কার্টুন ভালোবাসেন? তাহলে তো আপনার ওয়াল্ট ডিজনির কথা জানার কথা! যিনি ছিলেন কার্টুন জগতের এক অনন্য ব্যক্তি। কঠোর পরিশ্রমের ফলে দিনশেষে সফলতার এক গল্প উঠে এসেছে তারই হাত থেকে। অ্যানিমেশন জগতের রাজা হিসেবে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার এই মানুষটি।
সাধারণত এই ডিজনিল্যান্ডটি সৃষ্টি করা হয়েছিল শিশুদের জন্য। শিশুদের মনোরঞ্জন অনেকটাই তাদের বিকাশের ওপর নির্ভর করে। তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের চিন্তা চেতনা আর কল্পনাকে প্রসারিত করতে এই চমৎকার আর ভিন্ন এক জগত সৃষ্টির চিন্তা করেন তিনি। পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই তাই সবাই চমৎকার মনোরঞ্জনের রাস্তা খুজেঁ পান। আজকে জানাবো পৃথিবীর বিখ্যাত ডিজনিল্যান্ড এবং তা গড়ে উঠার গল্প।
ওয়াল্ট ডিজনি
ওয়াল্ট ডিজনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে। ওয়াল্ট ডিজনির পূর্ণ নাম ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি। এই ব্যক্তিই ছিলেন পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেশন প্রোগ্রামার, যিনি ছোটবেলা থেকেই আর্টের ওপর প্রচণ্ড দক্ষতা অর্জন করে নেন। মার্সেলিনে এক ডাক্তারের ঘোড়ার ছবি এঁকে প্রথম অর্থ উপার্জন করেন ওয়াল্ট ডিজনি। তার সেই অর্থ আয়ের ব্যাপারটি তাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে তুলে। সে এই ঘোড়ার ছবি আঁকার পরই ছবি আঁকার দিকে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ওয়াল্ট ডিজনি ইলাস্ট্রেটর হিসেবে চাকুরী পান। তিনি ছিলেন একাধারে মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক, অ্যানিমেটর, কণ্ঠ শিল্পী ও চিত্রনাট্যকার। জীবনের তাগিদের নেশায় গড়ে তুলেছিলেন ছোট এক থিয়েটার। সেই তখন থেকেই শুরু হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য কার্টুন নির্মাণ। স্বপ্নের মতো পালটে যেতে থাকে তার জীবন। ১৯২৮ সালে বিখ্যাত কার্টুন মিকি মাউস সৃষ্টি করেন এবং সেই কার্টুনে তিনি নিজেই কণ্ঠ দেন। আর এরপর ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ডিজনিল্যান্ড।
ডিজনিল্যান্ডের ইতিহাস
ওয়াল্ট ডিজনি ছিলেন স্বপ্নবাজ একজন মানুষ। ছোটদের জন্য নানান কিছু করার পর তিনি অনুভব করলেন তাদের পিতা মাতার সাথে মজাদার কিছু সময় কাটানোর জন্য কোন ব্যবস্থা করা দরকার, যা তাদের মনোরঞ্জন দিবে এবং একইসাথে ভালো সময়ও কাটবে। সেই ভাবনা থেকেই ডিজনিল্যান্ডের চিন্তা মাথায় আসে তার। ১৯৪০ সাল নাগাদ বাচ্চারা মিকি মাউস এবং স্নো হোয়াইট নিয়ে প্রবল কৌতূহল প্রকাশ করে। তারা ভাবতে থাকে এইসব চরিত্র বাস্তবে থাকলে কেমন হতো?
তাদের এই ভাবনা থেকেই ওয়াল্ট ডিজনি অনুভব করেন এইসব চরিত্র সামনাসামনি দেখতে বিরক্তও হতে পারে বাচ্চারা আর তাই তিনি স্টুডিওতে একটি প্রদর্শনী রাখার চেষ্টা চালান। আর এরপর ডিজনি তার এই চিন্তাকে এক প্রকার স্বপ্নে রুপান্তরিত করেন যে তিনি এটি করেই ছাড়বেন। ঠিক এই স্বপ্ন থেকেই ডিজনি তার নিজের দ্বিতীয় বাড়িটি বিক্রি করে দেন যেন তার স্বপ্নটি বাস্তবে রুপান্তরিত হয়। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ডিজনিকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কিছু বাধা-বিপত্তির। নানান ঘটনা, অপ্রত্যাশিত সমস্যার শেষেও হংকং এ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এক বিশাল রাজ্য, ডিজনিল্যান্ড।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের স্থান বলে আখ্যায়িত এই পার্কটি মূলত মিকি মাউস পার্ক নামেই প্রথম পরিচিত ছিল। ১৬০ একর জমিতে গড়ে তোলা এই পার্কটি এক সময় পরিচিতি পায় ডিজনিল্যান্ড নামে। পার্কটির কাজ শুরু হয় মূলত ১৯৫৪ সাল নাগাদ। বিভিন্ন কন্সট্রাকশনের কাজ শেষ করে পার্কটি চালু হয় এর এক বছর পর ১৯৫৫ সালের ১৭ জুলাই।
এই ডিজনিল্যান্ড নিয়ে কিন্তু বেশ কিছু মতবাদ কিংবা নানান মন্তব্য উঠে এসেছে। ওয়াল্ট ডিজনির এই চিন্তা আসলে কীভাবে আর কেনই বা তার এই চিন্তাটা করতে হলো? পেছনের দিকে গেলে জানা যাবে যে, ওয়াল্ট ডিজনি তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে লস এঞ্জেলেসর এক পার্কে বসেছিলেন। তিনি তখন পার্কটির এক বেঞ্চে বসে ভাবতে লাগলেন এমন একটা জায়গা থাকা দরকার যেখানে পিতামাতার সাথে সন্তানরা ভালো সময় কাটাতে পারে।
