ইস্টার আইল্যান্ডের ‘মোয়াই’ মূর্তি

1266
0
Moai Statue
মোয়াই মূর্তি; Image source: The Travel

শত শত বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং সুকৌশল শিল্প-সংস্কৃতিতে ঘেরা চিলির দ্বীপ ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপটিতে মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আদি পলিনেশিয় জাতি রাপা নুইয়ের বাসস্থান। এজন্য এটি রাপা নুই নামেও পরিচিত। দ্বীপটির বিশেষ ধাঁচের তৈরী মোয়াই মূর্তিগুলো দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে ইস্টার আইল্যান্ডে।

গোটা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মোয়াই মূর্তিগুলো। অনন্য এবং ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যের দরুণ মূর্তিগুলো তথা গোটা দ্বীপটি ইউনেস্কো দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। মাথা থেকে কাঁধ, গড়ে ৪ মিটার (১৩ ফুট) লম্বা এবং ১৪ টন ওজনের বিশেষ আকৃতির মূর্তিগুলো তৈরির পেছনের কাহিনী নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত, রয়েছে অস্বচ্ছতা। আসলে পুরো দ্বীপটির ইতিহাস সম্পর্কেই নেই কোনো লিখিত ও সুনির্দিষ্ট তথ্য। আর লোকমুখেও এর প্রাচীন ইতিহাসের পাতাগুলো অস্বচ্ছ ও ঘোলাটে। দ্বীপটিতে মানুষের বসবাস কবে থেকে, সেটাও অস্পষ্ট।

Moai Restricted
মাথা থেকে কাঁধ, গড়ে ৪ মিটার (১৩ ফুট) লম্বা এবং ১৪ টন ওজনের বিশেষ আকৃতির মূর্তি; Image source: CNN

ধারণা করা হয়, ৪০০ থেকে ১২৫০ সালের নাগাদ বা এই সময়ের কোনো এক অংশে রাপা নুই জাতি পলিনেশিয়ার মারকুসেস দ্বীপ থেকে ইস্টার দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। দুটি দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২,২০০ মাইল তথা প্রায় ৩,৬০০ কিলোমিটার। তবে তাদের এই আগমন ঐচ্ছিক ছিলো নাকি অনৈচ্ছিক, কিংবা আসলে কোন কারণে তাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হয়- তা আজ অবধি রহস্যেই ঘিরে রয়েছে। সেই সময়ে নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে স্থায়ী বসবাসের পদ্ধতিটি পরিচিত ছিলো বটে। তবে এত দূরের পথ, তাও আবার বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রা করে ঠিক কোন কারণে বসতি স্থাপন করা হলো, তা ভাবার মতোই বিষয়।

তাই ব্যাপারটিকে রহস্যজনক বলা পুরোপুরি ভুল নয়। শোনা যায়, হোতু মাতু সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি ডিঙি নৌকায় চড়ে এই দ্বীপে তার স্ত্রী এবং কিছু সাথী নিয়ে আসেন। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্রের অভাবে তথ্যটির উপর পুরোপুরি নির্ভর করা চলে না।
রাপা নুই সম্পর্কে এখানে কিছু তথ্য সংযোগ করা যায়। যেমন রাপা নুইয়ের সংস্কৃতি কিছু পলিনেশিয় জাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের ঐতিহ্যগত পোশাক, যেমন- পালক লাগানো পাগড়ি এবং ধুতি প্রায় একই। আর গয়না ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র তৈরি হয় পাথর, কাঠ, ঝিনুক ও প্রবালের।

Rapanookee Vona
রাপা নুইয়ের মানুষজন; Image source: Wikimedia Commons

মোয়াই

এখন রাপা নুই বা ইস্টার দ্বীপের সবচাইতে বড় আকর্ষণ মোয়াই মূর্তিগুলো কথা বলা যাক। দ্বীপটিতে এরকম প্রায় ৯০০টি মূর্তি রয়েছে। পাথরের মূর্তিগুলো আনুমানিক ১,১০০ থেকে ১,৫০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। তবে কালের পরিবর্তনে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় মূর্তিগুলোর অধিকাংশ। ফলে মূর্তিগুলোর মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্তই দৃষ্টিগোচর। এ কারণে অনেকেই মনে করতেন বা করেন যে, এগুলোর অস্তিত্বও এতটুকুই। কিন্তু ইউসিএএল-এর একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ এ বিষয়ে গবেষণা করে তথ্যগুলো তুলে ধরেন। গবেষণার স্বার্থে এবং নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার তাগিদে গবেষকদের এই দলটি কিছু মূর্তি খুঁড়ে তাদের পুরো শরীরের অস্তিত্ব খুঁজে বের করেন।

Moai Statue
মোয়াই মূর্তি; Image source: The Travel

মোয়াই দিয়ে কী বোঝানো হয়?

