হাতির পাল: ঢাকার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি

380
0
Source:Tbsnews.net

ঢাকা–বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এক নগরী। যানজট, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা, অপরিকল্পিত নগরায়ন আরো কতই না সমস্যা এই শহর জুড়ে। যান্ত্রিক এই নগর যেন সবার জন্য এক বেদনার নাম। কিন্ত কেউ কি বিশ্বাস করবে যে এই ঢাকায় ছিল নানা প্রাণির অভয়ারণ্য?

বসবাসের অযোগ্য এই শহরটি যে একসময় দুনিয়ার অন্যতম ঐশ্বর্যমন্ডিত শ্রেষ্ঠ শহর ছিল তা বললে হয়তো কেউ পাগল বলতেও দ্বিধা বোধ করবে না। কিন্ত সত্যিই এই মহানগরী ছিল এক অনন্য স্থান যেখানে প্রাকৃতিক শোভা, বন্যপ্রানী সবকিছুই একসাথে দেখা যেত। ঢাকার জঙ্গলগুলোতে তখন চরানো হতো হাতিসহ অন্যান্য প্রাণি যা আজকের ইট পাথরের নগরীতে মিলে না।

Forest cover of Bangladesh, (1930, 1975, 1985, 1995, 2006 and 2014) | Download Scientific Diagram
ঢাকায় বনাঞ্চলের বছরভিত্তিক তথ্য Source: ResearchGate

ঢাকায় যারা বসবাস করছেন কিংবা ভ্রমণে যান তখন কি শহরটির জায়গাগুলোর নাম নিয়ে একটুও ভেবে দেখেছেন? কেনইবা একটি স্থানের নাম এলিফ্যান্ট রোড যেখানে কোন এলিফ্যান্টই (হাতি) নেই? হাতিরঝিলে বেড়াতে গেলে ঝিল দেখতে পেলেও হাতি কি দেখতে পান? তবে কেন এই নাম?

তাছাড়া হাতিরপুল, হাতিঘাট, গজমহল ইত্যাদি তো আছেই। আসলে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে নামগুলো এমনি এমনি দেওয়া হয়নি। সব স্থানের সাথেই জড়িয়ে আছে মানুষের পরে দ্বিতীয় বুদ্ধিমান প্রাণি হাতি। আজকের আলোচনা ঢাকার সেই হাতির পাল নিয়ে যাদের এখন আর চোখেই পড়ে না।

স্কট ফিলিপের আকা শহরে হাতি Source: tbsnews.net

বলা হয় হাতির পালের আগমন ঘটে মুঘল আমলে। তবে মুঘলদের মধ্যে সম্রাট আকবর হাতিকে পোষ মানাতে পারদর্শী ছিলেন। এছাড়াও পরবর্তীতে মুঘলদের অন্যান্য সম্রাটগণও হাতিকে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন।

বর্তমানে হাতির কথা আসলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা উঠে আসে। ঢাকার হাতিগুলোকেও ঐ অঞ্চল থেকেই এনে পোষ মানানো হতো। হাতিকে এনে পরিচর্যা করা, একে পোষ মানানো ও মানুষের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের হাতিগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো যা ‘হাতিখেদা’ নামে পরিচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের হাতিগুলোকে পিলখানাতে রাখা হতো। পিল অর্থ ‘হাতি’ এবং খানা অর্থ ‘জায়গা’। তাহলে বুঝা যায় আজকের পিলখানা নামক জায়গাটি মূলত হাতির পালের জন্যই রাখা।

Pin op Old Pictures of Bangladesh
পিলখানায় হাতির পাল Source: Pinterest

মুঘল আমলে হাতিগুলোকে নানা কাজে ব্যবহার করা হতো। বলা হয় যে, মুঘলরা ঘোড়ার মাধ্যমে বাংলায় ঢুকলেও পরবর্তীতে তারা হাতির মাধ্যমে নানা কাজ করে থাকে। তাদের যুদ্ধের রসদ পরিবহন, ব্যক্তিগত পরিবহনের জন্য হাতির ব্যবহার তখন ব্যাপক ছিল।

