সারাবিশ্বে মহামারীর চেয়েও দ্রুতগতিতে যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে সেটি হচ্ছে মানসিক রোগ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ উদ্বেগ, বিষন্নতা এবং অনিদ্রার সম্মুখীন হচ্ছে। বিষন্নতা, উদ্বেগ, অনিদ্রার সমস্যা দূর করতে মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন করছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মানুষের বিষণ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ওষুধের ব্যবহার অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়েছে।
বিগত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপীয়রা। ২৪টি ইউরোপীয় দেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে, প্রতি ১০০০ জন প্রতিদিনে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ সেবন করেছে। যার মধ্যে লাটভিয়ায় ২০ ডিডিডি (নিত্যদিনের ডেইলি ডোজ) থেকে আইসল্যান্ডে ১৫৩ ডিডিডি পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে। এরপরে পর্তুগাল (১৩১ ডিডিডি), যুক্তরাজ্য (২০১৭ সালে ১০৮ ডিডিডি), সুইডেন (১০৫ ডিডিডি) এবং স্পেনে (৮৭ ডিডিডি)।
২০২০ সালে, এই ২৪টি দেশে গড় ব্যবহার ছিল ৬৮ ডিডিডি। তুরস্কের তিনটি সর্বাধিক জনবহুল দেশ (৪৯ ডিডিডি), ফ্রান্স (৫৫ ডিডিডি) এবং জার্মানি (৬২ ডিডিডি) সবগুলোই গড় ব্যবহারের নীচে রেকর্ড করা হয়েছে।
এন্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহারের মাত্রা
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের ১৮টি দেশে ২০০০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে তা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
ওইসিডি দ্বারা ব্যবহৃত ডেটাসেটগুলো অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ‘সংজ্ঞায়িত দৈনিক ডোজ’ বা DDD (ডিডিডি) শব্দটি ব্যবহার করে। ২০০০ সালে, ১৮টি ইউরোপীয় দেশে গড় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবন প্রতি ১০০০ জনে ৩০.৫ ডিডিডি ছিল। ২০২০ সালে, এটি বেড়ে ৭৫.৩ ডিডিডি হয়েছে, যা প্রায় ১৫০ শতাংশ (বা আড়াই গুণ) বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০ সালে, ২৪টি দেশে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবনের গড় ব্যবহার ছিল ৬৮ ডিডিডি। জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম তিনটি দেশ – তুরস্ক (৪৯ ডিডিডি), ফ্রান্স (৫৫ ডিডিডি) এবং জার্মানি (৬২ ডিডিডি)-সবগুলোই গড় ব্যবহারের নিচের দিকে রয়েছে। ২০ বছর সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি ছিল চেক প্রজাতন্ত্রে, যেখানে ব্যবহার ৫৭৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ফ্রান্সে সর্বনিম্ন ছিল (৩৮ শতাংশ)।
প্রতি বছর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) গড় হিসাবেরও আরও বেশি লোক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস সেবন করে। এই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ বিভিন্ন নামে বিক্রি হয় বিভিন্ন দেশে যেমন: অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি, অ্যাক্সিওলাইটিক্স, ডায়াজেপাম, লোরাজেপাম, অরফিডাল নামে বেশি পরিচিত।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহারের মধ্যে অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধগুলি মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করছে কারণ এটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আসক্তিতে পরিণত হতে পারে। এই ধরনের ঔষুধ সেবনে পর্তুগাল আবার রয়েছে সবার আগে এর পরেই রয়েছে স্পেন এবং ক্রোয়েশিয়া।
উদাহরণস্বরূপ: ডায়াজেপাম ২০১৯ সালে ক্রোয়েশিয়ায় সপ্তম সর্বাধিক ব্যবহৃত ওষুধ ছিল, আইবুপ্রোফেনের চেয়ে, যা নবম স্থানে ছিল। অনিদ্রা এবং উদ্বেগের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধগুলি প্রায়ই প্রেসক্রাইব করা হয় কিন্তু অতিরিক্ত সেবনের ফলে তা আসক্তিতে পরিণত হতে পারে।
সুখ এবং অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টর গ্রহণ, দুটোর মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো ‘না’। ইউরোপীয় দেশগুলির ডেটা অনুযায়ী একজন সুখী মানুষ কম অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ওষুধ সেবন করেন তেমন কিছুর উল্লেখ নেই। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুসারে আইসল্যান্ড, যা ২০২০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সুখী দেশ ছিল, আর ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তারাই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার করেছে।
প্রতিবেদনে ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা সুইডেন, ১০৫ ডিডিডিসহ চতুর্থ সর্বোচ্চ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহারকারী ছিল। ফিনল্যান্ডের জনগণ, যারা রিপোর্ট অনুসারে সবচেয়ে সুখী দেশ ছিল, তারা ৮২টি ডিডিডি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করেছিল যা ২৪টি দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ডকে ৭তম স্থানে রেখেছে।
লাটভিয়া, যেখানে দৈনিক সর্বনিম্ন ২০ ডোজ ব্যবহার রয়েছে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের, তারা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদনের ৩৪ তম স্থানে রয়েছে। লাটভিয়াকে অনুসরণ করে ৩০ ডিডিডি নিয়ে হাঙ্গেরি, সুখের তালিকায় ৪৩ তম অবস্থানে রয়েছে।
গত ১০ বছরে কি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার কমেছে?
