ড্রাকুলা: ট্রানসিলভেনিয়ার অতিপ্রাকৃত এক শক্তির গল্প

374
0

ধরা যাক, কাজের খাতিরে আপনাকে এক নতুন জায়গায় যেতে হলো। নিজের শহর থেকে বহু ক্রোশ দূরে। যাওয়ার পথে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হলেন। আশেপাশের সবাই আপনাকে সেখানে যেতে মানা করছে বারবার। কিন্তু তবুও কাজের তাগিদে আপনাকে সামনে যেতেই হবে। 

পথিমধ্যে একজন আপনার হাতে ধরিয়ে দিল একটা ক্রুশ। সবাই হাত তুলে দোয়া করছেন আপনার জন্য। কারণ সামনে আছে সমূহ বিপদ। তবু সবার কথা কানেই না তুলে আপনি এগিয়ে গেলেন, কাজকে ভালোবেসে। আর এরপর আপনার জীবনে নেমে এলো আঁধার! কী করবেন তখন? 

আজকের আলোচনা ট্রানসিলভেনিয়ার কাউন্ট ড্রাকুলাকে নিয়ে। ব্রাম স্টোকারের লেখা বহুল জনপ্রিয় এই বইটি এবং এর কিছু চরিত্র নিয়েই আজকের আলোচনা। চার শতাধিক পৃষ্ঠার বই নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা বেশ কষ্টকর, তবু একটা ছোট পরিসরে আলোচনা আর আয়োজনের প্রচেষ্টা বলা চলে। 

ড্রাকুলা (Dracula)  

ড্রাকুলা শব্দের অর্থ হিসেবে শয়তানের আরেক রূপ প্রতিপন্ন করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কাউন্ট, ড্রাকুলা নিজের সবকিছু গুছিয়ে ইংল্যান্ডে নিজের আবাস গড়েন। তার চাই পুরাতন বিশাল বাংলো বাড়ি, যেখানে থাকবে ব্যক্তিগত কবরস্থান। এত বড় বাড়ি বা কবরস্থান কেন দরকার কাউন্টের? 

নির্বান্ধব পুরীতে জোনাথনের সাথে কাউন্ট ব্যতীত আর কারো দেখা মেলে না, সব কাজ কী একা করেন কাউন্ট? মিনা ম্যুরে, জোনাথনের হবু স্ত্রী আর তার বান্ধবী লিসা। বেড়াতে গিয়ে এক ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হলেন, দিনকে দিন লিসা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, ডাক্তার-বৈদ্য সবই ব্যর্থ। 

রক্তশুন্য-ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে সে, কোন ওষুধে কাজ দিচ্ছে না। এভাবে চলতে চলতে রক্তহীন হয়ে পড়েছে সে। লিসার বাগদত্ত নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। রক্ত দেবার পর ভালো হলেও কিছু সময় পর আবার যেই-কে-সেই। এদিকে পাগলা গারদে দেখা মিলছে এক অদ্ভুত রোগীর, যে কিনা সব জ্যান্ত প্রাণী খেয়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করেনা। কে সেই রোগী? 

Dracula
কাউন্ট ড্রাকুলার কল্পিত রূপ।  Image Sources: pixabay

এদিকে জোনাথন আটকা পড়েছে টানসিলভেনিয়ার প্রাসাদে। বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। এমনকি চিঠিও লিখতে হচ্ছে কাউন্টের কথায়। অন্যদিকে, লিসা মরণাপন্ন, জোনাথন পুরো নিখোঁজ, আর মিনা যেন অকূল পাথারে। মিনা জানতে পারল, জোনাথন হাসপাতালে ভর্তি, ছুটে গেল সে। হাসপাতালে তড়িঘড়ি বিয়েও সেরে ফেলল। 

এরপর লিসা মারা গেল, মারা যাবার আগের সব কথা শুনে জোনাথন নিজের দিনলিপি বের করলো, ভয়াল সেই দিনগুলোর কথা জানল মিনা। আর এরপর থেকে বের হতে থাকল একের পর এক ভয়ানক তথ্য। যা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে তার বাস্তব কোন ব্যখ্যা নেই। সম্ভব না অসম্ভব কেউ জানেনা, ইংল্যান্ড শহরের মতো কুয়াশা ছেঁয়ে আছে সবার জীবনে।

জোনাথনের ডায়েরী, মিনার দেখা বাস্তবতা, লুসির বলা কিছু কথা আর অন্য অনেক কিছু মিলে সব কিছু যেন অন্ধকারে মোড়া শহর। বহু প্রাচীন এক ভ্যাম্পায়ার দলের খপ্পরে পড়েছেন তারা। কিন্তু এখন সামনে কী কোন পথ খোলা নেই? প্রফেসর হেলসিং এলেন উদ্ধারে। কিন্তু যা ঘটছে, বা যে ঘটাচ্ছে তার সাথে মোকাবেলা কীভাবে করা সম্ভব? আদৌ কি সম্ভব? কীভাবে? 

