গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে আমরা যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠি, তখন আমরা ভাবি-ইশ! মাটির নিচে বাড়ি বানাতে পারলে কতই না ভালো হতো? তাই না! আমাদের জন্য যদিও এটি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এই অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করেছে একটি শহরের মানুষ। শহরের নাম ডেরিনকুয়ু। ইউরেশিয়ান দেশ তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নেভশেহির প্রদেশের কাপাডোসিয়ায় অবস্থিত মাটির নিচে শতবর্ষী রহস্যময় শহর সম্পর্কেই জানাবো আজকে।
ডেরিনকুয়ু আবিস্কারের সূত্রপাত
১৯৬৩ সালে তুরস্কের কাপাডোসিয়া অঞ্চলে নিজের বাড়ি মেরামত করছিলেন এক বাসিন্দা। কারণ তার বাড়ির একটি প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিল। আর ঠিক সেই সময়ই মাটির নিচে একটি হিডেন প্যাসেজ আবিস্কার করেন তিনি। এখানেই শেষ নয় বরং তিনি দেখলেন এর বাইরেও আছে একটি রুম এবং আরও প্যাসেজ।
তিনি বেশ অবাক হওয়ার পাশাপাশি কৌতূহলীও হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে আরও খোঁজাখুঁজির মাধ্যমে একটি জটিল সুড়ঙ্গ, গুহাব্যবস্থা এবং শেষ পর্যন্ত আগ্নেয় শিলায় খোদাই করা একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ শহর খুঁজে পান। নিজের অজান্তেই প্রাচীন ভূগর্ভস্থ শহর ডেরিনকুয়ু ঠিক এভাবেই আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।
ডেরিনকুয়ু শহরের ইতিহাস
তুরস্কের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মতে, ইন্দো-ইউরোপীয় ফ্রিজিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন আনুমানিক ৭৮০ থেকে ১১৮০ খ্রিস্ট পূর্বে বাইজেন্টাইন আমলে ডেরিনকুয়ু শহরের উৎপত্তি করে। এই সময়ের মধ্যে, এটি ৪৪৫ কিমি এলাকা জুড়ে গঠিত হয়। অনেকগুলো সুড়ঙ্গ এবং চেম্বার একটি টানেল নিয়ে গঠিত। মূলত একটি বিস্তৃত বহু-স্তরের কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছিল। ডেরিনকুয়ু জনসংখ্যা ছিল ২০,০০০ জন বাসিন্দার মতো ছিল বলে ধারণা করা হয়।
এছাড়াও, এই শহরটি সম্পর্কে ৩৭০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে গ্রীক সৈনিক ও ইতিহাসবিদ জেনোফোন সর্বপ্রথম তার ‘এনাবেসিস’ নামক একটি বই লেখেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পঞ্চম ও দশম শতকের অস্তিত্ব পান বিভিন্ন আলামত থেকে। চতুর্দশ শতাব্দীতে খ্রিস্টানরা দুর্ধর্ষ মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এই শহরে আশ্রয় নিতেন। এমনকি ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলিম শাসকগণ কাপাডোসিয়ান ও গ্রীকদের ধরে এনে এখানেই নির্যাতন করতেন। ফলে তৎকালীন সময়ে এই শহর অটোমান সাম্রাজ্যের টর্চার সেল হিসেবেই পরিচিতি পায়।
শহরের গঠন
ডেরিনকুয়ু শহরের স্ট্রাকচার আর দশটি শহরের মতো নয়! জেনে অবাক হবেন যে, আঠারো তলার শহর ছিল এটি। শহরটিতে অন্য সব শহরের মতো বাড়িঘর, চার্চ, কবরস্থান, স্কুল, কুয়ো, আস্তাবল, সবকিছুই ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক এই শহর থেকে অনেক শিলালিপি আবিষ্কার হয়েছে। এগুলো বিলুপ্ত ফ্রিজিয়ান ভাষায় লেখা হয়েছে।
এমনকি আরব-বায়জেন্টাইনের বিভিন্ন যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরের বাসিন্দারা বিশাল বাঙ্কারও ব্যবহার করতেন বলে ধারণা করা হয়। এখানকার সুড়ঙ্গগুলো গ্রিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। টানেলগুলোতে অনেকগুলো চার্চ ও চ্যাপেল রয়েছে।
এছাড়াও, ভূগর্ভস্থ শহর হলেও গবাদিপশু থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখার ব্যবস্থা ছিল এখানে। তুরস্কের প্রাচীন আনাতোলিয়ান সভ্যতার অংশ এই শহর। বিস্ময়কর হলেও স্থাপত্যের মধ্যে উন্নতির মারাত্মক ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায় এখানে। এই পাতাল শহরের স্থানীয়দের সভাস্থলগুলো ভূপৃষ্ঠের ৬০ থেকে ৮০ মিটার নিচে অবস্থিত এবং এর স্থাপত্য নকশা খুবই আকর্ষণীয় যা বেশ আশ্চর্যজনকও বটে। এই সভাস্থলগুলোর দেয়াল নরম আগ্নেয়শিলা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
