ডেড সি: মৃতের খেতাব নিয়ে বেঁচে থাকা এক সাগরের আখ্যান

401
0

ডেড সি বা মৃত সাগর নামটি শুনেনি, বর্তমান পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জর্ডান ও ইসরাঈলের মাঝে অবস্থিত এই সাগরটিকে কেউ বলে ডেড সি আবার কেউবা বলে মৃত সাগর। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ লূত সাগর নামেও ডাকে। আরবদের কাছে এটি ‘বাহরুল মায়্যিত’ নামে পরিচিত।

মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান, ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের সীমান্তে অবস্থিত এই সাগরের পূর্বে জর্ডান এবং  পশ্চিম ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের ‘পশ্চিম তীর’।

মৃত সাগরের অবস্থান। Image source : Encyclopedia Britannica

মৃত সাগর নিয়ে একটি প্রচলিত ধারণা হলো, এই সাগরের পানিতে কখনো মানুষ ডুবে যায় না। এমনকি এই সাগরে কোনো জলজ প্রাণিও বাঁচেনা। যে কেউ ইচ্ছে করে ডুবতে চাইলেও এই সাগরে ডুবে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে, ভেসে অথবা শুয়ে থাকা যাবে অনায়াসে।

এর পেছনে কারণ কি? কেন এই সাগরে কোনো প্রাণি বেঁচে থাকতে পারেনা। আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় মৃত সাগরের সেসব অজানা রহস্য।

ডেড সি একটি অদ্ভুত এবং রহস্যজনক নাম। নামটি প্রথম শুনলে যে কারোরই চমকে যাওয়ার কথা। এই নামটি শোনার পর মানুষ মাত্রই মনে প্রশ্ন জাগবে—একটা সাগর কিভাবে মৃত হতে পারে!

মৃত সাগরের জলে ভেসে থাকা পর্যটক। Image Source : Saraahah.com

বস্তুত, অতিরিক্ত লবণ থাকার কারণে এখানকার পানির ঘনত্ব খুবই বেশি। অন্যান্য সাগরের চেয়ে প্রায় ৮.৬ গুণ বেশি। যার ফলে এই সাগরে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণি বেঁচে থাকতে পারেনা। তাই একে মৃত সাগর বলা হয়।

তাছাড়া ডেড সি’র পানির উচ্চ প্লবতা শক্তির কারণে এই সাগরে কোনো কিছু ডুবে না। জলের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় মানুষ সাঁতার না কেটেও সহজেই ভেসে থাকতে পারে।

মাত্রাতিরিক্ত লবনাক্ততার জন্য হিব্রুতে এই সাগরকে সল্ট সি নামে ডাকা হয়। গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে এর লবনাক্ততাও বৃদ্ধি পায়। তবে বর্ষাকালে পানির পরিমাণ বাড়লে লবনাক্ততা কিছুটা হ্রাস পায়। তখন অল্প কিছু ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জাতীয় অনুজীব জন্মে।

লবণ জমে তৈরি হওয়া আশ্চর্য সুন্দর স্তম্ভ। Image Source : pinterest.com

নামে সাগর হলেও ডেড সি আদতে কোনো কোনো সাগর নয়। এটি একটি মাঝারি আকৃতির হ্রদ। যার সূচনা হয়েছিল আনুমানিক ২ থেকে ৩.৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে। প্রাচীনকালে এই সাগর পরিচিত ছিল ‘স্টিংকি সি’ নামে।

এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১,২৪০ ফুট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৩০ মিটার নিচে অবস্থিত এই হ্রদকে পৃথিবীর নিম্নতম স্থলভূমি হিসেবেও গণ্য করা হয়।

এই হ্রদের পানি কখনো বাইরে প্রবাহিত হয় না। কারণ এর তিনদিকই পাহাড় দিয়েই ঘেরাও। একটি মাত্র পথ খোলা আছে যেখান দিয়ে অন্যান্য নদী ও ঝর্ণার পানি হ্রদে প্রবেশ করতে পারে। তাই এখানে পানি প্রবেশ করতে পারে ঠিকই কিন্তু বের হতে পারে না।

