখন তাকে পাওয়া গেল তখন তিনি শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, পুরো শরীর অসাড়! হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষ অবধি তাকে আর বাঁচানো যায়নি। ১৮৪৯ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা রটে বা প্রচার করা হয় তাও বেশ অদ্ভুত। বলা হয় মৃত্যুর কারণ ‘মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক সংকোচন’। ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে আলোচকেরা তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময় হত্যা থেকে শুরু করে রেবিস পর্যন্ত নানান রকম কারণ অনুমান করলেও আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
ইতিহাসে এই মৃত্যু আজো এক রহস্যের অন্ধকূপে নিমজ্জিত! আর এই অতল রহস্যে হারানো মানুষটিকে পৃথিবী চেনে এডগার অ্যালান পো নামে।
বোস্টনে ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেন এই মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক, এডগার অ্যালান পো। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রোমান্টিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা। পারিবারিকসূত্রে এলিজাবেথ আর্নল্ড পো এবং ডেভিড পো জুনিয়র অভিনয়শিল্পী দম্পতির পরিবারে জন্ম নেন অ্যাডগার অ্যালান পো।
সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে উঠা বাবা-মা শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’ থেকে ছেলের নাম রাখেন অ্যাডগার। জন্মের তিন বছরের মাথায় হঠাৎ মা মারা যায় পো’র। তখন চার ভাই-বোনের সংসার। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর বাবা তাকেসহ তার তিন ভাইবোনকে ফেলে রেখে চলে যান।
এরপর জন অ্যালান নামের এক নিঃসন্তান পরিবার পো’কে দত্তক নেন এবং তার অন্যান্য ভাইবোনেরা অন্যান্য জায়গায় থাকতে চলে যায়। ছোটবেলা থেকেই পো লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী ছিলেন। জন অ্যালান চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে তার মতো ব্যবসায়ী হবে।
কিন্তু সংস্কৃতিমনা বাবা-মায়ের বীজ রয়ে গিয়েছিল তার মাঝে। তাই অল্প বয়সেই তিনি ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের বিশেষ ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তার মাঝে লেখক হওয়ার স্বপ্ন জেগে ওঠে।
বৈচিত্র্য আর রহস্যেঘেরা জীবনের অধিকারী এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের সারা জীবন কেটেছে নানা রকম যন্ত্রণা, আর্থিক দৈন্যদশা ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। ১৮২৬ সালে অ্যাডগার অ্যালান পো রিচমন্ড ছেড়ে ভার্জিনিয়া আসেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ায়’ পড়তে।
সেখানে তিনি সম্মুখীন হয় চরম দারিদ্র্যের মুখে। কারণ ভার্জিনিয়ায় থাকতে যে টাকার প্রয়োজন ছিল, জন অ্যালান তাকে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ টাকা দিয়েছিলেন। কাজেই খরচ যোগাতে তিনি শুরু করেন জুয়া খেলা এবং একসময় গিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যান।
কয়েক মাসের মধ্যে তার দারিদ্র্য এমন পর্যায় পৌঁছে যে শীত থেকে বাঁচার জন্য তাকে তার আসবাবপত্র পোড়াতে হয়। ঋণ আর দারিদ্র্যের লজ্জা এবং জন অ্যালানের প্রতি ক্ষোভে পো তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে রিচমন্ড ফিরে আসতে বাধ্য হোন।
কিন্তু সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো হৃদয়বিদারক ঘটনা। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার প্রেমিকা সারাহ (এলমিরা রোস্টার) এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে তিনি আবার বোস্টন চলে আসেন।
তার লেখা গল্প, উপন্যাস এবং কবিতার মাঝে ভৌতিকতা এবং রহস্যের অবতারণায় আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় চলে আসে খুন, উড়তে থাকা রহস্যময় কোনো কাক, আশেপাশে জীবন্ত কবর এবং মৃত্যুর পর ফিরে আসা অদ্ভুত কোনো এক মহিলার ছবি।
নীল চোখ এবং কালো কোট পরা বিষণ্ণ চেহারার এই মানুষটির রহস্যময় মৃত্যু এবং সংগ্রাম ও বিচিত্রতায় ভরা জীবনও পাঠকদের আকৃষ্ট করে সমানভাবে। তার লেখালেখির শুরুটা কৈশোরের উত্তরণকালে।
বিশ বছর বয়স হবার আগেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং ওই সময়ের মধ্যেই তার কিছু কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক ছোটগল্প লিখলেও উপন্যাস লিখেছেন মাত্র একটি—ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম ন্যানটাকিট।
এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৩৮ সালে। পো নিজেই দাবি করেন উপন্যাসটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। কিন্তু তার সমসাময়িক কোনো সমালোচক বা পাঠকরা পো’র এই দাবিকে সত্য বলে মানতে চাননি।
কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে বই প্রকাশের ঠিক ৫ বছর পর, উপন্যাসের ঘটনার মতো একটি হুবুহু জাহাজডুবি ঘটে। এমনকি ওই উপন্যাসের একটি চরিত্রের সঙ্গে বাস্তব ঘটনার একজন নাবিকের নামেরও মিল পাওয়া যায়—রিচার্ড পার্কার। এমনকি পো’র মৃত্যুর পর ১৮৮৪ সালে আরেকটি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে এবং পরবর্তীকালে রিচার্ড পার্কার নামের একজনের মৃত্যু হয় নরখাদকদের হাতে।
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বহু আগে লেখা ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম ন্যানটাকিট–এর রিচার্ড পার্কারের মৃত্যুও হয়েছিল একইভাবে।
সারাজীবন দারিদ্র্য পো’র জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলেছিল। এমনকি দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি যোগ দেন আর্মিতে এবং নিজের নাম বদলে রাখেন অ্যাডগার এ. পেরি। কিন্তু তার সৎ মা মারা যাওয়ার পর জন আল্যান তাকে আর্মি থেকে সরিয়ে এনে ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
Helen, thy beauty is to me
Like those Nicéan barks of yore,
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.
(TO HELEN)
পো সেখান থেকে বের হয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল শুরু করেন, অবশেষে এক সপ্তাহ টানা ড্রিল ক্লাস বাদ দেয়ার ফলে মিলিটারি একাডেমি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। মিলিটারি একাডেমি থেকে বের হয়ে তিনি এবার চলে আসেন নিউইয়র্কে এবং সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। যেখানে রচিত হতে থাকে টু হেলেনের মতো বিখ্যাত সব কবিতা।
১৮৩৩ সালে পোয়ের ‘মিস ফাউন্ড ইন অ্যা বটল’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি ‘বাল্টিমোর উইকলি’ থেকে ৫০ ডলার পুরষ্কারও পায়। ওই বছরেই তিনি রিচমন্ডের ‘সাউদার্ন লিটারেরি মেসেঞ্জার’-এ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন।
আর এই সময়ই পো তার ফুপাতো বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যান, অতঃপর তারা বিয়েও করেন। বিয়ের সময় এডগার অ্যালান পো’র বয়স ছিল ২৭ এবং ভার্জিনিয়ার বয়স ছিল ১৩।
এডগার অ্যালান পো নিজস্ব লেখনীর বৈচিত্র্যের জন্য অতি অল্প সময়েই পাঠক হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। গবেষণামূলকভাবেই তিনিই প্রথম রচনা করেছিলেন বহু ডিটেকটিভ ফিকশন যা পরবতী সময়ে সায়েন্স ফিকশনের প্রচলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। আর অ্যালান পো’ই প্রথম আমেরিকান লেখন যিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
যদিও এর কারণে তাকে প্রথম দিকে কিছুটা আথির্ক অনটনে দিন কাটাতে হয়েছিল। স্ত্রী ভার্জিনিয়ার সাথে পো’র সুখের সংসার থাকলেও চিরচেনা দারিদ্র্য কখনোই পিছু ছাড়েনি তার। কষ্ট ভুলতে তাই একসময় মদ খাওয়া শুরু করেন তিনি এবং এই দোষেই তার চাকরিও চলে যায়।
১৮৩৯ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ‘বার্টনস জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’-এ সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হোন। একই সালেই তার ‘টেলস অফ গ্রোটেক্স অ্যান্ড অ্যারাবস্ক’ বইটিও প্রকাশিত হয়।
১৮৪০ সালে তিনি তার চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং ‘গ্রাহামস লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ থেকে ইতিহাসের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার ইন দ্য রিউ মর্গ’ প্রকাশ করেন। এর তিনবছর পরে ১৮৪৩ সালে তার ‘দ্য গোল্ড বাগ’ গল্পটি ফিলাডেলফিয়ার ‘ডলার নিউজপেপার’ থেকে ১০০ ডলার পুরষ্কার জিতলে এটি তাকে বেশ জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
১৮৪৪ সালে তিনি আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসেন এবং ১৮৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘আমেরিকান রিভিউ’ থেকে তার কালজয়ী কবিতা ‘দ্য র্যাভেন’ প্রকাশিত হয়। দ্য র্যাভেন পোকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বেশকিছু ছোটগল্প এবং আরো কিছু বিখ্যাত লেখা প্রকাশ করেন। ক্রমশ ভৌতিক এবং রহস্য গল্পের জন্য তার খ্যাতি বাড়তে শুরু করে।
কিন্তু সুখ অধরাই থেকে যায় পো’র জীবনে! আবারও এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এই কালজয়ী উপাখ্যানে ঘেরা মানুষটির জীবন! ১৮৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে তিনি যখন শহরের বাইরে ছিলেন, এমন সময় তার স্ত্রী ভার্জিনিয়া টিউবারক্যুলোসিসে মারা যান। বিষাদের গাঢ় রঙে ছেঁয়ে যায় জীবন আবার!
