কোহিনুরের ইতিহাস আর ক্ষমতার পালাবদলে এর অবস্থান ও অধিকারের গল্প তো অনেক হলো। কিন্তু এই কোহিনুরেরই আত্মীয় বলে পরিচিত আছে আরেক হীরা। নাম তার দরিয়া-ই-নুর। স্বাভাবিকভাবেই, এর ইতিহাসও সরলরৈখিক নয়। আজ এই ইতিহাসের চোরাগলিতেই উঁকি দিবো হারিয়ে যাওয়া রত্নের সন্ধানে।
দরিয়া-ই-নুর কেবল বিশ্বের প্রাচীনতম গোলাপি হীরাই নয়, এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বৃহত্তম গোলাপি হীরা। যা বর্তমানে সুরক্ষিত আছে তেহরানের ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইরানের’, জাতীয় ইরানি জুয়েলসের ট্রেজারি জাদুঘরে।
নামের উৎপত্তি
ফার্সি ভাষায় দরিয়া-ই-নুর মানে ‘আলোর সাগর বা মহাসাগর’ (দরিয়া-সমুদ্র বা মহাসাগর, নুর-আলো)। ভারত থেকে লুণ্ঠিত হওয়ার পরে এই নামটি সম্ভবত পার্সিয়ানরা দিয়েছিল। এডউইন স্ট্রিটার তার বই, ‘দ্য গ্রেট ডায়মন্ডস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৮৮২)-এ বলেছেন, “দরিয়া-ই-নুর সবচেয়ে বিশুদ্ধ পানির একটি দুর্দান্ত পাথর এবং এর অতুলনীয় দীপ্তির জন্য এটি সম্পূর্ণরূপে গর্বিত এই শিরোনামের যোগ্য।”
বৈশিষ্ট্য
দরিয়া-ই-নুর একটি ফ্যাকাশে গোলাপি, টেবিল-কাট হীরা; যা লাস্ক (Lasque) নামেও পরিচিত। এর আনুমানিক ওজন ১৮৬ ক্যারেট। এর সঠিক ওজন নির্ণয় সম্ভব না, কারণ হীরাটিকে ক্ষতি না করে ভেঙে ফেলা যাবে না। সুতরাং, ১৮৬ ক্যারেটের ওজন সম্ভবত এর মাত্রা এবং ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞদের শুধু একটি অনুমান।
কিছু বিশেষজ্ঞ অনুমান করেছেন যে, এর ওজন ১৭৫-১৯৫ ক্যারেটের মধ্যে। এডউইন স্ট্রিটারের মতে, লন্ডনে দরিয়া-ই-নুরের ওজন ঠিক ১৮৬ ক্যারেট, যা তিনি ‘কোহিনুর’ এর আসল ওজনের সাথে তুলনা করে নিশ্চিত করেছেন।
GIA (Gemological Institute Of America) অনুসারে, এর মাত্রা ৪১.৪০ x ২৯.৫০ x ১২.১৫ মি.মি.। পাথরটির স্বচ্ছতা জানা যায়নি, তবে গোলকোন্ডা হীরা হওয়ার কারণে এর স্বচ্ছতা অবশ্যই ব্যতিক্রমী হতে হবে। দরিয়া-ই-নুর সম্ভবত একটি টাইপ IIa হীরা, যা নাইট্রোজেন-মুক্ত বা এতে নাইট্রোজেন এতো অল্প পরিমাণে থাকে যে শনাক্ত করা যায় না।
ইতিহাস
দরিয়া-ই-নুরকে খুব পুরানো হীরা বলে মনে করা হয়। এটি সম্ভবত ভারতে রাজত্বকারী পূর্ববর্তী রাজবংশের সম্পত্তি। কাকাতিয়া রাজবংশ আনুমানিক (৯৫৬-১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত শাসন করেছিল। বলা হয় যে, হীরাটি তাদের দখলে ছিল যা পরবর্তীকালে, খিলজি রাজবংশ তাদের কাছ থেকে (১২৯০-১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ) লুট করেছিল।
ধরা হয়ে থাকে, এটি মোঘল বাদশা শাজাহানের সিংহাসনে সংযুক্ত ছিল। এবং ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করলে, অনেক মূল্যবান রত্নের সাথে এটিও সাথে নিয়ে যায়।
কিন্তু এই সমীকরণ বদলে যায় যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসে। ইতিহাসের একটি বিবরণ অনুসারে, মহান এই গোলাপি হীরাটি ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে আসে মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের তোশাখানা বা কোষাগার থেকে। পরবর্তীতে, এটা ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। এমনকি এটি ১৮৫১ সালের ‘দ্য গ্রেট এক্সিবিশনে’ প্রদর্শিত হয়েছিল বলেও জানা যায়।
