১৭২২ সালের ৫ এপ্রিল। জ্যাকব রগাভেন নামক ডাচ বংশোদ্ভূত এক ইউরোপীয় পরিব্রাজক গা ছমছমে এক দৃশ্যের সাক্ষী হন। ডেভিস আইল্যান্ড (ডেভিডস আইল্যান্ড) খুঁজতে খুঁজতে পথভ্রষ্ট হয়ে তিনি অদ্ভুত একটি দ্বীপে এসে পৌঁছান। দ্বীপটিতে নোঙ্গর ফেলতেই তিনি দেখেন, নিঝুম দ্বীপটির কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালাকার কয়েকটি মূর্তি।
এশিয়া প্যাসিফিকের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চিলির অন্তর্বর্তী পলিনেশিয় অঞ্চলে রয়েছে ত্রিকোণাকার এই নিঝুম দ্বীপ; যা সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রাকৃতিকভাবে উঠে আসা অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট কোন দ্বীপ নয়; বরং ১০,০০০ বছর পূর্বে সমুদ্রের পানি কমে যাওয়ার ফলে বেরিয়ে আসা ছোট্ট এক পাহাড়ী অঞ্চল। দ্বীপটির নাম ইস্টার আইল্যান্ড। চিলির ৩৫৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপের একটি স্প্যানিশ নামও রয়েছে, Isla de Pascua; যার অর্থও অবশ্য ইস্টার আইল্যান্ড।
পলিনেশিয় ভাষায় এই দ্বীপের আরো একটি নাম আছে; তা হলো, রাপা নুই (Rapa Nui)। এই শব্দের অর্থ হচ্ছে, বড় রাপা অর্থাৎ বড় ইস্টার। ইস্টার সানডে খ্রিষ্টানদের বড় ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। মজার ব্যাপার হলো, জ্যাকব যেইদিন এই দ্বীপটি আবিষ্কার করেন সেই দিনটা ছিল ইস্টার সানডে। তাই তিনি এই আইল্যান্ডের নাম দেন, Paasch-Eyland.
যেহেতু, দ্বীপটি ইস্টার সানডের দিন আবিষ্কৃত হয় তাই একে ইস্টার আইল্যান্ড বা বড় রাপা বলা হয়। কিন্তু একটা দ্বীপ নিয়ে এতকিছু বলার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। আর সেটা ইতিমধ্যেই বুদ্ধিমান পাঠক ধরতে পেরেছেন। চলুন আজ আপনাদের নিয়ে যায় ইস্টার আইল্যান্ড দ্বীপ আর সেই দ্বীপের রহস্যের গহিনে।
ইস্টার আইল্যান্ড
১৯৯৫ সালে ইউনেস্কোর কাছ থেকে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অনুমোদন পাওয়া চিলির ইস্টার আইল্যান্ডের সবচেয়ে নিকটবর্তী বসবাসযোগ্য দ্বীপ, পিটকেয়ার্ন আইল্যান্ড। দ্বীপ দুইটির মধ্যবর্তী দূরত্ব ২০৭৫ কিলোমিটার। এবং ইস্টার আইল্যান্ডের সবচেয়ে কাছের শহর, মাঙ্গারেভা আইল্যান্ড। রাপা নুই থেকে এর দুরত্ব ২৬০৬ কিলোমিটার।
জন্মলগ্ন থেকে ইস্টার আইল্যান্ড ত্রিকোণাকার ছিল না। কালের বিবর্তনে এখানে তিনটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে। অগ্নুৎপাতের লাভাগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে রূপ নেয় চুনাপাথরে এবং দ্বীপটিকে ত্রিকোণাকৃতি দেয়।
এই দ্বীপে সবসময় ক্রান্তীয় আবহাওয়া বিরাজ করে। এখানে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত গরমকাল এবং জুন থেকে আগস্ট মাস যাবত শীতকাল থাকে। রাপা নুইয়ে জুন-জুলাই ভারী বর্ষণ ও সেপ্টেম্বর শুষ্ক মৌসুমের মাস হলেও এখানে কখনও ঘূর্ণিঝড় বা খড়া হতে দেখা যায় না।
রাপা নুই অধিবাসী
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে জানা যায়, ৭০০ সাল থেকে ১১০০ সালের মধ্যে গহীন এই দ্বীপে অনেক মানুষের বসবাস ছিল। তাদের ছিল একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজের মানুষেরা মিষ্টি আলু চাষ, মুরগী লালনপালন এবং উপকূলীয় মাছ ধরে জীবন ধারণ করতো।