মৃত স্ত্রীর স্মৃতি ভোলার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসেন এবং বাউন্ডুলের মতো বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে প্রভিডেন্স রুধ আইল্যান্ডে তার দেখা হয়ে যায় প্রাক্তন প্রেমিকা সারাহর সাথে। সারাহও তখন বিধবা অবস্থায় ছিলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছিল তার।
সারাহকে পেয়ে তখন পো’র কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। সারাহ তাকে তার আর্থিক এবং মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং একসময় তারা বিয়ের সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশদিন আগে ১৮৪৯ সালের ৭ই অক্টোবর এডগার অ্যালান পোর আকস্মিক মৃত্যু হয়।
এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ভৌতিক এই গল্পে প্লুটো নামে এক কালো বিড়ালের প্রতি গল্পকথকের ভালোবাসা প্রকাশ পায়, যদিও একপর্যায়ে প্লুটোর চোখ উপড়ে ফেলা হয়।
পো’র লেখকজীবনেও বিড়ালের প্রতি অনন্যসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেকোনো কবিতা লেখা শুরু করার আগে পো তার পরম পছন্দের এশীয় বিড়ালটিকে কাঁধে তুলে নিতেন। এরপর লিখে যেতেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।
From the thunder and the storm,
And the cloud that took the form
When the rest of Heaven was blue
Of a demon in my view.
(The Black Cat)
তার মৃত্যুর পর যখন তার শাশুড়িকে যখন মৃত্যু সংবাদটি দেওয়া হয় তিনি বিড়ালটিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান। পো’কে নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ব্যপারটি হলো মৃত্যুও তার লেখালেখি থামাতে পারেনি! ১৮৬০ সালে লিজ্জি ডোটেন নামের একজন মহিলা কবি বেশ কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং তিনি দাবি করেন পো’র প্রেতাত্মা তাকে কবিতাগুলো বলে গিয়েছেন।
এ কথা শোনার পর পো’র বাগদত্তা সারাহ ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তার সাথে থাকতে চলে যান এই ভেবে যে, হয়তো সেই প্রেতাত্মা তার সাথেও যোগাযোগ করবে!
অতল রহস্যেঘেরা এই মানুষটিকে নিয়ে আজও ঠিক একইভাবে অফুরান মানুষের তুমুল আগ্রহ; যার সারাটি জীবন ছিল ব্যথার চাঁদরে আচ্ছাদিত!
Feature Image: Pinterest References: 01. The Final Mysterious Details of Edgar Allan Po. 02. The (Still) Mysterious Death of Edgar Allan Po. 03. How did Edgar Allan Po die? 04. Edgar Allan Po (1809-1849). 05. Edgar Allan Poe's final macabre mystery.
অদ্ভুত এই পৃথিবী এবং অদ্ভুত এখানকার সৃষ্টি
।। অসাধারণ লাগলো লেখাটি।।
অসাধারণ রিভিউ, খুব ভালো লাগলো।
আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখকের উপাখ্যান আরেকজন গুনীর হাত ধরে আমাদেরপ্যারিসের ব্লগে।
বিভোর হয়ে পড়লাম।