আধুনিক ইউরোপের ধরণটাই একেবারে আলাদা। শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে উদার মনোভাব আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুঁজি করে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে অনন্য উচ্চতায়। তবে এর শুরুটা কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না। নানা শাসকের হাত ঘুরে, চড়াই উতরাই পেরিয়ে, বিপ্লব, সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে এসেছে আজকের অবস্থানে।
আর এর পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন কন্সট্যান্টাইন। তাকে বলা হয় প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট। যদিও এই নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। তিনি একজন ব্যাপ্টিস্ট ছিলেন। যদিও এটি কেবল প্রত্যক্ষ করা যায় তার মৃত্যুশয্যায়। তিনি (৩০৬-৩৩৭) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান শাসক হিসেবে সিংহাসনে ছিলেন।
পুরো নাম ফ্লেভিস ভ্যালেরিয়াস কন্সট্যান্টাইন। জন্ম নেইসাস-এ (বর্তমান সার্বিয়া) ২৭২ খ্রিস্টাব্দে; মতান্তরে ২৮৫ খ্রিস্টাব্দে। তার বাবা কন্সট্যান্টিয়াস এবং মা হেলেনা। কন্সট্যান্টিয়াস ছিলেন মিলিটারি কমান্ডার এবং সম্রাটের দেহরক্ষী। পরবর্তীতে তিনি পশ্চিমের সিজার হন।
কন্সট্যান্টাইনের শৈশব কাটে ইম্পেরিয়াল কোর্টে। সেখানেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সেই সময়টা ছিল বেশ অস্থির। পরধর্মসহিষ্ণুতার বালাই ছিল না। কুসংস্কারে ছেয়ে গিয়েছিল সমাজ। সেই তুলনায় শহরটি বেশ উদার ছিল। তিনি প্যাগান, জিউস সবার সাথেই মিশতেন। ল্যাটিন, সাহিত্য, গ্রীক এবং দর্শন নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ঐ সময়কার বিখ্যাত খ্রিস্টান ল্যাটিন স্কলারের লেকচারে তিনি নিয়মিত যোগদান করতেন।
২৮৫ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্টিয়াস সিজার পদে উন্নীত হন। পরবর্তীতে পিক্টস অব ক্যালেডেনিয়া (স্কটল্যান্ড)-র বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তার মৃত্যুর পর রয়্যাল ট্রুপ কন্সট্যান্টাইনকে অগাস্টাস হিসেবে ঘোষণা করে।
একজন শাসকের বিপরীতে রোম ছিল যথেষ্ট বড়। বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান রোমকে চার শাসকের অধীনস্থ করেন। এদের মধ্যে দু’জন ‘অগাস্টই’ এবং তাদের অধীনে দু’জন ‘সিজার’। পূর্বের শাসক হিসেবে ডায়োক্লেটিয়ানের অধীনে ছিলেন ম্যাক্সিমিয়ান এবং পশ্চিমের শাসক হিসেবে অগাস্টাসের অধীনে ছিলেন কন্সট্যান্টাইন।
গৃহযুদ্ধের সময় কন্সট্যান্টাইন বহু শাসকের বিরুদ্ধে লড়েছেন। এর ভেতর ম্যাক্সিমিয়ানের পুত্র ম্যাক্সেন্টিয়াসও ছিলেন। ৩১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ম্যাক্সিন্টিয়াসের বিরুদ্ধে ইতালির টাইবার নদীর উপর মিলিভিয়ান ব্রিজে অবস্থান নেন।
সে-সময় খ্রিস্ট ধর্ম ততটা প্রসার লাভ করেনি। প্যাগানদের রাজত্ব চলছিল। আর কেউ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে শুনলে তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হত। জেসাস তার অনুসারীদের এক ঈশ্বরের প্রার্থনায় উৎসাহিত করতেন। ক্ষমা ও প্রেমের বাণী শোনান। কিন্তু প্যাগানরা এসব সহজভাবে নিতে পারেনি। তাকে ব্লাসফেমি আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়।
তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে তিনি ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর পুনর্জীবন লাভ করেছেন। তাদের প্রচার এবং প্রার্থণা চলত গোপনে। তবে কন্সট্যান্টাইন শাসক হিসেবে হাল ধরার পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
কন্সট্যান্টাইনের জীবনীলেখক ইসুবিয়াসের মতে, কন্সট্যান্টাইন এবং তার বাহিনী আকাশে একটি আলোকোজ্জ্বল ক্রুশ দেখতে পান। ঐ রাতেই জেসাস তার স্বপ্নে দেখা দেন এবং পুনরায় তাকে এর অর্থ সম্পর্কে অবহিত করেন। এই ঘটনার পর তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের শিল্ডে ক্রুশ খোদাই করার নির্দেশ দেন। তিনি মিলিভিয়ান ব্রিজের বিজয় ঈশ্বর যীশুর নামে উৎসর্গ করেন৷ যদিও আধুনিক বিতার্কিকরা এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। এই ঘটনাকে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারিত বলে মনে করেন।
