প্রিন্স অফ পার্সিয়া গেমটার সাথে আমাদের অনেকেরই পরিচিতি আছে। বাস্তবে কি কোন প্রিন্স ছিলেন পার্সিয়া সাম্রাজ্যের? নাকি কেবলই কাল্পনিক উপাখ্যান? বাস্তবের পারস্যের প্রিন্স বা রাজা ছিলেন সাইরাস দ্য গ্রেট (Cyrus-the-great)। বাস্তবের পারস্যের রাজাকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। যদিও তাঁর জন্মসাল নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে, তবুও তাঁর কর্ম নিয়ে সেটা খুব কমই আলোচনা দেখা যায়। বাইবেলে সাইরাসের ব্যাপারে ইঙ্গিত থাকলেও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি সেইভাবে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৭৬ অথবা ৫৯০ সালের দিকে তাঁর জন্ম। এই বিষয়ে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। আর এর পেছনে এক অদ্ভুত কারণ আছে। ছোট থেকেই আর আট-দশ জন সাধারণ শিশুর চাইতে তিনি ছিলেন একদমই আলাদা। এস্টাজেস, সাইরাসের নানা একরাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুসারে, এই সাইরাস হবে এস্টাজেস এর পতনের কারণ। যাই হোক! আতঙ্কিত রাজা জল্লাদ ডেকে নাতিকে মেরে ফেলতে বললেন। কিন্তু জল্লাদের মনে মায়া হলো।
সে না মেরে অন্য আর একজনকে দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই খবর আর কেউ জানলো না। যাইহোক, জল্লাদকে খুন করতে বলার পর অনেক বছর পার হয়ে যায়। এক রাখাল সাইরাসকে ১০ বছর পালন করেন। এক দশক পর এস্টাজেস সাইরাসের খোঁজ পান, অনেক কিছুতেই মিল পান তাঁর নিজের সাথে, বুদ্ধি, চিন্তা ভাবনা, চেহারা। তিনি বুঝতে পারেন, সাইরাস আসলে কে। তিনি স্বপ্নের কথাকে পাত্তা না দিয়ে সাইরাসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু এটা কি তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল নাকি ভুল?
ঐতিহাসিক হেরেডেটাস এর মত অনুসারে, এই সব তথ্য আমরা জানতে পারি। পারস্যের পিতা সাইরাস দ্য গ্রেট ছিলেন রাজকন্যা ম্যানডেন এবং ক্যাম্বিসেস নামে এক রাজপুত্রের সন্তান। তাঁর জন্মসাল নিয়ে বেশ দ্বিমত রয়েছে। তাঁর সঠিক জন্মতারিখ জানা যায় না, কারণ তাঁর জন্ম থেকে কর্ম সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর।
এবার আসি সাইরাস নামকরণ নিয়ে। পারস্যের পিতা সাইরাস (Cyrus) নামটি নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ আছে। সাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ। এর মূল শব্দ Kourosh/Khorvas. বিখ্যাত ইতিহাসবিদ স্টেসিয়াস এবং প্লুটারক এর মতে, সাইরাস নামটি এসেছে Kuros বা সূর্য থেকে। আধুনিক ইতিহাসবিদ কার্ল হফম্যান বলেছেন, সাইরাস শব্দের অর্থ, শত্রুকে মুখে মুখে অপমান করতে পারে এমন কেউ। আবার অন্য দিকে পবিত্র বাইবেলে তাঁকে কোরেশ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তিনি আধুনিক ফার্সি ভাষায়, সাইরাস, কোরোশ-ই বোজর্গ নামে পরিচিত।
পিতার মৃত্যুর পরে তিনি তাঁর স্থলাভিষক্ত হন। কিন্তু পরিবারে ফিরে আসা এবং মুকুট মাথায় দেয়ার মধ্যে যে সময়, সেই সময় নিয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। তবে গ্রীক সৈন্য জেনোফোনের লেখায় প্রথম সাইরাস এবং তাঁর শাসন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর শাসনামলে এত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল সেই সময়ের পারস্যে যার কারণে তাঁকে পারস্যের পিতা বলে অভিহিত করা হয়। ব্যবিলনের উদ্যানের খ্রিস্টানদের তিনি নিজ দায়িত্বে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সেটা খুব সম্ভবত ৫৩৯ থেকে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হবে।