ব্রিটিশ সরকারের বিবেচনার ভিত্তিতে, দরিয়া-ই-নুরকে ১৮৫২ সালে নিলামে দেওয়া হয়। খাজা আলিমুল্লাহ তখন হীরাটি কিনে ভারতে ফিরে আসেন। যেটি কলকাতায় ১৯১২ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ এবং রাণি মেরি দেখেছিলেন।
দেশভাগের পর, এর ঠিকানা হয় আধুনিক বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। এটি সোনালী ব্যাংকের একটি ভল্টে রাখা হয়েছিল এবং বিশেষজ্ঞদের একটি দল এর সত্যতা যাচাই করেছে বলেও জানা গেছে।
তারপরও সোনালী ব্যাংকের ভল্টের হীরা নিয়ে আরেকটি রহস্য রয়ে গেছে। কেননা এর কোনো ছবি পাওয়া যায়নি সে সময়ের, এমনকি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও দেখেননি এই হীরা।
ভল্ট থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথাও শোনা যায় একবার। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায়নি।
কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে, ইরানে হীরা কীভাবে পৌঁছেছে তার উত্তর পাওয়া যায়নি। হতে পারে, ইরান থেকে হীরা কখনো বাইরে যায়নি। হতে পারে, দুইরকম গোলাপি হীরা ছিল।
গ্রেট টেবিল ডায়মন্ড
১৯৬৬ সালে টরন্টোর ‘রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামে’ কানাডিয়ান বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, দরিয়া-ই-নুর এবং নুর-উল-আইনের সাধারণ উৎপত্তি নির্দেশ করেছে ‘গ্রেট টেবিল ডায়মন্ডের’ দিকে। এর বর্ণনা পাওয়া যায়, ট্যাভার্নিয়ারের ‘ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে।
ফরাসি পরিব্রাজক এবং রত্নব্যবসায়ী জিন ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার (Jean Baptiste Tavernier), ১৭ শতকে ভারতে ছয়বার ভ্রমণ করেছিলেন। ১৬৪২ সালে সফরের সময়, তিনি দক্ষিণ ভারতের গোলকোন্ডায় খুব বিরল, ফ্যাকাশে গোলাপি হীরা দেখার সুযোগ পান। ২৪২ ক্যারেট ওজনের এই বিশাল হীরাকে, তিনি ‘ডায়ামান্টা গ্র্যান্ডে টেবিল’ (Diamanta Grande Table) বা ‘গ্রেট টেবিল ডায়মন্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন।
পাথরটি পরবর্তীকালে শাহজাহানের দরবারে প্রবেশ করেছিল বলে মনে করা হয় এবং সম্ভবত মহান মোগল সম্রাটের ময়ূর সিংহাসনে শোভা পেয়েছিল। সম্ভবত ‘গ্রেট টেবিল ডায়মন্ড’ পরবর্তীতে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা দুর্ঘটনাক্রমে দুটি অসম অংশে বিভক্ত হয়েছিল। এর বড় অংশটি দরিয়া-ই-নুরে রূপান্তরিত হয় এবং ক্ষুদ্র অংশটি নুর-উল-আইনে পরিণত হয়।
কানাডিয়ান বিশেষজ্ঞদের একটি দল ১৯৬৫ সালে ইরানের ইম্পেরিয়াল জুয়েলসের উপর গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ‘দরিয়া-ই-নুর’ ট্যাভার্নিয়ারের দেখা ‘গ্রেট টেবিল ডায়মন্ড’ এর প্রধান অংশ এবং ৬০-ক্যারেট, ডিম্বাকৃতির গোলাপি উজ্জ্বল, ‘নুর-উল-আইন’ একই হীরার ক্ষুদ্র অংশ।
ইরানের রাজবংশে দরিয়া-ই-নুর