কন্সট্যান্টাইন ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে ক্রিশ্চিয়ানরা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এবার তারা সে সুযোগ পেল। তবে এর অপব্যবহার করতেও ছাড়েনি। বাগে পেয়ে প্যাগান এবং জিউসদের শাস্তি দেওয়া শুরু করল। যদিও তিনি খ্রিস্টদের উত্থানে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন তথাপি এই ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
তিনি নব্য রোমের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে। যাকে তার সম্মানার্থে কন্সট্যান্টিনোপোল নামে অভিহিত করা হয়। এই ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ স্থানটি বহু শাসকের হাত ঘুরেছে, বহু ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। পারস্যের দারিয়ুস-১, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বাইজেন্টিয়াম বন্দর তথা বসফরাস প্রণালি, কৃষ্ণসাগর থেকে মারমারা সাগর অবধি শাসন করেন।
রোমান সম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের হাতে ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় এবং এটি তিনি পুনঃনির্মাণ করেন। কন্সট্যান্টাইন তার নব্য রোমের জন্য একে আরও প্রসারিত করেন। শহরটি বিশ্বাস, ক্ষমতা, বাণিজ্য, স্থাপত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। প্যাগানদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে নব্য ইউরোপের সূচনা হয়। ক্রিশ্চিয়ানরা সর্বক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ক্ষমতা, বাণিজ্য থেকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তাদের পদাঙ্কে নতুন যুগের সূচনা হয়। যুগে যুগে বহুভাবে ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কন্সট্যান্টাইনও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
ইতিহাস বয়ানে বদলে যায়। এখানে ভালো-মন্দের পুরো বিষয়টিই আপেক্ষিক। কারো কাছে যে পরম পূজনীয় অন্য কারো চোখে সে হয়তো ঘৃণ্য খলনায়ক। চরিত্রের ইতিবাচক নেতিবাচক দিক বিশ্লেষণ না করে যদি সার্বিক দিক বিবেচনা করা হয়, তাহলে তার অবদান আসলে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ তিনি একাই অনেকটা বদলে দিয়েছেন। প্যাগানদের রাজত্ব তিনি ক্রিশ্চিয়ান রাজত্বে পরিণত করেছেন। আধুনিকতার গোড়াপত্তন করেছেন।
প্রচলিত অলৌকিক যে গল্প তার জীবনী লেখক উল্লেখ করে গেছেন তা যদি অতিরঞ্জিতও ধরা হয়, এটা স্বীকার করতে হবে তিনি সুকৌশলে একটি চাল চেলেছেন। যাতে একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়া যায় আবার ক্ষমতা বিস্তৃতে তার যথেচ্ছ ব্যবহারও করা যায়।
সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে আধুনিক ইউরোপের যে রূপরেখা তিনি তৈরি করে গিয়েছিলেন তার ক্ষমতার সুচতুর ব্যবহার করে, তার ফল ভোগ করছে আজ পুরো পৃথিবী। একচ্ছত্র রোমান অধিপতিদের যুগ শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে বিপ্লব। তাই কন্সট্যান্টাইন অন্য সব শাসকের চেয়ে যে আলাদা গুরুত্ব পাবেন সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তার জীবদ্দশায় তিনি বহু উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। রাজ্যপাট বাড়িয়েছেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন নগর গড়েছেন। তবে ইতিহাসের পাতায় তিনি জায়গা করে নিয়েছেন জেসাসের অসহায় অনুসারীদের ত্রাণকর্তা হিসেবে। সেই সাথে আধুনিক ইউরোপের জনক হিসেবে। ইউরোপ আজ তার দেখানো পথে এই অবস্থানে এসেছে।
Feature Image: brittanica.com Reference: 01. Constantine I Roman Emperor. 02. Constantine. 03. Constantine I.