ডিংকা: দক্ষিণ সুদানের সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী

837
0

ডিংকা সুদানের বৃহত্তম একটি জাতিগোষ্ঠী। ডিংকা শব্দটি বহিরাগতদের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল। এই শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদেরকে ডিংকা নামে ডাকা হলেও তারা নিজেদেরকে মুওনজাং বা জিয়েং নামে অভিহিত করে থাকে। যার অর্থ হলো পুরুষ বা পুরুষের স্বামী।

শুধুমাত্র শিক্ষিত সংখালঘুরাই জানে যে, তাদের ডিংকা নামে ডাকা হয়। তারা মূলত নাইলোটিক সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। নাইলোটিক বলতে নীলনদ অঞ্চলের অধিবাসীদের বুঝায়। যারা মূলত দক্ষিণ সুদানে বসবাস করে। 

ডিঙ্কা আফ্রিকার অন্যতম লম্বা মানুষ Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান অঞ্চলে ডিংকাদের অস্তিত্ব প্রথম মিশরীয়রা জানতে পারে। পরে গ্রিক পরিব্রাজক এবং ভূগোলবিদরা তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানে। পরবর্তীতে বিশ্ববাসী তাদের মাধ্যমে ডিংকা জাতিগোষ্ঠী সম্পের্ক জানতে পারে।

১৯৫৫ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে, ডিংকাদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় পনের মিলিয়ন। ১৯৮৩ সালে সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কারণ খার্তুম সরকার আইন-আদেশের বলে, দক্ষিণের পুরো অঞ্চল জুড়ে ইসলামী আইন চাপানোর চেষ্টা করে। যার ফলে দক্ষিণের দুই জাতিগোষ্ঠী ডিংকা এবং নিউয়ার একে অপরের বিরুদ্ধে চলে যায়। 

ডিংকা জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র বর্শা Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত যুদ্ধটি ডিংকা জনগনের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল। হাজার হাজার ডিংকা মারা যায়। বিপুল সংখ্যক ডিংকা দক্ষিণ সুদান থেকে উত্তর সুদানের রাজধানী খার্তুমে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে। সেই সাথে তারা কেনিয়া, উগান্ডা, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও চলে যায়। 

১৯৯৯ সালে ডিংকা-নিউয়ার এর মধ্যে আনলিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সুদান সরকারকে এই গনহত্যা চালানোর জন্য অভিযোগ করে। 

একটি অল্প বয়স্ক ডিঙ্কা ভোরের ঠান্ডায় উষ্ণ হওয়ার জন্য আগুনের কাছে ক্রুচ করছে Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

আফ্রিকান ভাষাবিদরা নাইলোটিল বিভাগে, ডিংকাকে একটি প্রধান ভাষা হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। ডিংকাদের কিছু বৈচিত্র্যময় শব্দভান্ডার রয়েছে। অনুমান করা হয় যে, ডিংকা ভাষায় প্রায় ৪০০টির বেশি শব্দ ভান্ডার খুঁজে পাওয়া যায়। শব্দগুলো বেশির ভাগ গবাদি পশুকে কেন্দ্র করে। 

গবাদি পশু ডিংকাদের কাছে প্রতীকী এবং ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং লোকগাঁথাতে। যা তাদের গবাদি পশুর প্রতি অধিগ্রহণ সম্মান এবং ভক্তি প্রকাশ করে। 

একটি ডিংকা পরিবার প্রাত্যহিক জীবনে নিজেদের বাড়ির সামনে। Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ডিংকারা প্রায় পঁচিশটি পারস্পরিক স্বাধীন উপজাতীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রতিটি গোষ্ঠী হাজার থেকে শুরু প্রায় পঁচিশ হাজার ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র দল বা গোত্র গঠন করে। প্রতিটি দল আবার ছোট ছোট বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত। 

ডিংকারা প্রধানত শুকনো মৌসুমে তাদের নিজস্ব আবাসস্থল ছেড়ে সমভূমিতে বা নদীর তীরবর্তী চারণভূমি বসবাস শুরু করে। সাথে তারা তাদের গবাদি পশুর পালও নিয়ে যায়। আবার বর্ষার মৌসুম শুরু হওয়ার আগে, গবাদি পশুর পাল সমেত তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে ফিরে আসে। এর জন্য ডিংকাদের সিজনাল মাইগ্রেশন বা ঋতুভেদ দেশান্তরি বলা হয়। 

নিহাল নামের এক বালক গরুর দুধ সংগ্রহ করছে। Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ডিংকাদের জীবন-জীবিকা মূলত নির্ভর করে পশুসম্পদ (বিশেষত গবাদিপশু), কৃষি, ব্যবসা এবং বন্য খাবারের ওপর। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে, তাদের মধ্যে বন্য খাদ্য ও মাছ শিকারের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। এই কারণে ডিংকাদের যাজকপালক হিসেবে চিহ্নিত করার পরিবর্তে কৃষি – অর্থনৈতিক যাজক হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। 