২৪টি ইউরোপীয় দেশে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের ব্যবহার ৩৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে গড় দৈনিক ব্যবহার ৪৯.৮ ডিডিডি থেকে ৬৮ ডিডিডি ছিল। ডেনমার্কই একমাত্র দেশ যেটি গত এক দশকে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ব্যবহারে ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এস্তোনিয়ায় সর্বোচ্চ ১৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির রেকর্ড করা হয়েছে যেখানে ফ্রান্সে মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এইদিকে যুক্তরাজ্যে দ্বিগুণ এবং তুরস্কে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্রাসের এই পরিবর্তনটি ১০ টি দেশে ২৫ শতাংশেরও কম ছিল।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের পেছনে খরচ একজন মানুষ ও দেশের জন্য অপচয় কিন্তু শঙ্কিতভাবে তা বেড়ে চলছে। ২০২০ সালে, জার্মানি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস-এর জন্য ৮১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৭৮৩ মিলিয়ন ইউরো) ব্যয় করেছে।
স্পেন (৬৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬২৬ মিলিয়ন ইউরো) এবং ইতালি (৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪৪০ মিলিয়ন ইউরো) ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এরাই সবচেয়ে বড় ভোক্তা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ওষুধের।
কিছু দেশে অনান্য ওষুধ যে পরিমাণে বিক্রি হয় তারচেয়ে বেশি এই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ওষুধ বিক্রির রেকর্ড রয়েছে। এর ফলে এই ওষুধের পেছনে ব্যয়টাও উল্লেখযোগ্য। ২০২০ সালে, পর্তুগালে ওষুধ বিক্রির ৪ শতাংশই ছিল অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ওষুধ, স্পেনে ২.৭ শতাংশ, অস্ট্রিয়ায় ২.২ শতাংশ, তুরস্কে ১.৯ শতাংশ এবং জার্মানিতে ১.৪।
ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতার প্রাদুর্ভাব
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকোথেরাপিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা লোকেদের সম্পর্কে কোনও সরকারি ডেটা নেই।
২০১৯ সালে, ইউরোস্ট্যাট উল্লেখ করেছে যে ইউরোপীয় নাগরিকদের ৭.২ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতার কথা জানিয়েছে যা ২০১৪ (+০.৩ শতাংশ পয়েন্ট) এর তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৯ সালে, ইইউ দেশগুলির মধ্যে, পর্তুগাল (১২.২ শতাংশ) তা জনসংখ্যার দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতার রিপোর্টে সবচেয়ে বেশি ছিল, তারপরে সুইডেন (১১.৭ শতাংশ), জার্মানি এবং ক্রোয়েশিয়া (উভয় ১১.৬ শতাংশ)।
দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতার তালিকা করা লোকের অনুপাত সবচেয়ে কম ছিল রোমানিয়ায় (১.০ শতাংশ), বুলগেরিয়া (২.৭ শতাংশ) এবং মাল্টায় (৩.৫ শতাংশ)।
মজার বিষয় হলো, দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতার রিপোর্ট করা দুটি বৃহত্তম দেশ আইসল্যান্ড (১৫.৬ শতাংশ) এবং পর্তুগাল (১২.২ শতাংশ)। এছাড়াও ২০২০ সালে যথাক্রমে ১৫৩ ডিডিডি এবং ১৩১ ডিডিডিসহ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী ছিল৷
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোভিডের প্রভাব
সাম্প্রতিক ওইসিডি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্যভাবে অবনতি হয়েছে। মার্চ ২০২০ থেকে, বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশসহ ১৫টি নির্বাচিত ওইসিডি দেশে উদ্বেগ এবং বিষন্নতার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের গোড়ার দিকে উদ্বেগের প্রাদুর্ভাব দ্বিগুণ ছিল যা পূর্ববর্তী বছরগুলিতে পরিলক্ষিত হয়েছিল।
মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্র, মেক্সিকো, সুইডেন, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের গোড়ার দিকে হতাশার প্রাদুর্ভাব ছিল দ্বিগুণ বা দ্বিগুণেরও বেশি।
১৪টি ওইসিডি দেশে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্যবহার ১০ শতাংশ বা তার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এই দুই বছরে লাটভিয়ায় ব্যবহার ২২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু হাঙ্গেরিতে মাত্র ১ শতাংশ বেড়েছে৷
যাইহোক, এটি গত ২০ বছরে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের সেবন বৃদ্ধির ধারাবাহিক প্রবণতার পটভূমির সাথে যায় না। অতএব, এই সাম্প্রতিক বৃদ্ধির উপর মহামারীর সম্ভাব্য প্রভাব বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
কেন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে?
গত দুই দশকে (২০০০-২০২০) এন্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার বৃদ্ধির কিছু কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। গবেষকরা ১৯৯৫ এবং ২০১১ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে এন্টিডিপ্রেসেন্ট নির্ধারণের প্রবণতাগুলির উপর প্রভাব নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।
তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে বিষণ্নতা এর মূল কারণ, নতুন অ্যালজাইমার রোগের ঔষুধের প্রাপ্যতা, রোগীর মনোভাবের পরিবর্তন, চিকিৎসার সহজলভ্যতা এবং হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধি উল্লেখ করার মতো ছিল।
Feature Image: thedailybeast.com References: 01. Antidepressant use in 27 European countries. 02. Europe’s mental health crisis. 03. Antidepressant use in Europe continues to break records. 04. Europe’s mental health crisis in data: Which country uses the most antidepressants?