এছাড়াও ঢাকার মাহুতটুলীর প্রতিষ্ঠাও মুঘল আমলেই হয়। মাহুত অর্থ হাতি পরিচালনাকারী। তারা হাতির যত্ন,পরিচালনা ইত্যাদি করে থাকতো। মাহুতেরা হাতি পরিচালনায় এতটা পারদর্শী ছিলেন যে ঐ সময় হাতিতে চরা একটি নিরাপদ ভ্রমণ বলে ধরা হতো।

বর্তমানে বাস-ট্রাক চালক বা হেলপারদের জন্য নির্দিষ্ট কোন সুবিধা আমরা দেখতে পাই না। তবে ঐ সময় ঢাকার মাহুতদের জন্য আলাদা সুবিধা ছিল। মাহুতটুলীতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাহলে বুঝা যায় যে ঐ সময় ঢাকায় হাতির সংখ্যা নেহাত কম ছিল না।

painting; album (detached folio) | British Museum
মাহুতের সাথে হাতি Source: British Museum

বর্তমানে ঢাকা বলতে এক বিশাল এলাকাকে বুঝানো হয়। কিন্ত পূর্বে তা নারায়ণগঞ্জের ফরাশগঞ্জ, বুড়িগঙ্গার আশেপাশে ঘিরে ছিল বাণিজ্য ও বসত অঞ্চল। তাই তেজগাঁও থেকে উক্ত অঞ্চলে যাওয়ার সময় বন্য এলাকা ছিল।

মানুষ তাদের পরিবহনের জন্য হাতিকেই ব্যবহার করতো কেননা হাতির আকার বিশাল হওয়ায় তারা দুর্গম পথ ভেঙ্গে পাড়ি দিতে পারতো যা ছিল খুবই নিরাপদ।

Dhaka Map 1850 | Ancient maps, Dhaka, Old map
১৮৫০ সালে ঢাকার একটি মানচিত্র যেখানে অনেক খালি জমি বিদ্যমান Source: Pinterest

ইংরেজ সরকারকেও হাতি ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। তারা হাতিখেদার জন্য ৯০ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়। এমনকি হাতির গোসলের জন্য দুটি ঝিলও তারা ভাড়া নেয়।

একটি সাত মসজিদ ঝিল এবং অন্যটি কুড়িপাড়া ঝিল।

এর বাইরে বুড়িগঙ্গাকেও হাতির গোসলের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে সেটি শহরের মধ্যে হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানায়।

ফলস্বরুপ, হাতিরঝিলকে হাতি গোসলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে যাওয়ার জন্য রোডকেই এলিফ্যান্ট রোড বলা হতো। আর এই রাস্তায় একটি রেললাইন পড়তো যার কারণে হাতির চলাচলের জন্য একটি পুল বানানো হয়। আর এই পুলকেই এখন হাতিরপুল বলা হয়।

ঢাকার বনাঞ্চলে হাতি Source:tbsnws.net

অর্থনৈতিক চিন্তা বিবেচনা করলেও হাতির গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। পিলখানা থেকে সরকার অনেক রাজস্ব পেত। আবার হাতির গোসলের জন্য ব্যবহৃত ঝিলগুলোর জন্যও খাজনা দিতে হতো।

ঢাকা ছিল হাতিখেদার প্রধান কার্যালয়। হাতিকে পোষ মানানো তখন শিল্প স্বরূপ মনে করা হতো। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে হাতির সংখ্যা কমতে দেখা যায়। এর পূর্বে হাতি খেদার প্রধান জিপি স্যান্ডারসন থাকার পর্যন্ত হাতির সংখ্যা সত্তরের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হয়।