মোয়াই মূর্তিগুলো রাপা নুইদেরই পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি বলে ভাবা হয়। ধারণা করা হয়, তাদের সর্দার এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এসবের নির্মাণ। মূর্তিগুলো নির্মাণের পর বসানো হয়েছিল ‘আহু’ নামে পাথরের প্লাটফর্মের উপর। ইস্টার আইল্যান্ডে এই আহুর সংখ্যা ৩০০-এরও বেশি। সাধারণত মিঠা পানির কাছেই মিলে এসব আহু। একই ধাঁচের পাথরের মূর্তি হওয়া সত্ত্বেও এদের চেহারা বা আনুষঙ্গিক আকার-আকৃতিতে কেন ভিন্নতা রয়েছে, সে প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে।

আসলে ইচ্ছে করেই এটি করা হয়েছে। কারণ রাপা নুইয়ের মানুষজন চেয়েছিলেন, যার জন্য মোয়াই বানানো হচ্ছে, তার সাথে যেন কিছুটা সামঞ্জস্য থাকে। আর এর ফলেই মূর্তিগুলো ভিন্ন ভিন্ন।

Rano Raraku Panorama
রানো রারাকু আগ্নেয়গিরি; Image source: Wikimedia Commons

বেশিরভাগ মোয়াই নির্মাণ করা হয় রানো রারাকু আগ্নেয়গিরির কাছে। কারণ, এ স্থানে চুনাপাথরের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। আর এগুলো খোদাই করে মূর্তি বানানোও ছিল সহজ। তাছাড়া সেই সময় মূর্তি তৈরির জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। শুধুমাত্র ‘তোকি’ নামক একটি টুল বা যন্ত্রই ব্যবহার হতো। তাই চুনাপাথর দিয়েই কাজ করা সুবিধাজনক ছিল।

ধারণা করা হয়, এ ধরনের মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণে অভিজ্ঞ এমন একটি দলের কাছ থেকেই কেনা হয় বা তৈরি করে নেওয়া হয় মোয়াইগুলো। যারা এসব মূর্তি কিনে নেন, তারা তাদের কাছে যে দ্রব্য বেশি পরিমাণে থাকত, সেটি দিয়ে বিনিময়ের কাজটা সেরে নিতেন। মিষ্টি আলু, মুরগি, কলা, মাদুর এবং অবসিডিয়ান জিনিস দিয়ে বিনিময় করা হতো। যত বড় মূর্তি, তত বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য দেওয়া হতো আরো বেশি দ্রব্য। এটি মূর্তিগুলো তৈরির দক্ষতা ও কষ্টের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার একটি পদ্ধতি ছিল।

মোয়াইয়ের দশা

১৭২২ সালে প্রথমবার জাহাজে করে ইউরোপিয়ানদের আগমন এই দ্বীপে ঘটলে তারাও মূর্তিগুলোকে অক্ষত অবস্থায় দেখে। কিন্তু এর পরে যারা আসে, তাদের বিবরণ হতে জানা যায়- যত সময় যাচ্ছিল, তত বেশি মূর্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯ শতক শেষ হতে হতে প্রায় সব মূর্তিরই করুণ দশা। অনেকে বলেন যে, হয়তো কোনো যুদ্ধ বা দ্বন্দ্বের কারণে শত্রুপক্ষ মোয়াই ধ্বংস করে রাপা নুইয়ের সংস্কৃতি নষ্ট করতে চেয়েছিল। সেক্ষেত্রে তো মূর্তিগুলোকে মাটি থেকে উঠিয়ে বের করে দেওয়ার কথা বা ভেঙে ফেলার কথা। কিন্তু মোয়াই তো আরো মাটির গভীরে চলে গিয়েছে! লোকমুখে শোনা যায়, নুহাইন পিকা ‘উরি নামে এক নারী ক্ষোভে তার ‘মানা’ শক্তি ব্যবহার করে মোয়াই মূর্তিগুলোর এই দশা করেন। ইস্টার আইল্যান্ডের স্থানীয় লোকজন এখনো এ গল্পেই বিশ্বাসী।

স্পর্শ নিষিদ্ধ

পর্যটকদের জন্য মোয়াই স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। এ নিয়ম ভঙ্গ করলে পর্যটক হিসেবে আপনি সহজে ছাড় পাবেন না। গুণতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা।

Moai
পর্যটকদের জন্য মোয়াই স্পর্শ করা নিষিদ্ধ; Image source: Hive Miner

একবার এক পর্যটক এ নিয়ম ভঙ্গ করে মোয়াই স্পর্শ করলে এবং এর কানের লতি ভেঙে স্যুভেনির হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ১৭ হাজার ডলারের জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়। দিন দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এসব মোয়াই মূর্তি। তাছাড়া, পর্যটকদের কারণে এ ক্ষতির প্রক্রিয়াটি আরো দ্রুতগামী হয়ে গিয়েছে। তাই মোয়াই রক্ষার্থে আইনও বেশ কঠোর করা হয়েছে।

Moai Statue
পর্যটকদের কারণে এই ক্ষতির প্রক্রিয়াটি আরো দ্রুতগামী হয়ে গিয়েছে; Image source: Island Heritage

কীভাবে এবং কখন যাবেন?

শুধুমাত্র ল্যান এয়ারলাইনসের মাধ্যমে এই দ্বীপে যাওয়া সম্ভব। প্রতিদিন মাত্র একটি ফ্লাইট চিলির স্যান্টিয়েগো থেকে ইস্টার আইল্যান্ডে যায়। জায়গাটি সুন্দর হলেও সেখানে যাওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। অতীতে সেখানে কীভাবে মানুষজন কষ্ট করে যেত, তা ভাবার মতো বিষয়। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের সময়টা রাপা নুই বা এ দ্বীপে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত। শীতকালে এখানে অনেক সময় অতিরিক্ত শীত পড়লেও সারা বছর গড়ে সর্বাধিক ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে।

তাই আবহাওয়া কখনই পুরোপুরি প্রতিকূলে থাকে না। দ্বীপটিতে আসার পর গাড়ি, মোটর সাইকেল বা বাইক ভাড়া করে দ্বীপটির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘুরে আসা যাবে। বেশিরভাগ পর্যটক রাপা নুইয়ের সংস্কৃতি দেখতে এই দ্বীপে আসলেও এখানে ডাইভিং, সার্ফিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। আরাম ও আনন্দে সময় কাটানোর জন্য অনেকেই এখানে আসেন।

লেখাঃ Jinat Jahan Khan | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা