পিরামিডের নাম নিলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে নীল নদ আর পিরামিডের দেশ মিশরের নাম। তবে মিশর বাদেও পৃথিবীতে অন্যান্য স্থানেও গড়ে উঠেছিল সুউচ্চ ও সুদৃশ্য পিরামিড। যা আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের মায়ান সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন; যার নাম চিচেন ইতজা।
মায়া সভ্যতা বা মায়ান সভ্যতা নিয়ে রয়েছে অদম্য কৌতূহল। আমাজনের ২ মিলিয়ন বর্গমাইল আয়তনের বিশাল জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে রহস্যময় এই প্রাচীন সভ্যতা। আমেরিকাতে স্প্যানিশদের আসার পূর্বেও হাজার হাজার বছর পুরনো এই সভ্যতা; এবং বলা হয়ে থাকে সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা ছিল মায়ান সভ্যতা।
২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য আমেরিকায় মায়া সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি একটি শহর হচ্ছে চিচেন ইতজা। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক হারিয়ে যাওয়া এই আধুনিক শহর সম্পর্কে।
চিচেন ইতজার গোড়াপত্তন
মায়া সভ্যতার অন্যতম বিখ্যাত শহর চিচেন ইতজা। এই শহর তৎকালীন সময়ের তুলনায় ছিল বেশ আধুনিক। চিচেন ইতজা শব্দের অর্থ ‘কুয়ায় যাওয়ার মুখ।’ এই স্থানের একটি বিখ্যাত কুয়ার নাম থেকে এরকম নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিনসুলার রিসোর্ট শহর ক্যানকুন থেকে ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল চিচেন ইতজা। এর নির্মানকাল নিয়ে বেশ কিছু মতপার্থক্য রয়েছে।
যেমন কিছু গবেষণা থেকে জানা যায়, চিচেন ইতজার প্রতিষ্ঠাকাল ৪০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে; আবার আরেক দল গবেষক বলেন, এই শহরের সূচনা ঘটেছিল ৫ম শতাব্দীর মাঝখানে। ধারণা করা হয় যে, ৬০০-১২০০ সাল পর্যন্ত মায়া সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং এখান থেকেই মায়া সভ্যতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো সেই সময়ে।
চিচেন ইতজা প্রায় সাড়ে ৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ছিল। আনুমানিক ৫০ হাজার লোকের বসবাস ছিল এখানে। এই শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাকা রাস্তা ও ফুটপাত। যা ঐ সময়ের জন্য বেশ যুগান্তকারী ব্যাপার ছিল। কারণ তৎকালীন সময়ে ইউরোপের কোনো শহরের রাস্তাও এতো উন্নত ছিল না।
কেন তৈরি হলো এই শহর?
চিচেন ইতজায় ইউকাতান উপদ্বীপের সমস্ত অঞ্চলের মায়ান লোকদের আবাসস্থল ছিল। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে, বিশুদ্ধ পানির ভূগর্ভস্থ উৎস টলক সেনোটের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এই শহর গড়ে উঠে।
চিচেন ইতজার উদ্ভিদ এবং প্রাণীবৈচিত্র্য
১৮৮০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত, এখানের প্রধান ফসল ছিল হেনিকুয়েন, যা দড়ি এবং সুতা তৈরির জন্য অ্যাগাভ ক্যাকটাস থেকে সংগ্রহ করা হতো। কৃষিজ ফসল উৎপাদনের মধ্যে শস্য, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল, গবাদি পশু এবং শুকর অন্তর্ভুক্ত। যা অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
চিচেন ইতজার কমপ্লেক্স
চিচেন ইতজার বেশ কয়েকটি অঞ্চল বা কমপ্লেক্স রয়েছে যা প্রতিফলিত করে সেই সময়ে শহরটি কতটা উন্নত ছিল। এই কমপ্লেক্সগুলির মধ্যে তিনটি সর্বাধিক পরিচিত হলো – গ্রেট নর্থ প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে রয়েছে এল কাস্তিলো, ওয়ারিয়র্সের মন্দির এবং গ্রেট বল কোর্টের স্মৃতিস্তম্ভ; ওসারিও গ্রুপ, যার মধ্যে রয়েছে ওসারিও পিরামিডের পাশাপাশি এক্সটোলোকের মন্দির; এবং সেন্ট্রাল গ্রুপ, যার মধ্যে রয়েছে এল কারাকোল, লাস মনজাস এবং আকাব ডিজিব নামে পরিচিত মানমন্দির।
চিচেন ইতজার পতন
যদিও মায়া সভ্যতার পতনের জন্য ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আগমনকে প্রধানত দায়ী করা হয়, এবং তাকে অনুসরণকারী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদেরকে। তবে চিচেন ইতজা তখন কিংবা তার অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে তার স্থান হারিয়ে ফেলেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, শহরের অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ১২০০ এর মাঝামাঝি সময়ে চিচেন ইতজার দক্ষিণ ও পশ্চিমে নির্মিত মায়াপানে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিছু গবেষণায় প্রমাণিত যে, চিচেন ইতজা এই সময়ে অভিযান চালিয়ে লুটপাট করা হতে পারে, যদিও এটি এখনো একটি অমীমাংসিত ও বিতর্কিত বিষয়।