এর পরেই হাতিখেদার কার্যালয় বার্মাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে ক্রমেই ঢাকায় হাতির সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তবুও কিছু হাতিকে দেখা গেলেও এরপর তেমন একটা হাতিখেদা এবং মাহুতদের চোখে পড়েনি।

George P. Sanderson - Wikipedia
জিপি স্যান্ডারসন Source: Wikipedia

এছাড়া শিল্প কারখানার দরুণ গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন আবিষ্কারের ফলে পরিবহনের জন্যও হাতির ব্যবহার কমে যায়। এর পূর্বে হাতি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

কিন্ত নানা ব্রান্ডের গাড়ি আবিষ্কার, ভারী জিনিস দ্রুত বহন ইত্যাদির জন্য আর হাতির দরকার হয় না। এর পাশাপাশি কারখানার আবিষ্কার, নগরায়নের জন্য ঢাকার গাছপালাও কমা শুরু হয়। ফলে হাতির জন্য নগরীটি নরকে পরিণত হয়।

আজকাল হাতিকে শুধুমাত্র একটি উপদ্রব হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বললেও ভুল হবে না। ঢাকার রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ চাঁদা তুলার জন্য হাতিকে ব্যবহার হতে দেখা যায়। কিন্ত মালিকরা আগের মতো হাতির তেমন যত্ন নেন না।

 

Dhaka most probably in the 60s. Need to find out the name of the photographer and other related details. | Dhaka, East pakistan, Dhaka bangladesh
৬০ এর দশকের ঢাকা Source: pinterest

২০২২ সালের এক রিপোর্টে বলছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত পুরো দেশে মাত্র ২৬৮টি হাতি ছিল যার মধ্যে গত পাঁচ বছরে ৫০টি হত্যা হয়েছে। ২০২১ সালেই ৩৪টি হাতিকে হত্যা করা হয়েছে।

এর মূল কারণ হাতির পর্যাপ্ত বাসস্থান না থাকা। ঢাকা শহর তো অযোগ্যই, এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের বন্য হাতির এলাকাতেও অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। যার দরুণ হাতিরা সাধারণ মানুষের এলাকায় এসে মানুষকে আক্রমণ করছে। এই আক্রমণ রোধ করতেই হাতিগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে।

হাতি বন্ধুসুলভ এক জীব। নানা কাজে হাতিকে ব্যবহার করার সাথে সাথে বিভিন্ন চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন কিংবা মিছিল, সব জায়গায় হাতির ব্যবহারের প্রচলন ছিল। বাংলাদেশ ও ভারতে হাতিকে নিয়ে কল্পকাহিনী রয়েছে। সহযোগিতা প্রবণ এই জীবটিকে নিয়ে এসব কর্মকান্ড এখন শুধুমাত্র মিডিয়াতে দেখা গেলেও হাতিকে রক্ষায় তেমন একটা পদক্ষেপ দেখা যায় না।

Asian elephants in Bangladesh face growing risk of extinction | Dhaka Tribune
এশিয়ান হাতি যার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে Source: Dhaka Tribune

ঢাকার বিভিন্ন স্থান এই হাতিকে কেন্দ্র করে হলেও হাতির এই ইতিহাস জানা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আবার ঢাকায় হাতিকে কেন্দ্র করে অভয়ারণ্য না থাকার ফলেও ইতিহাস মুছে যাওয়ার সম্মুখীনে রয়েছে।

তবে আশার ব্যাপার হলো দেশের বনবিভাগ হাতি রক্ষায় নতুন প্রোজেক্ট ডিজাইন করেছে। পুর্বের ১২টি করিডোরের মধ্যে একটি করিডোর সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়লেও নতুন আইন প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নে তারা কাজ করছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে আসে।

 

 

Feature Image:tbsnews.net 
References: 

01. Bangladesh struggles to protect the last of its last wild elephants. 
02. ঢাকায় হাতি নেই. 
03. ঢাকায় হারিয়ে যাওয়া হাতির পাল.