আনাতোলিয়ায় উত্তাল গ্রীষ্মের দিনগুলিতে, ডেরিনকুয়ুর বাসিন্দারা সম্ভবত সেই সময়ের সাধারণ শহরবাসীদের চেয়ে বেশি আরামদায়কভাবে বসবাস করতো এই গুহাতে। যদিও গুহায় সূর্যালোক একটুও পৌঁছাতো না হয়তো।
এই শহরে ভূগর্ভস্থ শ্যাফ্ট থেকে পানি সরবরাহ করা হতো বলে ধারণা করা হয়। ছবিতে দেখানো এই কূপটি সম্ভবত ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-পৃষ্ঠ উভয়ের বাসিন্দাদের জল সরবরাহ করতো। পানি সরবরাহ নিচ থেকে নিয়ন্ত্রিত ছিল, নীচের তলগুলি উপরের স্তরে সরবরাহ বন্ধ করতে সক্ষম ছিল, যা কূপের বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতো।
যখন বিপদ ঘনিয়ে আসতো, তখন বাসিন্দারা ভূগর্ভস্থে লুকিয়ে যেতো, টানেলগুলোতে প্রবেশের সব পথ বৃত্তাকার পাথরের দরজা দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলতো এবং বিপদ পুরোপুরি কাটিয়ে না উঠা পর্যন্ত পর্যাপ্ত খাদ্য নিয়ে এবং গৃহপালিত পশুর সাথে বসবাস করতো। এছাড়াও, বাসিন্দারা একসময় এটিকে পালানোর পথ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছিল।
এই টানেলগুলো শত শত গুহা-সদৃশ আশ্রয়কেন্দ্রকে সংযুক্ত করেছে, যা আশ্রয়কেন্দ্র এবং গীর্জা, বাজার, সাম্প্রদায়িক সভা এলাকা এবং স্কুলের মতো জনসাধারণের এলাকা হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। মশাল দিয়ে আলোকসজ্জাও করা হয়েছিল সেই সময়ে।
ক্যাপাডোসিয়া, মধ্য তুরস্কের একটি অঞ্চল, এখানে ডেরিনকুয়ু ছাড়াও ২৫০টিরও বেশি ভূগর্ভস্থ শহর খনন করা হয়েছিল সেই সময়ে, সেইসাথে অনেক গুহা-গির্জাও রয়েছে এখানে।
তবে ২০১৩ সালে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাদেশিক রাজধানী নেভশেহিরে বাইজেন্টাইন যুগের পাহাড়ের চূড়ার দুর্গের নীচে একটি নতুন ক্যাপাডোসিয়ান ভূগর্ভস্থ শহর আবিষ্কার করেছিলেন। একে ডেরিনকুয়ু-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধারণা করা হয়। এটি ডেরিনকুয়ু থেকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বড়।
প্রকৃতপক্ষে, ডেরিনকুয়ু একটি ৫ কিমি লম্বা (৩ মাইল) টানেলের মাধ্যমে কায়মাকলি নামক কাছাকাছি আরেকটি ভূগর্ভস্থ শহরের সাথে সংযুক্ত ছিল, যদিও টানেলের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ার পরে এটি এখন অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা
এই শহরটিতে বিভিন্ন দিক থেকে প্রায় ৬০০টি প্রবেশপথ রয়েছে। দোতলায় খিলান দেয়া বড় ঘরগুলো স্কুল হিসাবে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ স্তরে রয়েছে লম্বা সিঁড়ি; যা পাঁচ তলার চার্চে যাওয়ার পথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
প্রতিটি প্রবেশপথে ভারী পাথরের দরজা রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি তলায় আলাদা আলাদা সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। একটি ৫৫ মিটার গভীর কুয়াও রয়েছে।
এখান থেকেই এই শহরের বাসিন্দারা পানি সরবরাহ করতো যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই গুহাগুলোতে জীবনযাপনের যাবতীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল। পাতাল শহরে বায়ু চলাচলের জন্য প্রায় ১ হাজার ৫০০টি চোঙা ছিল। এছাড়াও, অসংখ্য সুড়ঙ্গ, গলি ও রাস্তা তৈরি করা হয়েছে; এমনভাবে যা যেকোনো মানুষের কাছেই শহরটি একটি জটিল বিন্যাস বলে মনে হয়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা এই যে, এতো বছর পরেও মাটির নিচের এই শহরটি এখনো বেশ ভালোভাবে টিকে রয়েছে। শহরের ভেতরের অবকাঠামো এখনো অনেক মজবুত। পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য খুবই আকর্ষণীয় ডেরিনকুয়ু। এই শহরটি একবার নিজের চোখে দেখার জন্য প্রতি বছর বহু পর্যটক সেখানে যান।
Feature Photo: iStock Sources: 01. DERINKUYU, THE EXTRAORDINARY UNDERGROUND CITY OF TURKEY. 02. Deep Inside Derinkuyu Underground City. 03. Derinkuyu: the ancient underground city, once home to 20,000 people. 04. Derinkuyu: Mysterious underground city in Turkey found in man’s basement. 05. Derinkuyu Underground City.