কিন্তু, জ্যাকব সেই একই ইস্টার আইল্যান্ডে গিয়ে পেয়েছিল ৮৮৭ টি বৃহদাকার মূর্তি। যার মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক আধা ভাঙা অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ কোন মূর্তির ধর আছে, তো কোনটার মাথা ভাঙা, আবার কোন কোনটার চোখ ভোঁতা। আগ্নেয়গিরির কারণে প্রাপ্ত শিলা খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে মূর্তিগুলো। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয়, মোয়াই। হাজার হাজার বছর আগে এই দ্বীপে যারা বাস করতো, তারা হয়তো শখের বসে, নয়তো কোন সামাজিক বা ধর্মীয় প্রথার কারণে বানিয়েছিল এই মোয়াই মূর্তিগুলো।
কিছু কিছু মোয়াই মূর্তির মাথায় লাল রঙের টুপি দেখা যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন, এই লাল রঙের টুপি অন্য একটা লাভার শিলা রূপ। অর্থাৎ মোয়াইয়ের দেহ এক শিলা দিয়ে তৈরি এবং টুপি আরেক শিলা দিয়ে তৈরি। কিন্তু একই মূর্তিতে দুইটি ভিন্ন শিলা কিভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলো, বর্তমানে তাই নিয়েই গবেষণা চলছে।
ইস্টার আইল্যান্ডে নেমেই জ্যাকব তার সঙ্গীদের সাহায্যে আগুন লাগিয়ে দেন দ্বীপে। এই অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারায় ১২ জন আদিবাসী। আহত হয় আরো অনেকে। তবে জ্যাকব ইচ্ছাকৃত এই হত্যাকাণ্ড চালায়নি; নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝির কারণে এমনটা ঘটে। ইস্টার আইল্যান্ড আবিষ্কারের পরে সান লরেঞ্জো এবং সান্তা রোজালিয়া নামক দুইটি স্প্যানিশ জাহাজ নোঙ্গর ফেলে এই দ্বীপে। তারাও দেখে তীরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো মোয়াই মূর্তি।
১৭৭০ সালে পেরুর স্প্যানিশ গভর্নর দ্বীপটি পরিদর্শনে এসে ৪ দিন থাকেন সেখানে। তিনি দেখেন, দ্বীপের জনসংখ্যা ১৫,০০০ থেকে ৩০০০ জনে নেমে এসেছে। অধিকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জনগণের বাসস্থানের যোগান দিতে ইস্টার আইল্যান্ডের অনেক গাছপালা কাটতে হয়েছিল। সেই সাথে উৎপাত বেড়েছিল পলিনেশিয় ইঁদুরের। তাই অনেকেই দ্বীপ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। গভর্নর আরও আবিষ্কার করেন, রাপা নুইয়ের আদিবাসীদের একটি স্থানীয় পাণ্ডুলিপি আছে। এরা সেই ভাষাতেই কথা বলে।
এরপর ১৭৭৪ সালে জেমস কুক নামক এক ভ্রমণকারী যখন এই দ্বীপ পরিদর্শনে আসেন তখন দেখেন দ্বীপের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছে। অধিবাসীর সংখ্যা নেমে এসেছে ৬০০-৭০০ জনে, যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩০ জনেরও কম। তিনি আরও দেখেন, দ্বীপের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিগুলোর অনেকাংশই মাটিতে পড়ে আছে। অতঃপর ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ জাহাজ এইচএমএস ব্লসম এসে দেখেন সব মূর্তিই মাটিতে পড়ে গেছে। হয়ত একারণেই উনিশ শতকে ইস্টারবাসীরা সহজে কোন ভ্রমণকারীকে দ্বীপে প্রবেশ করতে দিতো না। ভ্রমণকারীরা প্রবেশ করতে চাইলে তাদের আক্রমণ করতো।
১৮৬২ সালে পেরুভীয় দাস ব্যবসায়ীরা রাপা নুইয়ে আক্রমণ করে ১৫০০ জন অধিবাসীকে বন্দি করে নিয়ে যায়। এরপর আসলো জলবসন্ত। এ ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হানা দিলো ধনুষ্টংকার; যা রাপা নুইয়ের জনসংখ্যা হ্রাসের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করলো। এবং ১৮৭৭ সালে ইস্টার আইল্যান্ডের জনসংখ্যা এসে দাঁড়ালো মাত্র ১১১ জনে।