তবুও, ৯০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মায়ান সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। গবেষকরা ঠিক ঠিক করে বলতে পারেননি, কী কারণে মায়া সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। কেউ বলেন, মহামারির কারণে; কেউ বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় খাবারের অপর্যাপ্ততার কারণে; আবার কেউ বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।
১৪৫০ সালে পুরো মধ্য আমেরিকায় বিপ্লব সংঘঠিত হয়। তখন মায়ানরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মায়া সভ্যতার কিছু অংশ আবার স্প্যানিশরা দখল করে নেয়। শেষমেশ ১৬৯৭ সালে এসে পুরো মায়া সভ্যতাই স্প্যানিয়ার্ডদের দখলে আসে। যখন ১৫২৬ সালে স্প্যানিশ বিজয়ীরা এসেছিলেন, তখন শহর এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী একটি সমৃদ্ধ সম্প্রদায় ছিল। তাই খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও স্প্যানিশরা সেখানে একটি অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এটি গবাদি পশু পালন কার্যক্রমের জন্য একটি সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
যে স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন
এল কাস্তিলো নামের পিরামিড আকৃতির একটি দুর্গ এই শহরের প্রধান আকর্ষণ। এই দুর্গটি কুকুল্কানের মন্দির হিসেবেও পরিচিত। মায়া সভ্যতার প্রভাবশালী দেবতা ছিলেন কুকুল্কান। পিরামিডের উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট।
এই পিরামিডের চূড়ায় আরোহণ করতে হলে আপনাকে পার করতে হবে ৩৬৫টি সিঁড়ি! ৩৬৫টি সিঁড়ি বছরের ৩৬৫ দিনকে নির্দেশ করে। মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় খুব পারদর্শী ছিল। কোনরকম আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই সূর্যগ্রহণের হিসাব করতে পারতো। জেনে অবাক হবেন যে, সূর্যগ্রহণের সময় এখানে নর-বলির উৎসব হতো।
চিচেন ইতজার আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে সেনোট কূপ। ধারণা করা হয়, ভূগর্ভস্থ কোনো নদীর সাথে এই কূপের সংযোগ রয়েছে। এই কূপটি শহরের পানির একমাত্র উৎস ছিল। প্রচুর স্বর্ণ ও মূল্যবান বস্তু এই কূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এছাড়াও বহু মানুষের মাথার খুলি ও হাড় পাওয়া গিয়েছিল। মায়ানরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে তাদের আরাধ্য দেবতা ভেবে পূজা করতো।
ধারণা করা হয়, এদেরকে বৃষ্টির দেবতা চাক এর নামে সেসময়ে বলি দেওয়া হয়েছিল। দ্যা গ্রেট বল কোর্ট এই শহরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান। এখানে বল খেলা হতো। সবচেয়ে বীভৎস ব্যাপার হচ্ছে, যারা বল খেলায় হেরে যেতো তাদের বলি দেওয়া হতো। এছাড়াও আছে নর্থ টেম্পল যা দাড়িওয়ালা মানুষের মন্দির নামে পরিচিত ছিল।
স্যাকবে নাম্বার ওয়ান একটি অন্যতম পাকা ও প্রশস্ত রাস্তা। প্রস্থে প্রায় ৯০০ ফুট এই রাস্তাটি। গ্রুপ অব থাউসেন্ড কলামে অনেকগুলো পিলার দেখতে পাওয়া যায়।
শহরের আরেকটি স্থান হচ্ছে এল মার্কাডো। এই স্থানটি শহরের বাজার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও আছে অনেকগুলো পিরামিড আকৃতির কাঠামো যার মধ্যে এল ওসারিও বেশ উল্লেখযোগ্য।
মেক্সিকো সরকার এসকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো বেশ যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছে। তাইতো চিচেন ইতজা এখনও বেশ জীবন্ত মনে হয়। ২০১৭ সালে মেক্সিকোর সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করার জায়গার তালিকায় শীর্ষে এই শহর স্থান পায়। প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ পর্যটকদের আনাগোনা এখানে হয়। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের পরিচিতি পেয়েছিল এবং ২০০৭ সালে এটি নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স এর একটি হিসাবে যায়গা করে নেয়।
Feature Photo: History.com References: 01. Chichen Itza. 02. Chichén Itzá. 03. Pre-Hispanic City of Chichen-Itza. 04. Facts about Chichen Itza in Mexico - A UNESCO World Heritage Site. 05. Chichen Itza.