সে অনেক বছর আগের কথা। এক সমুদ্রের মধ্যে ছিল এক শহর। শহরটি এত বেশি সমৃদ্ধ যে তাতে ছিল প্রায় নব্বই হাজার প্রাসাদ, যার সবগুলোই সোনা, হীরা, পান্না দিয়ে তৈরি। বন্দর, অর্থ, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য – কী ছিল না সেই শহরের! আর থাকবে না-ই বা কেন? এ তো সাধারণ শহর নয়। এ যে স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণের শহর। যে শহরে লড়াই হয়েছিল কৃষ্ণের সাথে রাজা সালভার। একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করে টিকে থাকা যে শহর ধ্বংস হয়ে যায় কৃষ্ণের মৃত্যুর সাথে সাথে।
সেই শহরের নাম আজো অনেকের মুখে মুখে প্রচলিত। কিন্তু সেই শহর সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য। এমন এক শহরের উত্থান এবং পতন নিয়েই আজকের আলোচনা।
শহরটির নাম ‘দ্বারকা।’ যে শব্দের অর্থ ‘স্বর্গের দ্বার।’ ধরা হয়, প্রায় ৯,০০০ বছর আগে দ্বারকার অস্তিত্ব ছিল। মহাভারত, ভগবত গীতা, বিষ্ণু পুরাণে দ্বারকা শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রী কৃষ্ণ এই শহরটি ভারতের গুজরাটে সমুদ্রের মধ্যে তৈরি করেন, যা তাঁর মৃত্যুর সাথে সেই সমুদ্রেই ডুবে যায়। এই শহরটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ পবিত্র স্থান।
‘সপ্তপুরী’ নামে পরিচিত ভারতের সাতটি প্রাচীনতম শহরের মধ্যে দ্বারকা হচ্ছে একটি। বর্তমানে পরিচিত ‘দ্বারকা’ ভারতের গুজরাট প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এর অবস্থান কচ্ছ উপসাগরের মুখে, ওখামন্ডল উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে এবং গোমতী নদীর ডান তীরে। দ্বারকা হিন্দুদের পবিত্র ‘চারধাম’ অর্থাৎ চারটি প্রধান তীর্থস্থানের একটি। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে এখানে দ্বারকাধীশ মন্দির নির্মিত হয়।
শ্রী কৃষ্ণ দ্বারকা নির্মাণ করেছিলেন মথুরাকে রক্ষার জন্য। কৃষ্ণ তার মামা অত্যাচারী রাজা কংসকে হত্যা করেন। এতে কংসের শ্বশুর মগধের রাজা জরাসন্ধ রেগে যান এবং মথুরা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের বাহিনীকে পরাজিত করলেও জরাসন্ধ থেমে থাকেননি। তিনি একের পর এক সতেরো বার মথুরা আক্রমণ করেন।
তবে প্রতিবারই কৃষ্ণের কাছে হার মানতে হয় তার। যদিও সকল আক্রমণই কৃষ্ণ প্রতিহত করতে সক্ষম হোন, তবুও তার মনে হয় মথুরা আর আক্রমণ নেওয়ার মতো অবস্থাতে নেই। তাই, কৃষ্ণ মথুরা এবং সেখানে বসবাসরত যদুবংশীয়দের রক্ষার জন্য মথুরা ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
নতুন শহর নির্মাণের জন্য কৃষ্ণ বিশ্বকর্মার সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে বলেন, সমুদ্রদেব যদি সমুদ্র হতে জমি দান করেন তাহলে শহর নির্মাণ সম্ভব। কৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন, যাতে সন্তুষ্ট হয়ে সমুদ্রদেব ১২ যোজন জমি প্রদান করেন। বিশ্বকর্মা তার অসামান্য নির্মাণশৈলি দেখিয়ে এই জমিতে গড়ে তুলেন দ্বারকা শহর। এই দ্বারকাই হয়ে উঠে কৃষ্ণের নতুন বাসস্থান।