নিজের মেধা আর ক্ষমতার জন্য যেমন সাইরাসকে (Cyrus) খ্রিস্টানদের বাইবেলে খুঁজে পাওয়া যায়, ঠিক তেমন কিছু কিছু মতভেদে মুসলিমদের পবিত্র কুরআন শরীফেও তাঁর দেখা মেলে। সূরা আল কাহাফে বর্ণিত আল যুলকারনাইনের সম্পর্কে যে ধরনের তথ্য পাওয়া যায়, সাইরাস সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, আল জুলকারনাইন হলো আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। আবার কিছু কিছু তথ্য মতে, তিনি সাইরাস। কারণ ন্যায়পরাণয়তা, স্বভাব, রাজ্য জয়, রাজ্য প্রতিষ্ঠা, জনগনের জন্য ভাবনা-চিন্তা এই সব কিছু সাইরাসকে ইঙ্গিত করে।
ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, তিনি প্রায় ৩০ বছর শাসন করেছিলেন। মেডাস বা মিডিস সাম্রাজ্য দখল দিয়ে তাঁর রাজ্য বিস্তার শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি ব্যবিলন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লিডিয়া, একবাটানাসহ নানা রাজ্য একের পর এক জয় করতে থাকেন এবং সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজ্য জয় করবার পর, তিনি সেই রাজ্যের সকল কর্মচারীকে স্ব স্ব কাজে বহাল রাখতেন। যার ফলে সেই কর্মচারীরাও বেশ খুশি থাকতো।
তিনি যখন ব্যবিলন জয় করেন, তার ইচ্ছানুসারে একটি সিলিন্ডার নির্মাণ করা হয়। এই শিলাপ্রস্তরে সাইরাস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এই শিলাতে লিপিবদ্ধ আছে সাইরাসের পূর্ববর্তী ব্যবিলনের রাজা নেবুনিডাস কিভাবে প্রজাদের উপর অত্যাচার করতো ও নিজের খেয়ালখুশি মত চলতো। সাইরাস তাঁদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। বলা হয় মারদুক নামে এক দেবতাকে অস্বীকার করেছিল এই নেবুনিডাস। যার ফলশ্রুতিতে, মারদুক ক্ষুব্ধ হন এবং দয়াপরবশ হয়ে সাইরাসকে প্রেরণ করেন। সাইরাস তাঁদের জানান, তিনি নিয়মিত মারদুকের পূজা করেন এবং ব্যাবিলনের সকল দাসদের তিনি মুক্ত করেছেন। এইসব তথ্য সহ আরো নানা তথ্য এই সিলিন্ডারাকৃতি শিলাখন্ডে পাওয়া যায়। খন্ডটি সাইরাসের সিলিন্ডার নামে প্রচলিত।
শেষ দিকে তিনি মেসাগ্যাটা নামে এক জাতিকে আক্রমণ করেন। মধ্য এশিয়ার এই দেশটিকে আক্রমনের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। মতান্তরে, রানী টমিরস শিরচ্ছেদ করে তাকে মেরে ফেলেন। রাণী টমিরস তাঁর বীরত্বের জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন। সাইরাসের জীবনের প্রথম দিকের এবং শেষ কিছু বছর বেশ ধোঁয়াশায় ঢাকা। খৃষ্টপূর্ব ৫৩০ সালে তিনি মারা যান, আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল শত্রুর হাতেই।
তবে যেখানেই আর যেভাবেই মৃত্যু হোক, তাঁর পুত্র তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেন এবং প্যাসারগাদেই নামে একটি অঞ্চলে তাঁকে সমাধিস্ত করেন। তাঁর পুত্র তাঁর স্থলাভিষক্ত হবার পরে মিশর পর্যন্ত তাঁদের রাজ্য বিস্তৃত হয়। সাইরাসের মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পর পর্যন্ত তাঁদের পরিবার এবং শাসন ব্যবস্থা ছিল। এশিয়া মাইনর, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়া জুড়ে ছিল সাইরাসের রাজ্যের বিস্তৃতি।
আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন পারস্যের পিতা(Cyrus)। জনগণের সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে সব দিকে তিনি নজর রেখেছিলেন। জনগনের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। বাস্তবের এই প্রিন্স অফ পারসিয়ার জীবন নিয়ে কেন এত কম তথ্য পাওয়া যায়, সেটা এক অদ্ভুত ঘটনা বটে।
হেরাডেটাস কিংবা জেনোফেন লিখে গেছেন বটে, তবুও তাঁর জীবনের প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর একদম তথ্যবিহীন। কিন্তু কেন? তিনি কি লিখতে বারণ করে গিয়েছিলেন নাকি কেউ সরিয়ে দিয়েছিল? কিছু টুকরো সূত্র মিলিয়ে মিলিয়ে এই বিরাট রাজা আর রাজ্যের গল্প খুঁজে বের করা থ্রিলার উপন্যাসের চাইতে কম কিছু নয়।
Feature Image: worldhistory.org
তথ্যসূত্র:
01. Cyrus the Great.
02. Tomyris, The Female Warrior and Ruler Who May Have Killed Cyrus the Great.
03. Cyrus the Great.
04. Who was Cyrus the Great?