পবিত্র রমজানের দীর্ঘ এক মাসের রোজার শেষে মুসলমানরা ঈদুল ফিতর পালন করে। পরিবার এবং বন্ধুদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন ঐতিহ্য এবং মজাদার খাবারের সাথে এই দিনটি পালিত হয়। দিনটির শুরু হয় সকালে গোসল করে নতুন পোশাক পরার মধ্য দিয়ে।
ঈদের নামাজের আগে, মুসলমানদের জাকাত আল-ফিতরে অংশ নিতে হয়। নামাজের পর পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে দেখা করা শুরু হয় এবং সাথে থাকে মুখরোচক খাবার, মিষ্টি ইত্যাদি। তবে এই সাধারণ প্রথাগুলো ছাড়াও, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে রয়েছে স্বতন্ত্র ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি। আজকের আয়োজনে থাকছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতর পালনের রীতিনীতি।
ভারত
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে ভারতে। ঈদুল ফিতর তাদের একটি প্রধান ছুটির দিন। ছুটির দিনটি অন্যান্য দেশের মতো ভোজন, প্রার্থনা এবং পরিবারের সাথে পালন করা হয়। ঘর সাজানোতে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। সেমাই এবং অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়।
চীন
চীনে, ইউ জিয়াং (ময়দা, জল এবং তেলে ভাজা খামির প্যাটি) তৈরি করে উপহার হিসাবে দেওয়া হয়। অথবা ঈদের ভোজের অংশ হিসাবে খাওয়া হয়। চীনে মুসলমানরা তাদের আত্মীয়দের কবর জিয়ারত করে দোয়া করে ও সমাধি পাথরে চাল এবং কখনও গম রেখে যায়।
ইয়েমেন
বিনতে আল সান বিশেষ ধরনের ইয়েমেনি মিষ্টি। ইংরেজিতে একে কখনও মধু কেক বলা হয় এবং এর উপরে নাইজেলা বীজ থাকে। ইয়েমেনের ঈদ ঐতিহ্যতে অনেক বছর ধরেই মিশে আছে এই সুস্বাদু খাবারটি।
রাশিয়া
রাশিয়ায় ঈদে মানতি নামক একটি জনপ্রিয় খাবার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এটি সাধারণত ভেড়া বা গরু মাংসের কিমা দিয়ে মাখানো আটার ভেতর পুরে ভাপে সেদ্ধ করে তৈরি করা হয়। পরিবেশনের সময় সাথে থাকে মাখন এবং সাওয়ার ক্রিম। এছাড়াও, হরেক রকমের মিষ্টি থাকে তাদের খাদ্যতালিকায়।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে ঈদের প্রস্তুতি সাধারণত রমজানের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়। ঈদের আগের রাত বা চাঁদ রাতে, শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা চলে। নারীরা হাতে মেহেদি পরে। ঈদে শির খুরমা, বিরিয়ানি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে, ঈদুল ফিতরের বিশেষ আকর্ষণ ইডেন পার্কের দ্বি-বার্ষিক ঈদ উৎসব। এখানে হরেক রকমের মজার ইভেন্ট এবং সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা থাকে।
ইরাক
ঈদে, ইরাকের বিশেষ খাবার হচ্ছে, ক্লিচাস। গোলাপের স্বাদযুক্ত বিস্কুট যাতে বাদাম এবং খেজুরের পুর বা ফিলিং থাকে।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল ফিতর লেবারান নামে পরিচিত। তাদের উদযাপনের অন্যতম আকর্ষণ ল্যাপিস লেজিট নামে একটি ঐতিহ্যবাহী হাজার-স্তরের কেক। ঈদের আগের দিন ড্রাম বাজিয়ে, আতশবাজি এবং আলোকসজ্জার মাধ্যমে তারা উৎসবের সূচনা করে।
ইন্দোনেশিয়ার একটি পুরানো ঐতিহ্য মুদিক (স্বদেশ প্রত্যাবর্তন)। পরিবারের সাথে ঈদ কাটাতে, তারা অন্য শহর থেকে ফিরে আসে। এছাড়া রয়েছে, হালাল বিহালাল। এর মাধ্যমে বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজন সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়।
বেশিরভাগ ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানরা ঈদের দিনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনরা তাদের প্রিয়জনের কবর জিয়ারত করেন।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ানরা ঈদের আগের দিন নিজ শহরে ভ্রমণের মাধ্যমে উদযাপন শুরু করে। স্থানীয়ভাবে এই দিনটি হরি রায়া আইদিলফিত্রি নামে পরিচিত। ঘরে পেলিটা বা তেলের বাতি দিয়ে সাজায়। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে।
সাথে কেতুপাট, কুইহ রায়া, লেমাং, রেন্ডিং ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করে। এখানকার ভিন্ন একটি দিক হলো, ‘ওপেন হাউস’। সুস্বাদু খাবারের সাথে একটি ভালো সময় উপভোগ করার জন্য, প্রত্যেকের বাড়ি প্রত্যেকের জন্য উন্মুক্ত।
সৌদি আরব
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশটির রাস্তাঘাট সাজানো হয়। পরিবার এবং বন্ধুরা ঈদের বিশেষ খাবারের জন্য একত্রিত হয়। তবে তার আগে, বাচ্চারা পরিবারের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের কাছ থেকে সালামি পায়। সৌদি আরবের একটি অনন্য ঐতিহ্য আছে।
স্থানীয়রা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে, তাদের বাড়ির গেটে বেনামে প্রচুর পরিমাণে চাল এবং অন্যান্য জিনিস রেখে যায়।
তুরস্ক
তুরস্কে, ঈদুল ফিতর সেকার বায়রাম (Seker Bayram) বা চিনির ভোজ হিসাবে পরিচিত। তুর্কিশ ডিলাইট, বাকলাভার মতো ক্লাসিক তুর্কি মিষ্টি ঈদের সময় উপহার হিসাবে বন্ধু, পরিবার এবং প্রতিবেশীদের দেওয়া হয়।
ঈদুল ফিতরের ছুটিতে তুর্কিরা সমুদ্র সৈকতে ভিড় করে। অনেক পরিবার ছুটিতে আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণ করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
আমিরাতিদের বিখ্যাত খাবার উজি। এটি শুধু উৎসবের সময় প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও, দেশটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে থাকে ম্যাজিক শো, থিম পার্ক, নাচের অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
আইসল্যান্ড
মুসলিমরা এখনও আইসল্যান্ডের জনসংখ্যার হিসাবে সংখ্যালঘু। আইসল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলমানদের দিনে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা রাখতে হয়। তবে, বিকল্প প্রস্তাব হিসাবে তারা নিকটতম দেশ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়ের উপর ভিত্তি করে রোজা ভাঙতে বা সৌদি আরবের টাইমজোন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিকের কয়েকটি মসজিদে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। ইন্দোনেশিয়ান, মিশরীয় এবং ইরিত্রিয়ান খাবারের বুফের পাশাপাশি, নতুন পোশাকের পরে পরিবার, সহকর্মী এবং বন্ধুদের এবং সাথে উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে তারা এই দিনটি উদযাপন করে।
সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরে ঈদের অন্যতম চমক হলো গেইলাং সেরাই এলাকার আলোর উৎসব। এটি সিঙ্গাপুরের প্রাচীনতম মালয় বসতিগুলোর মধ্যে একটি। প্রায় ৫০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের আলো এবং ভিজ্যুয়াল ইনস্টলেশনসহ এই উৎসব চলে।
আফ্রিকা মহাদেশ
মিশরে, ঈদের নামাজের পর পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সাথে দেখা করার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুরু। অনেকে স্থানীয় পার্ক এবং চিড়িয়াখানায় যায়। এর মধ্যে গিজা চিড়িয়াখানা সবচেয়ে জনপ্রিয়। ঈদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার বাদাম এবং চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরনের কুকিজ, যা কাহক নামে পরিচিত।
মরক্কোতে, তাদের বিখ্যাত প্যানকেক এবং মিন্ট টি সকালের প্রধান খাবার। সোমালিয়ায় দিনে মিষ্টান্ন হিসাবে আছে হালভো। কেনিয়ায় আফ্রিকান স্পঞ্জ কেক তৈরি হয়। নারীরা হাতে মেহেদির নকশা করে। পুরুষরা কানজু (কাফতানের মতো একটি পোশাক) পরে ঈদের নামাজে যান।
মোম্বাসায়, রমজানের শেষ দশ দিন নামে পরিচিত উৎসব পালিত হয়। বন্ধু এবং পরিবারের জন্য উপহার কেনা হয়। গল্পকাররাও ঈদের সময় কিছু জায়গায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, বাচ্চাদের লোককথা দিয়ে বিনোদন দেওয়ার জন্য।
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে, ঈদের একটি জনপ্রিয় খেলা ঘুরসাই (ghursai), যেখানে দুইজন পুরুষ এক পায়ে একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অন্য পা পিঠের পিছনে এক হাত দিয়ে ধরে রাখে।
প্রতিপক্ষকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে খেলা জুড়ে।
আরেকটি জনপ্রিয় খেলা হলো ‘ডিম লড়াই’ বা এগ ফাইট। এখানে দুইজন প্রতিযোগী সিদ্ধ ডিম নিয়ে একে অপরের ডিম ভাঙ্গার চেষ্টা করে।
ইতালি
সংখ্যায় নগণ্য হলেও, রোমান ক্যাথলিক ধর্মের পরে ইসলাম এখনও ইতালিতে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ধর্ম। ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদটি রাজধানী রোমে অবস্থিত।
এই দেশের বেশিরভাগ এলাকা পানি দ্বারা বেষ্টিত, তাই ইতালির মুসলিমদের জন্য সমুদ্রের ধারে ঈদের নামাজ পড়া একটি সাধারণ ঘটনা। আর এটি তাদের উদযাপনে, একটি ভিন্ন পরিবেশ যোগ করে।
লন্ডন
দীর্ঘ ১৮ বছরের ঐতিহ্য হিসাবে, লন্ডনের মেয়র বিনামূল্যে ট্রাফালগার স্কোয়ারে বার্ষিক ঈদ উৎসব আয়োজন করছে। ‘ঈদ কমিউনিটি অ্যাডভাইজরি গ্রুপ’ এবং লন্ডন ভিত্তিক শিল্প, সংস্কৃতি এবং তৃণমূল মুসলিম সংগঠনগুলো একসাথে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করছে।
সাথে থাকছে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত খাবারের স্টল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঈদ প্যারেড, ক্যালিগ্রাফি, গল্প বলা, নাটক ও কবিতার কর্মশালা, মেহেদি এবং ফেসপেইন্টিং, ফটোগ্রাফ প্রদর্শনী ইত্যাদি।
আলজেরিয়া
ঈদের দিন আলজেরিয়ার পুরুষরা খামিস (গোড়ালি পর্যন্ত দীর্ঘ পোশাক) পরিধান করে । নামাজ শেষে শুভেচ্ছা জানানো এবং উপহার বিনিময় হয়। খাবারের জন্য থাকে সামুদ্রিক খাবার ট্যাগিনে (ধীরে রান্না করা স্টু)। ডেজার্টের জন্য, কালব-ই-লৌজ বা বাদামের তৈরি ঐতিহ্যবাহী আলজেরিয়ান পেস্ট্রি থাকে।
তিউনিসিয়া
ঈদের আগের রাতে তিউনিসিয়ার রাস্তাঘাট মুখরিত থাকে। শপিং মলগুলো ফজর পর্যন্ত খোলা থাকে। ঈদের সকালে থাকে খেজুর এবং প্রচুর জলপাই তেলের তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার আসিদা।
মূল ধর্মীয় নিয়মগুলোর পাশাপাশি, প্রতিটি দেশেই রয়েছে তাদের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি। এটি একদিকে যেমন ভিন্নতা আনে, অন্য দিকে এই ভিন্নতা আনন্দেরও উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।
উৎসব সবসময়ই একাত্মতার উৎস। দেশভেদে ভিন্নতা থাকলেও, দিন শেষে কাছের মানুষদের সাথে সুন্দর মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়াই দিনটির মূল উদ্দেশ্য।
Featured Image: newsweek.com Reference: 01. Eid-Around-the-World. 02. Eid-Al-Fitr-Around-the-World. 03. How is Eid al-Fitr celebrated around the world? 04. Festivals/Eid-Ul-Fitr. 05. Eid Around the World. 06. Eid-Square-2023. 07. Celebrating Eid-Al-Fitr Around the World. 08. Eid Celebrations Around World. 09. Eid-Mubarak Meaning Around World.