ধর্ম
১৮৬০ সাল থেকে ইস্টার আইল্যান্ডে মিশনারি ধর্মযাজকরা আসতে শুরু করেন। তারাই এই আদিবাসী সমাজের বর্ণপ্রথা দূর করেন। খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরুদের শাসনের পূর্বে রাপা নুইয়ে ছিল আরিকির (প্রধান) শাসন। ইস্টারবাসীদের আরিকি বাছাই করার নিয়মটা ছিল একটু ভিন্ন। আরিকি হতে হলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা খুব জরুরি ছিল তা হলো, দ্বীপের পৌরাণিক প্রতিষ্ঠাতা হতুমাতুয়া-র বংশধরের প্রথম সন্তান হতে হবে। একজন আরিকি নয় গোত্র শাসন করার ক্ষমতা রাখতো।
পৌরাণিক ধর্ম মতে, মোয়াইগুলোকে তাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে দাবী করা হতো। ধারণা করা হয়, লাল টুপিওয়ালা মোয়াইগুলো তাদের প্রধানদের প্রতিকৃতি।
যদিও রাপা নুইয়ের স্থানীয়রা এখনও পুরনো ধর্মই মেনে চলে। তাদের পৌরাণিক চরিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মাকেমাকে নামক এক দেবতা। যাকে খুশি করার জন্য আগে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। এই প্রথা মতে, রাপা নুইবাসীদের একজন গুহা রক্ষক রয়েছে, যাকে আকুয়াকু বলা হয়। এবং তারা গুহাতে প্রবেশের সময় একটি মন্ত্র পাঠ করে থাকে,
হেকাই ইতে উমু পারে হাওঙ্গা তাকাপু হানাউ এপে কাই নরুয়েগো।
ভাষা
জেমস কুকের সাথে ইস্টার আইল্যান্ডে আসা ক্রুদের একজন পলিনেশিয় ছিলেন যিনি মাঙ্গারোভা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এই ক্রু-ই প্রথম রাপা নুইদের সাথে কথা বলতে পারেন। কেননা তার সাথে ইস্টার আইল্যান্ডের ৮০ ভাগ অধিবাসীর ভাষা মিলে যায়। এর আগে কেউ ইস্টার আইল্যান্ডের ভাষা জানত না তাই তাদের সাথে কথা বলতে পারতো না।
রাপা নুইবাসী মাঙ্গারোভা ভাষাতে কথা বললেও তাদের পূর্বপুরুষ কিন্তু সেই ভাষাতে কথা বলত না। ইস্টার আইল্যান্ডের আদিবাসীরা কথা বলত রঙ্গরঙ্গ নামক একটি ভাষাতে। রঙ্গরঙ্গ ভাষা ছবি ও জ্যামিতিক আকৃতির সমন্বয়; যা মোয়াইয়ে পেট্রোগ্লিফ (পাথরের গায়ে খোদায় লেখা) হিসেবে পাওয়া যায়। এছাড়াও এদের গুহাগুলোতে থাকা বিভিন্ন পেট্রোগ্লিফের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
বর্তমান ইস্টার আইল্যান্ড
১৮৮৮ সালে ইস্টার আইল্যান্ড চিলির অধিভুক্ত হয়। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত উইলিয়াম-ব্যালফোর কোম্পানি ভেড়ার ফার্ম হিসেবে দ্বীপটির একটি অংশ ব্যবহার করে। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে চিলি সরকার চিলি নেভিকে এ দ্বীপের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন এবং রাপা নুইবাসীকে চিলির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বর্তমানে ইস্টার আইল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় ৫০০০ জন; যার ৬০ ভাগ রাপা নুইয়ের বংশধর। বর্তমানে জীবন ধারণের জন্য এদের খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে উপার্জিত টাকা দিয়েই জীবন ধারণ করে রাপা নুইবাসীরা।
ইস্টার আইল্যান্ড এখন আর মোটেও দুর্গম এলাকা নয়। এখানে ঘুরতে যেতে আপনাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে না। মাতাভেরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেট বিমান সার্ভিস আছে, বোয়িং ৭৬৭ এবং বোয়িং ৭৮৭ যা শুধুমাত্র পর্যটকদের রাপা নুইয়ে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে ব্যবহৃত হয়।