আগে যদিও কথাটি বলা হয়েছে যে শিশুদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই পার্কটি তৈরি, তবে এই ছোট বার্তাটিও পাঠকের জানা থাকুক বরং! সেদিন পার্কে বসা ওয়াল্ট ডিজনির চিন্তাভাবনা থেকেই শুরু হয় কীভাবে তা বাস্তবে রূপ দিবে।
আরো জানা যায় যে, ১৯৪০ সালে ওয়াল্ট ডিজনি তার ভক্তদের কাছ থেকে চিঠি পেতে থাকেন, তারা চান যে ওয়াল্ট ডিজনির যে স্টুডিও আছে তাতে তারা ভ্রমণ করতে চায়। তারা কেবল সিনেমা দেখাতেই সন্তুষ্ট ছিল না, তারা এই কার্টুন বা সিনেমা নিয়ে আরো বেশ কিছু ব্যাপার উপভোগ করতে চাচ্ছিলেন।
ডিজনি জানতেন যে এতো মানুষদের একসাথে স্টুডিওতে নিয়ে আসা সম্ভব না। আর তাই তিনি ভাবেন যে কোন একটা বড় আকারে কিছু করা দরকার যেখানে সকল ভ্রমণপিপাসুরা ভ্রমণ করতে পারে। তিনি শিশু সহ বড়দের জন্যই সাধারণত ডিজনিল্যান্ড গড়ে তুলতে চান যেখানে সবাই তাদের প্রিয় কার্টুন চরিত্রগুলোও বাস্তবে তাদের আনন্দ দিবে।
ডিজনিল্যান্ডকে বলা হয় Happiest Place on Earth! আর এই চমৎকার জায়গাটি জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রকমের মন ভালো করার সরঞ্জাম। ডিজনিল্যান্ড নিয়ে জানার যেমন শেষ নেই তেমনই কৌতুহলেরও শেষ নেই। পৃথিবীর যে কয়টি আশ্চর্যজনক স্থান রয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। আর এর প্রতি মানুষের যেনো কৌতূহলেরও শেষ নেই! কেবলমাত্র বাচ্চাদের কাছেই এটি আকর্ষণীয় হিসেবে ছিলো না বরং আকর্ষণীয় ছিলো নানান বয়সের মানুষের মধ্যেও!
১৯৪৮ সালে ডিজনি স্টুডিওর প্রোডাকশন ডিজাইনার ডিক কেলসিকে একটি মেমো পাঠিয়েছিলেন মিকি মাউস পার্কের বিভিন্ন ডিজাইনের জন্য। তৎকালীন সময়ে সাধারণ জনগণ পার্কটি দেখার মতো অবস্থা ছিলো না। তারা ছিল বিশৃঙ্খল। আর ডিজনি চেয়েছিলো তার পার্কটি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কায়দার, যা জনগণ আগে ভাবেনি। যেখানে প্রবেশ করার পরপরই চলে যাওয়া যাবে অন্য এক জগতে। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুলাই প্রথম ডিজনিল্যান্ডের গেট খোলা হয়। প্রায় ১৮ টি রাইড সহ এডভেঞ্চার ল্যান্ড, ফ্যান্টাসিল্যান্ড, টুমোরো ল্যান্ড সহ মোট ৫ টি পার্ক চালু করা হয়।
ডিজনিল্যান্ড নিয়ে বেশ কিছু চমৎকার তথ্য জানা যায়। সম্প্রতি এক খবরে জানা যায়, ডিজনিল্যান্ডে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন লোকজনের সমাগম হয় প্রতিদিন। আর এতো লোকজনে ঠাসা হলেও বিন্দুমাত্র চাপের মুখে পড়তে হয়নি ডিজনিল্যান্ড কতৃপক্ষকে। এই কয়েক বছরে ডিজনিল্যান্ডের বেশ কিছু টেকনোলজির পরিবর্তনও এসেছে।
১৯৫৬ সালে, এর প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায়ই প্রায় ৫ মিলিয়ন দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় ডিজনি কতৃপক্ষ। ১৯৬৬ সালে ওয়াটার রাইড নামে একটি রাইড চালু করে। এর ভেতরে এমন কিছু টেকনোলজি ব্যবহার করা হয় যাতে দর্শনার্থীরা তাদের পছন্দমতো গান শুনতে পারে এবং চমৎকারভাবে সেটি ডিজনিল্যান্ডের বেশ বিখ্যাত রাইড হিসেবেই পরিচিত লাভ করতে সক্ষম হয়। ডিজনিল্যান্ডের দর্শনার্থী প্রতি বছরই তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। শুরুর সাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন দর্শনার্থী রোজ সেখানে যান।
তবে সম্প্রতি কোভিড পরিস্থিতির জন্য ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে পার্কটি বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় ডিজনি কতৃপক্ষ জানান ১৯৫৫ সালের পর মাত্র কয়েকবারই এটি বন্ধ রাখা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মৃত্যুর দিন এবং ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দিন। এতকিছুর পরেও ডিজনিল্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমেনি বরং দিনদিন বেড়েই চলেছে। ডিজনিল্যান্ডের ওপর বেশকিছু সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে। এর জনপ্রিয়তার কারণে পুরো পৃথিবী জুড়ে এক অনন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে আজীবন।
Feature Image: dreamlandtravel.com
তথ্যসূত্র:
01. The History of Disneyland.
02. Disneyland Opens.