দরিয়া-ই-নুর এবং নুর-উল-আইন এই দুটি হীরা ইরানের মুকুট রত্নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হীরা। ইরানের ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাসের সাথে, দরিয়া-ই-নুরেরও হাতবদল হয়েছে। প্রতিবারই পেয়েছে নতুন স্থান এবং প্রকাশ পেয়েছে রাজবংশের গৌরব হিসাবে।
ফত আলী শাহ (১৭৯৭-১৮৩৪), মারা যাওয়ার আগে তার নাম এই হীরার একটি দিকে খোদাই করা হয়েছিল। তিনি দরিয়া-ই-নুর এবং ১৪৬-ক্যারেটের তাজ-ই-মাহ হীরাকে প্রধান হীরা হিসাবে এক জোড়া ব্রেসলেটের মধ্যে যুক্ত করেছিলেন।
ফত আলী শাহ ছিলেন মূল্যবান রত্ন পাথরের সংগ্রাহক। তার শাসনামলে, ব্রিটিশ প্রশাসক এবং কূটনীতিক স্যার জন ম্যালকমকে পারস্যের দরবারে দূত হিসাবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি তার এই অভিজ্ঞতা তার ‘স্কেচ অফ পারস্য’(১৮২৭) বইতে উল্লেখ করেছেন।
শাহ নাসের আল-দীন (১৮৪৮-১৮৯৬) দরিয়া-ই-নুর উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। দরিয়া-ই-নুর, ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’ (৫৫৮-৫২৯ খ্রিষ্টপূর্ব) এর মুকুট অলঙ্কৃত করা রত্নগুলোর মধ্যে একটি ছিল বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রথমে দরিয়া-ই-নুরকে একটি আর্ম ব্যান্ডে পরতেন। তারপর ব্রোচ হিসাবে এবং পরে একটি আইগ্রেটে পরতেন। অবশেষে এর একটি উপযুক্ত মাউন্ট তৈরি করে, আরও ৪৫৭টি ছোট হীরা এবং ৪টি রুবি দিয়ে একে সেই মাউন্টে স্থাপন করেন।
মোজাফফর-আল-দীন শাহ (১৮৯৬-১৯০৭), ১৯০৩ সালে ইউরোপ সফরের সময় টুপির সজ্জা হিসাবে দরিয়া-ই-নুর পরেছিলেন। ন্যাশনাল কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলিকে দমন করার জন্য মোহাম্মদ আলী শাহের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, তিনি তেহরানে রাশিয়ান লেগেশনে আশ্রয় নেন। তার সাথে দরিয়া-ই-নুর সহ অন্যান্য মুকুট রত্নগুলোও ছিল, যা পরবর্তীতে ইরানে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
১৯২১ সালে রেজা খান, পারস্য কাসেক ব্রিগেডের একজন অফিসার অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি প্রথমে যুদ্ধমন্ত্রী এবং পরে আহমেদ শাহ কাজারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯২৫ সালে আহমেদ শাহ কাজারকে পদচ্যুত করে, নিজেকে ‘রেজা শাহ পাহলভি’ উপাধি দেন। ১৯২৬ সালে রাজ্যাভিষেকের সময় তার সামরিক টুপির সজ্জা হিসাবে দরিয়া-ই-নুর হীরা পরেন।
দরিয়া-ই-নুর হীরার ইতিহাসে ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়না। এর বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায় বিভিন্ন উৎস থেকে। কোন অংশটি সঠিক, আর এর সময়রেখা কী ছিল; সেটা এখনও জানা যায়নি। কেননা, ইতিহাসের বিভিন্ন সময় অনেকেই একই নাম ব্যবহার করে চড়া দামে হীরা বিক্রির চেষ্টা করেছে। আবার, গৌরবের অংশ হিসাবে এর অধিকারও সবাই চায়। তাই, কোনো একটি ইতিহাস যেমন ভুল হতে পারে, তেমনি একইরকম দুটি হীরা দুই স্থানে রয়েছে তাও হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে এই রহস্য উন্মোচন হলেও হতে পারে।
Feature Image: voices.shortpedia.com References: 01. Internetstones.com/Darya-I-Nur-Diamond-Famous-Jewelry. 02. Blog.Arpegediamonds.com/Darya-Ye-Noor. 03. Tribuneindia.com.