ডেড সি’র সৌন্দর্য। Image Source : pinterest.com

বিচিত্র সব খনিজ পদার্থে ভরপুর এই সাগরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম। যা সারা পৃথিবীর কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl), ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড (MgCl2), ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, সালফার, ব্রোমাইন, কলগেন ও অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণ।

তবে মৃত সাগরের জলে থাকা এসব খনিজ পদার্থগুলোর সাথে অন্যান্য সাগরের খনিজ পদার্থের প্রচুর পার্থক্য আছে। প্রাচীনকাল থেকেই এই সাগরের খনিজ লবণ সুগন্ধি ও প্রসাধনী তৈরীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

কথিত আছে মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রা, যিনি কিনা বিখ্যাত ছিলেন তার ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের জন্য, তিনি নিজেও রূপচর্চার জন্য মৃত সাগরকে বেছে নিয়েছিলেন। এবং মৃত সাগরের তীরে প্রসাধনী কারখানা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মৃত সাগরের লবনাক্ত কাদা গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটক। Image Source : Jordan times

মৃত সাগর বর্তমানে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম স্থলভূমি হওয়ায় এখানে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাব কম। যা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

পর্যটকরা প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে এই সাগরের কাদা গায়ে মেখে সূর্যস্নান করে। তাছাড়া মৃত সাগরের লবণ অন্যান্য সাগরের তুলনায় বেশি তেতো হওয়ার কারণে এটি বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ নিরাময়ে কার্যকর। যেমন: ব্রণ, ফুস্কুড়ি, খুশকি ইত্যাদি।

মৃত সাগরের জলে ভেসে পত্রিকা পড়ছেন এক পর্যটক। Image Source : The Sunday times

কথিত আছে, মৃত সাগরের জলে গোসল করলে চর্মরোগ ভালো হয়ে যায়। এই সাগরের লবণাক্ত কাদা নানা ধরনের চর্ম রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর ‘হাওয়া বদল’ বা বায়ু পরিবর্তন করতে অনেকে এই সাগর পরিদর্শনে বের হোন। এর আবহাওয়া শ্বাসকষ্ট ও মানসিক চাপ কমাতে ভীষণ কার্যকর।

মৃত সাগরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এই হ্রদ থেকে প্রচুর পরিমাণে পিচ নির্গত হয়। যা প্রাচীনকালে মিশরের মমি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রাচীন গ্রিকরা একে লেক অফ এসফালটাইটস বা পিচের হ্রদ নামে ডাকতো।

 

ইসলাম ধর্মমতে, আনুমানিক ৪৫০০ বছর পূর্বে মৃত সাগরের তীরে বাস করতো হজরত লূত (আ:) এর কওম। যারা সীমালঙ্ঘনের দিক দিয়ে পূর্বের গযবপ্রাপ্ত সব জাতিগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ও বিলাসিতার আতিশয্যে তারা জড়িয়ে পড়েছিল সমকামিতার মতো জঘন্য অপরাধে। লূত (আ:) তাদেরকে এই জঘন্য অপরাধ থেকে দূরে থাকতে বলেন।

কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। লূত (আ:) এর বারবার সাবধান বাণী সত্ত্বেও তার কওম এই জঘন্য অভ্যাস পরিত্যাগ করেনি। বরং তাদের মধ্যে এই আচরণ দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। যার ফলাফল স্বরূপ মহান আল্লাহ ‘সডম’ ও ‘গোমাররাহ’ নামের লোকালয় দুটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস করে দেন। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটিই বর্তমানে মৃত সাগর নামে পরিচিত।

Image source : pinterest

কাওমে লূত ছিল পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা তাদের যৌন ক্ষুধা চরিতার্থের জন্য পুরুষদের ব্যবহার করতো। আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে সূরা আরাফের ৮০-৮১ আয়াতে উল্লেখ করেন—

আর আমি লূতকে পাঠিয়েছিলাম, তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের আগে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামতৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো, তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।

