প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুইজারল্যান্ডের অন্যতম প্রাচীন গ্রাম চুর (Chur)। যদিও উচ্চারণভেদে তা অনেকসময় চাহ বা খোর বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই গ্রামের ইতিহাস বহু বছর পুরনো, একদম প্রস্তর যুগের সময়কার। সুইজারল্যান্ডের সবুজ ভূমি, পরিষ্কার আকাশ আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশের গল্প তো অনেক শোনা হয়েছে। আজ ঘুরে আসবো রোমান স্থাপত্য আর ক্রসরোডের জন্য বিখ্যাত সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো গ্রাম খোর থেকে।
ইতিহাস
গল্পের পথ ধরে যাত্রা শুরু করলে দেখা যায়, ১৩ হাজার বছর আগে শহরের বর্তমান ভূখণ্ডে মানুষ বাস করা শুরু করে। ১১ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান বসতির অসংখ্য চিহ্ন পাওয়া যায় এখানে। জুলিয়াস সিজারের পালক পুত্র, সম্রাট অগাস্টাসের অধীনে ঘটনাক্রমে রোমানরা অঞ্চলটি জয় করে এবং এটিকে তাদের সুদূরপ্রসারী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। তাই একে সুইজারল্যান্ডের প্রাচীনতম বসতি বলা যেতেই পারে।
খোর সুইজারল্যান্ডের বৃহত্তম ক্যান্টন, গ্রাবেন্ডেনের রাজধানী। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৯৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং এর চারদিক রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারের দেয়ালের মতো আল্পসের রাজকীয় চূড়া দিয়ে ঘেরা। খোর ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। চার্চ, দূর্গ, পুরাতন বিল্ডিং সবকিছুই যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন, পাহাড়ের উপর নির্মিত বিশপের দূর্গের চারদিকেই ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্ত অনুভব করা যায়।
পুরো ক্যান্টন সরকারিভাবে ত্রিভাষিক-এখানে জার্মান, ইতালি এবং রোমান ভাষায় কথা বলা হয়। তাই এর তিনটি সরকারি নাম রয়েছে, গ্রাবেন্ডেন, গারিজো এবং গ্রিশুন। আর এর ফরাসি নাম গ্রুয়েসান। জার্মান কারিগরদের মাধ্যমে জার্মান ভাষা এখানে প্রচলিত হয়। তারা ১৪৬৪ সালে আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই অঞ্চল পুননির্মাণ করতে এসেছিল।
ক্রসরোড
খোর-এর উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মূলত একটি ক্রসরোড। এখানে অনেক পথ এসে একসাথে যুক্ত হয়েছে। বলা যায়, একটি মূল রাস্তা অনেক পথ পর্যন্ত নিয়ে যায়। খোরের সুবিধাজনক ট্র্যাফিক এবং সহজ ভ্রমণের জন্য আজো এটি ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর। এর বিভিন্ন পাস দক্ষিণ দিকে মিলান, ইতালির রিভেরা এবং জুরিখ বা মিউনিখ পর্যন্ত যায়।
গ্রামের উত্তর-দক্ষিণ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা পোস্টস্ট্রাসা, পুরনো শহরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ওল্ড টাউনের যেসব রাস্তায় গাড়ি নিষিদ্ধ, সেসব রাস্তা ফোয়ারা এবং চমৎকার পেইন্টেড বাড়ির জন্য পরিচিত। এছাড়া আর্কাস স্কোয়ারে রয়েছে স্থানীয় রেস্তোঁরা।
বিখ্যাত ট্রেন জার্নি
খোর বিশ্বের অন্যতম নৈসর্গিক ট্রেন যাত্রা বার্নিনা এক্সপ্রেস এবং গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসের ট্রান্সফার পয়েন্ট হিসাবে পরিচিত। সেখান থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ধীর এক্সপ্রেস ট্রেন চলতে থাকে জুরম্যাটের দিকে। বার্নিনা এক্সপ্রেস খোরকে, আলবুলা পাস এবং সেন্ট মরিৎজের সাথে সংযুক্ত করে। আলবুলা পাস এবং বার্নিনা পাস ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অংশ।
ক্যাথেড্রাল ও এপিস্কোপাল কোর্ট