ডিংকাদের অর্থকারি ফসল হলো চিনাবাদাম, তিল, জোরা, বাজরা, মটরশুঁটি ইত্যাদি। বাজরা তাদের প্রধান খাদ্য। তাছাড়া ঋতুর উপর নির্ভর করে এরা ভাত, মাছ, গরুর দুধ, মটরশুটি, টমেটো ইত্যাদি খেয়ে থাকে। 

একটি ছেলে শিবিরে একটি গরুর তল থেকে সরাসরি দুধ পান করছে Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ডিংকা পুরুষরা বর্শা ও মাছ ধরার হুক তৈরি করে। মহিলারা কয়েলিং কৌশল ব্যবহার করে মাটির রান্নার হাঁড়ি তৈরি করে। জল বহনের প্রয়োজনীয় পাত্র তৈরির পাশাপাশি ডিংকা মহিলারা ঝুড়ি এবং ঘুমানোর জন্য মাদুরও বুনেন। যাই হোক, মহিলারা স্থানীয় জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য এবং শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। ডিংকারা খুব কম পোশাক পরে এবং জুতো ব্যবহার করে না। 

পুরুষ ও মহিলারা উভয়ই তাদের গলায় জপমালার স্ট্রিং পরে থাকে। মহিলারা তাদের বাহু এবং পায়ে চুড়িও পরে থাকে। পুরুষরা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তখন তারা আর তাদের জন্মের নাম নিজেদের পরিচয় দেয় না। তারা তাদের প্রিয় গবাদি পশুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকে নিজেদের নাম গ্রহণ করে থাকে। যেমন, থিসডেং, যার অর্থ হল দেবতাদের ক্লাব; বা আচিনবাই যার অর্থ হল যে কখনো তার পশুর পালকে পেছনে ফেলে যায় না। 

মাছ ধরার মহাউৎসব চলছে। Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ডিংকাদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন অনেক বেশি দেখা যায়। সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে হলে, পুরুষদের পঞ্চাশ থেকে একশত স্ত্রী থাকতে পারে। ডিংকা জনজীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষদের আধিপত্য। ডিংকারা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। দেবতা নিহালই তাদের প্রধান স্রষ্টা। তাছাড়া নিম্ন দেবতাদের মধ্যে রয়েছে দেং। 

১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে, মিশন স্কুলের মাধ্যমে পড়ালেখা শুরু হয়। এর আগে তাদের জন্য কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। আজও বেশিরভাগ ডিংকার পড়ার ও লেখার ক্ষমতা নেই। যুদ্ধের কারণে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

নাচ ও গান ডিংকাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূণ অংশ।Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু সবই সাধারণ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়। নাচ ও গান সংস্কৃতিতে ডিংকারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ডিংকা বসতিতে নাচের জন্য এক সেট করে ঢোল রয়েছে। যুদ্ধের গান, দীক্ষার গান, পূবপুরুষদের স্মরণের জন্যও গান রয়েছে। নিম্নে ডিংকাদের একটি নিত্যদিনের গানকে অনুবাদ করে দেয়া হলো – 

হে স্রষ্টা,
স্রষ্টা যিনি আমাকে মাতৃগর্ভে সৃষ্টি করেছেন
আমাকে খারাপ কিছুর সম্মুখীন করেননি
গবাদি পশুর স্থান দেখিয়েছেন আমায়
যাতে আমি আমার ফসল ফলাতে পারি
আর আমার পশুপালকে রক্ষণাবেক্ষণ করি।

এই লোকটি আরও ঐতিহ্যবাহী বর্শার পরিবর্তে একটি রাইফেল বহন করে Image Source: Stefanie Glinski/AFP/Getty Images

ডিংকারা তাদের যুদ্ধের দক্ষতা বিকাশের জন্য বর্শা বা লাঠি এবং ঢাল ব্যবহার করে থাকে। ১৯৮০ এর দশকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পর থেকে, অসংখ্য ডিংকাদের গ্রাম পুড়িয়ে বা বোমা হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাছাড়া উত্তর সুদানে অনেক ডিংকাদের অপহরণ করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে ডিংকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম পর্যায়ে পৌছায়ে গেছে। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অনেক দুষ্কর হয়ে যাবে। সুদান সরকারের উচিত, নিপিড়ীত এ জাতিগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা।

 

Feature Image: dailysabah.com
তথ্যসূত্র:
01. The- Dinka-herder-in-purple-carol-Beckwith-Angela-fisher.
02. Dinka-south-Sudan-cattle-ox.
03. The south-Sudan-Dinka-people.
04. The Dinka.
05. The Dinka.