কিন্তু তারা লূতের সাবধান বাণী না শুনে অর্থ সম্পদের বড়াই করে আর নৈতিকতার দিক দিয়ে আরো অধঃপতনের দিকে যেতে থাকে। সমকামিতা, লুটপাট, ওজনে কম দেওয়া, খুনোখুনি, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি ছিল তাদের দৈনন্দিন কাজ। আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন লূত (আ:) তাদেরকে ফেরাতে পারেননি, তখন আল্লাহ তায়ালা লূত জাতিকে ধ্বংসের জন্য হজরত জিবরাঈল (আ:), হজরত ইসরাফিল (আ:) এবং হযরত মিকাঈল (আ:)-কে পাঠালেন।

মৃত সাগরের আশেপাশের নয়াভিরাম দৃশ্য। Image Source : Sutter stock

এই তিনজন ফেরেশতা ছেলে মানুষের রূপ নিয়ে লুত (আঃ) এর বাড়িতে পৌঁছান। বিষয়টি গোপনে হজরত লূত (আ:) এর স্ত্রী এলাকার যুবকদেরকে জানিয়ে দিলে, যুবকের দল রাতের মতো মধ্যে হজরত লুত (আ:) এর বাড়িতে প্রবেশ করে। ফেরেশতারা তখন হজরত লূত (আ:) এর কাছে তাদের পরিচয় দেন। আর বলেন যে, ভোর হওয়ার আগেই যেন হজরত লূত (আ:) তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই জনপদ ছেড়ে চলে যান। এবং কেউ যেন পেছনে ফিরে না তাকায়। ফেরেশতারা লূত (আ:) এর স্ত্রীকে নিয়ে যেতে বারণ করেন। কারণ তার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ফয়সালা নিয়ে ফেলেছেন।

শেষ রাতে হজরত লূত (আ:) এবং তার স্বজনেরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। সেই সাথে অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর পাথর নিক্ষেপ চলতে থাকে এই সীমালঙ্ঘনকারী কাওমের উপর। জমিনকে উল্টিয়ে তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এক সময়ে এই প্রচণ্ড ভূমিকম্প শেষ হয়।

সেই সাথে মাটির সাথে মিশে যায় ‘সডম’ ‘গোমাররাহ’ ও আশপাশের অন্যান্য পাপিষ্ঠ নগরী এবং এ সকল জনপদের চার লাখ মানুষ। যা বর্তমানে ডেড সি বেসিন বা মৃত সাগর পরিচিতি পেয়ে আসছে।

অদ্ভুত সুন্দর মৃত সাগর। Image Source : Shutter stock

ডেড সি’র উৎপত্তি উক্ত অঞ্চলে বসবাস কারা জাতি সমূহের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হলেও, বর্তমানে ডেড সি উক্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই সাগরকে কেন্দ্র করে জর্ডান ও ইসরায়েলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়াও এখানকার খনিজ সম্পদগুলো আহরণের জন্য গড়ে উঠছে বিভিন্ন কল কারখানা, দালানকোঠা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। যার ফলে এর নিকটবর্তী দুটি দেশই লাভবান হচ্ছে।

ডেড সি বর্তমানে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিগনিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার ভ্রমণ প্রিয় মানুষ রোজ এই সাগরের তীরে অবকাশ যাপনের জন্য আসে।

পর্যটকরদের কেউ কেউ ডেড সি’র পানিতে নেমে সাতার কাটেন, ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ বা সাগরের পানিতে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়েন। কেউ ফেসবুক অথবা ইউটিউবে সময় কাটান। আবার কেউ বা করেন রূপচর্চা।

ডেড সি’র তীরে গড়ে উঠা পর্যটন কেন্দ্র। Image Source : Shutter stock

ডেড সি’র নিকটবর্তী দুটি দেশই তাদের কলকারখানার জন্য প্রয়োজনীয় পানি এই সাগর থেকে নেওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে এর গভীরতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। পরিবর্তিত হয়েছে এর আয়তন। বিগত ৫০ বছরে মৃত সাগর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার বেশি নিচে নেমে গেছে। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে এই জলের লবণাক্ততার পরিমাণও। অপরিকল্পিতভাবে খনিজ সম্পদ আহরণের কারণে মৃত সাগর এখন সত্যিকার অর্থেই মরতে বসেছে।

Feature Image: 
References: 

1. Dead-Sea. 
2. mysteries-of-the-dead-sea. 
3. dead-sea-dead. 
4. dead-sea-jordan.