জানা অজানা কিছু কথা 

ব্রাম স্টোকারের লেখা ড্রাকুলা অন্যতম ভয়ানক এক রহস্য উপন্যাস বলেই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। গথিক হরর জনরার এই বইটি ১৮৯৭ সালে রচিত। পুরো গল্পটি বিভিন্ন চরিত্রের লেখা ডায়েরী, চিঠি দিয়ে সাজানো। মিনা, হেলসিং, জোনাথন, ডাক্তার মূলত এদের লেখা ডায়েরির পাতায় সাজানো আছে পুরো উপন্যাসের গল্প।  

১৮৯০ সালের শুরুর দিকে সূচনা হয় ড্রাকুলার। কথিত আছে, ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার-এর চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কাউন্ট ড্রাকুলা চরিত্র তৈরি করেছিলেন ব্রাম স্টোকার। আবার কারো কারো মতে, এলিজাবেথ বাথোরি-এর সাথে মিল রয়েছে। শেরিডান লা ফানুর, গথিক গল্প কারমিল্লা থেকে অনুপ্রানিত হয়েই ব্রাম স্টোকার এই উপন্যাস রচনা করেন, যা বিভিন্ন প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়। মজার ব্যপার হলো, চরিত্রের গঠনের জন্য লেখক শতাধিক পৃষ্ঠার নোট লিখেছিলেন, যা নিঃসন্দেহে দারুন একটা বিষয়। 

এখন অবধি ৩০টিরও অধিক সিনেমা তৈরি হয়েছে ড্রাকুলাকে নিয়েই। নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে বইটি। স্বয়ং লেখকের মতে, জোনাথন, মিনা, ডাক্তারসহ বেশ কিছু চরিত্রের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল, তারা ছাড়াও প্রায় প্রতিটি চরিত্র জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই সময়ে। তাহলে কী ড্রাকুলার অস্তিত্ব বাস্তবে ছিল?  

অনুভূতি

নেকড়ের প্রসঙ্গ কিংবা আঁধার রাতে জনহীন রাস্তায় এক ঘোড়ার গাড়িতে একলা জোনাথনের জায়গায় নিজেকে বসালে আঁতকে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরতে পর তে কখন ভয়ে কাঁপতে শুরু করবেন, টেরও পাবেন না। ড্রাকুলার প্রাসাদের বর্ণনা কিংবা জাহাজের নাবিকের বর্ণনা গা শিউড়ে ওঠবার মতোই। জাহাজ চালাতে মৃত নাবিক হুইলে নিজের হাত বেধে রেখেছিলেন। এই অংশ যতবার পড়বেন, মাথা কেমন কাজ করা বন্ধ করে দেবে। মনে হবে, সেই জাহাজে আপনিও আছেন। 

লেখকের লেখায় সম্মোহনী শক্তি আছে মানতেই হবে। যারা ডায়েরী লেখেন, এটা তাদের অনেক বড় নেশা। একইভাবে বইটিতেও শত বিপদে পড়েও উকিল সাহেব নিজের কথা ডায়েরীতে লিখতে ভোলেননি। সব নিখুঁতভাবে লিখেছিলেন বলেই হয়তো বিপদ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। 

আবার পালাবার সময় নিজের পকেটে ডায়েরি নিতে ভোলেননি, আর এই কারণেই পুরো গল্প বদলে গিয়েছে। হেলসিং বা জোনাথন যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনই ডাক্তার জন শেওয়ার্ড, মরিস, আর্থার কিংবা লিসাও কম যায় না। লিসা যেমন নিজের প্রাণ দিয়ে গেছে, তেমন মিনা নিয়েছিল নিজের প্রাণের ঝুঁকি। 

লিসা চরিত্রের সাথে যার জন্য অনেক কষ্ট বেশি হয় সে হলো আর্থার আর লিসার মা। অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে যে মানুষ অসহায়, নিরুপায় সেটা খুব ভালোভাবেই চরিত্রগুলো মাধ্যমে পাঠকও টের পেয়েছে। রেনফিল্ড নামে একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে, তার কিছু কার্যক্রম অস্বস্তিকর, তবে এই চরিত্র ঠিক কেন এল? কেন গেল এটাও বিরাট রহস্যের। এই চরিত্রের গুরুত্ব আছে আবার মাঝে মাঝে মনে হয় না থাকলেও ক্ষতি ছিল কি? 

প্রতিটি চিঠি কিংবা ডায়েরীর পাতা পড়বার সময় নিজে সেই চরিত্রকে অনুধাবন করতে পারবেন। যেমন মিনার চিঠি পড়ার সময় নিজেকে মিনা মনে হবে, ডাক্তারের লেখা পড়ার সময় মনে হবে আপনি নিজে রেনফিল্ডের সাথে কথা বলছেন কিংবা প্রফেসর হিসেবে লড়াই করে চলেছেন অপশক্তির বিরুদ্ধে। 

ব্রাম স্টোকার 

জনপ্রিয় এই লেখকের জন্ম ১৮৪৭ সালের ৮ নভেম্বর আয়ারল্যান্ডে। জন্মের পর থেকে প্রায় ৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি অসুখে ভুগছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সুস্থতা লাভ করেন এবং পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯১২ সালে টাইটানিক ডুবে যাবার মাত্র কয়েকদিন আগে, ২০ এপ্রিল তিনি মারা যান, সাথে নিয়ে যান ড্রাকুলার আসল রহস্য।

Dracula
লেখক ব্রাম স্টোকার। Image Source: pinterest.com

শেষকথা

লেখকের ভাষ্যমতে, ড্রাকুলার অনেক চরিত্র নাকি বাস্তবে বাস করতো। এখন প্রশ্ন থেকেই যায়, ড্রাকুলার বংশ কি আজো বেঁচে আছে? নিঃসন্দেহে ব্রাম স্টোকার ১২০ বছর আগে যে উপন্যাস লিখেছেন, সেই উপন্যাস এই আধুনিক সময়ে এসে এতটুকুও ম্লান হয়নি। না হারিয়েছে এর ভয়ানক আবেদন। নিঃসন্দেহে সময়ের অনেক আগে ছিলেন ব্রাম স্টোকার আর তার চরিত্র কাউন্ট ড্রাকুলা। 

 

Feature Image: time.com 
References: 

01. 100-best-novels-dracula-bram-stoker. 
02. Vlad the Impaler. 
03. Dracula Novel. 
04. Bram Stoker Dracula History