দ্বারকা ছিল একটি সুপরিকল্পিত শহর। প্রযুক্তি এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধাতে বেশ অগ্রসর ছিল এই নগর। শহরটি ছিল সাগরবেষ্টিত। একটি সেতু এবং প্রবেশ দ্বারের মাধ্যমে মূল ভুখন্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এছাড়া ছিল ছয়টি অংশে বিভক্ত।
আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বন্দর, উদ্যান, বিস্তৃত রাস্তা, প্রাসাদ, সুউচ্চ দালান, শস্যভরা জমি-সব মিলিয়ে শ্রী কৃষ্ণের এই শহর ছিল সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ‘সুধামস্ত’ নামক একটি সভাকক্ষের নিদর্শনও পাওয়া যায় ইতিহাস ঘেটে।
এই শহরেই হয় শ্রী কৃষ্ণ এবং রাজা সালভার যুদ্ধ হয়েছিল। রাজা সালভা শ্রী কৃষ্ণকে হত্যা এবং দ্বারকাকে ধ্বংসের জন্য গভীর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সেই অনুযায়ী ব্যাপক শক্তিশালী অস্ত্র এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে দ্বারকা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে রাজা সালভা একটি উড়ন্ত যন্ত্র ব্যবহার করেন, যা দ্বারকার ভয়ংকর ক্ষতিসাধন করেছিল।
উক্ত যন্ত্রটি এতই উন্নত ছিল যে তা বাতাসে উড়তে পারতো, পানিতে ভাসতে পারতো এবং শত্রুর কাছে অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারতো। বহু বীর যোদ্ধা এই যন্ত্রের কবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলেন।
পরিস্থিতি এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে সালভাকে ধ্বংসের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্রটিই ব্যবহারের কথা হচ্ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি কারণ এই অস্ত্র ব্যবহারে কেবল সালভা নয়, বরং সেখানে উপস্থিত কোনো মানুষই রক্ষা পেতেন না।
এমন অবস্থায় শ্রী কৃষ্ণ তার বাহন দিয়ে অসুর রাজাকে ধাওয়া করেন। সালভা কৃষ্ণের উপর সকল ধরণের ভয়ংকর অস্ত্র একটানা নিক্ষেপ করতে থাকে। এর বর্ণনা মহাভারতে এমনভাবে এসেছে যে,
‘আকাশে…মনে হচ্ছিল একশো সূর্য, একশো চাঁদ…
আর একশো হাজার তারা।’
এমন অত্যন্ত জটিল আক্রমণ শ্রী কৃষ্ণ প্রতিহত করেন এবং ভয়ংকর এক যুদ্ধের মাধ্যমে অত্যাচারী রাজা সালভাকে পরাজিত করেন। এভাবে শ্রী কৃষ্ণের জীবনে দ্বারকা এক অসীম সাহসিকতার প্রতীক হয়ে রয়েছে। দ্বারকাতে শ্রী কৃষ্ণ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। তার মৃত্যুর পর এই শহর হারিয়ে যায় সাগরের অতলে।
দ্বারকার অস্তিত্ব নিয়ে হাজার বছর ধরে চলে এসেছে বিতর্ক। ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক গুরুত্বের কারণে দ্বারকা নৃতাত্ত্বিকবিদদের আকর্ষণের প্রিয় কেন্দ্র। শহরটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার উদ্দেশ্যে আরব সাগরের তলদেশে বহু অনুসন্ধান চালানো হয়।
১৯৩০ সালে অনুসন্ধানের মাধ্যমে এর একটি আনুমানিক সন্ধান নিশ্চিত করা হয়। এরপর অনেক বছর ধরে আর অগ্রগতি হয়নি। ১৯৬৩ সালে সমুদ্রতলে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরও আরো বেশ কিছু খনন চালানো হয় যার ফলে প্রায় পাঁচশো এর মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।