পাহাড়ের উপরে এপিস্কোপাল কোর্ট এবং ৮০০ বছরের পুরানো ক্যাথেড্রাল রয়েছে। এতে গথিক যুগের শেষের দিকের সুবর্ণ উচ্চ বেদী রয়েছে। ক্যাথেড্রালটি ভার্জিন মেরির জন্য নিবেদিত। এটি সুইজারল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ। রোমান আমলে আদালত এলাকাটি একটি ব্যারাক হিসাবে কাজ করতো।
এই স্থানে দ্বিতীয় ক্যাথেড্রালটি ৮ম শতাব্দীতে নির্মিত হয়। সেই বিল্ডিং থেকে মার্বেল ভাস্কর্যগুলো এখনো নতুন ক্যাথেড্রালে, সেন্ট লরেন্স বেদীর অলঙ্কার এবং সেন্ট ফিডেলিস বেদীর উপর আস্তরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমান ক্যাথেড্রালটি ১১৫০ এবং ১২৭২ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। স্তম্ভগুলো রোমানেস্ক পাথরে খোদাই করা। এছাড়া, আছে একটি গথিক সেক্র্যামেন্ট হাউস (১৪৮৪) এবং জ্যাকব রাসের (১৪৮৬-১৪৯২) একটি উচ্চ বেদী।
সেন্ট মার্টিন চার্চ
যে গির্জাটি এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে আছে সেটি হলো সেন্ট মার্টিন চার্চ। আগুনে পুড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্যারোলিংগিয়ান গির্জার অবশিষ্টাংশের উপর ১৪৯২ সালে এটি নির্মিত হয়। এর তিনটি গম্বুজ আকৃতির অ্যাপস বা খিলান আছে। ১৫২৬ সাল থেকে এটি শহরের গির্জা হিসেবে কাজ করে আসছে।
দক্ষিণ প্রাচীরটি ১৯১৯ সালে অগাস্টো জিয়াকোমেটি তিনটি চমৎকার স্টেইন্ড কাঁচের জানালা দিয়ে তৈরি করেছেন। বেল টাওয়ারটি ১৫০৯ সালে নির্মিত হয় এবং ১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে কয়েকবার পরিবর্তিত হয়ে একটি তীক্ষ্ণ প্রান্ত যুক্ত হয়।
গির্জার সামনের সেন্ট মার্টিনের ঝর্ণাটি ১৭১৬ সালে নির্মিত হয়। ১৯১০ সালে কলাম এবং ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়। ১৯৯০ সালে একটি সম্পূর্ণভাবে পুননির্মিত করা হয়। এর স্লেন্ডার বা সরু ঘড়ি টাওয়ার শহরের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
সেন্ট লুসিয়াস চার্চ
সেন্ট লুসিয়াস পাহাড়ের ধারে অবস্থিত একটি ছোট গির্জা, সেন্ট লুসিয়াস সেমিনারির অংশ। যদিও এই গির্জা প্রাথমিকভাবে তার শিক্ষার্থী এবং যাজকদের জন্য, তবে ভিজিটরদেরও অভ্যর্থনা জানানো হয়। এর উপাসনালয়ের স্থানটি ১২-১৩শ শতাব্দীতে তৈরি হয়। রোমানেস্ক রিলিফ এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষঙ্গের খোদাই রয়েছে।
শপিংমল এবং ফার্মার মার্কেট
খোর সত্যিই একটি ছোট শহর। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এখানে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কিছু পাওয়া যাবে না। ৫০০টিরও বেশি দোকান নিয়ে, খোর নিজেকে জুরিখ এবং মিলানের মধ্যে বৃহত্তম শপিং সেন্টার বলে দাবি করে।
মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি শনিবার সকালে, পুরানো শহরে একটি ফার্মার মার্কেট হয়। সেখানে তাজা পণ্য থেকে শুরু করে বিশেষ পনির, স্থানীয় মধু, ঘরে তৈরি রুটি সবই পাওয়া যায়। বিখ্যাত আউটলেট গ্রাম ল্যান্ডকোয়ার্ট ট্রেনে খোর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। সেখানে ১৬০টিরও বেশি সুইস এবং শীর্ষ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রয়েছে।
একই সাথে ইতিহাস আর প্রকৃতির শোভার এক অকৃত্রিম মেলবন্ধন সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রাম খোর। এর রোমান স্থাপত্য, ইতিহাসের সাক্ষী চার্চ আর দুর্গ আপনাকে এক মুহূর্তে নিয়ে যাবে পুরনো সময়ে। গাড়িবিহীন রাস্তার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করতে পারবেন অতীত আর বর্তমানের শিল্প। সাথে আছে ট্রেনে চড়ে দুই চোখ ভরে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার সুযোগ।
Feature Image: ORANGE SMILE References: 01. history-chur-oldest-town-Switzerland. 02. get-to-know-chur-Switzerlands-oldest-city. 03. chur.graubuenden.ch/en/attractions/chur-old-town. 04. chur-the-oldest-town-in-Switzerland.