দ্বারকার সত্যতা প্রমাণে জোর প্রমাণস্বরূপ ২০০২ সালে সমুদ্রের তলদেশে এক অত্যন্ত উন্নত সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়। হারিয়ে যাওয়া শহরটি ভারতের পশ্চিম উপকূলে কচ্ছ উপসাগরে ১২০ ফুট পানির নিচে পাওয়া যায়। শহরের মোট দৈর্ঘ্য ৭-৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩-৪ কিলোমিটার। কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে জানা যায়, শহরটির বয়স ৭০০০-৯৫০০ বছরের মধ্যে।
বিজ্ঞানীরা দ্বারকাকে দু’টি অংশে ভাগ করেন। এর মধ্যে একটি অংশ সমুদ্র পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত। গবেষণা অনুসারে, এই অংশটি মূল দ্বারকা থেকে পরে সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। তূলনামূলক সমুদ্রতীরের কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে সাম্প্রতিক নির্মাণের চিহ্ন পাওয়া যায়, যা হরপ্পা সভ্যতার শেষের দিকের অর্থাৎ ৩৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বলে পরীক্ষায় পাওয়া যায়।
এই অংশটি ছিল মূলতে শ্রী কৃষ্ণ এবং তার পরিবারের বাসস্থান। অন্য অংশ অর্থাৎ যেখানে থেকে শ্রী কৃষ্ণ এই রাজ্য পরিচালনা করতেন, তা ফিরে যায় নয় হাজার বছর পূর্বেই। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এস. আর. রাওকে যখন প্রশ্ন করা হয়, এটিই কি শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকা, তার উত্তর ছিল,
“শুধু নামের বোর্ডটিই অনুপস্থিত।”
দ্বারকা নিয়ে গবেষণায় বিশাল বড় বড় পাথরের কাঠামো আবিষ্কৃত হয়। অত্যন্ত সুবিন্যস্ত স্থাপত্য কাঠামো, রাস্তার কাঠামো, পাথরের নোঙর এবং সভ্যতার আরো বহু তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন উন্মুক্ত হয়। নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, হারিয়ে যাওয়া এই শহর প্রযুক্তির দিক দিয়ে অত্যন্ত উন্নত ছিল। স্থাপত্যশিল্প এবং নকশার ভিত্তিতে এই শহর ছিল অনন্য।
৫৫০ মিটারের সুদীর্ঘ একটি মানবসৃষ্ট দেয়ালও এই সভ্যতার অংশ হিসেবে আবিষ্কৃত হয়। দ্বারকার অপর একটি নাম ছিল ‘শঙ্খধারা।’
আশ্চর্যের বিষয় হলো, গবেষণায় পাওয়া শহর থেকে শঙ্খনির্মিত বহু বস্তু পাওয়া যায়। এছাড়াও, তামার ঘন্টা, পাত্র, মাটির পাত্র ইত্যাদির আবিষ্কার এই সভ্যতার ধর্মীয় ইতিহাসের ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
শ্রী কৃষ্ণ যে শহর সমুদ্র থেকে তৈরি করেছেন, সেই শহর আজ সমুদ্রের বহু গভীরে এক ঐশ্বর্যপূর্ণ শহরের নিদর্শন হয়ে পড়ে রয়েছে। ভাঙাগড়ার বহু ইতিহাসের পর আজ যে দ্বারকা গুজরাটে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতিতে সরব।
শ্রী কৃষ্ণের পূজায় মশগুল হয়ে উঠা মন হয়তো এখানে হাজার হাজার বছর আগের শ্রী কৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ খুঁজে ফিরেন। কেবল আফসোসের বিষয় এই যে, বর্তমানে এই অঞ্চলটি নিয়ে গবেষণায় আর অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
Feature Image: flynote.com References: 01. Dwarka – Pre-Harappan City That Could Rewrite The History Of The World. 02. Where Mythology Meets Reality: Sunken City Of Dwarka. 03. Submerged Ports and Towns, Dwarka Explorations.