বাকিংহাম প্যালেস। নামটা নিশ্চয়ই চেনা লাগছে, তাই না? এই প্রাসাদে ঘুরতে যাওয়ার বাসনা সবার মনেই কমবেশি থাকে। ব্রিটিশ প্রজাতন্ত্রের আভিজাত্যের প্রতীক হল এই প্রাসাদ। আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেস, বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত, অন্যতম বিলাসবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবন। এটি লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার শহরে অবস্থিত। রাজপরিবারের বাসভবন হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের সকল রাষ্ট্রীয় এবং রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলো এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
এই ভবনে আছে স্টেট রুম যেগুলো রাজকীয় ও জাতীয় কাজকর্মের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্যের যে কোনো ধরনের জাতীয় উৎসব এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সমাবেশস্থলে পরিণত হয় এই প্যালেস। লন্ডনে অবস্থিত এই প্রাসাদের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বহু অজানা অধ্যায়। চলুন জেনে নেয়া যাক ব্রিটেন সাম্রাজ্যে অস্তমিত না হওয়া এই প্রাসাদের আদ্যোপান্ত।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বাকিংহাম প্যালেস পূর্বে বাকিংহাম হাউস হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৫৩১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে সেন্ট জেমস হাসপাতাল ও ইটন কলেজ কিনে নিয়েছিলেন এবং ৪ বছর পর ‘ম্যানর অব ইবুরি’ এর মালিক হন। আর এতে করেই ঐতিহাসিক বাকিংহাম প্যালেসের স্থানটি আবার ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মালিকানাধীন হয় যা প্রায় ৫০০ বছর আগে অর্থাভাবে ‘উইলিয়াম দ্য কনকারার’ বিক্রি করে দিয়েছিলেন!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে যে, এই প্রাসাদ যে জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল সেখানে রাজা প্রথম জেমস রেশমি পোকা চাষের জন্য মালবেরি প্ল্যান্টের বাগান করেছিলেন। যদিও, সেটি সম্ভব হয়নি।
এই ভবন প্রথমে ডিউকের দরবার হল হিসাবে তৈরি করা হয়। উইলিয়াম উইন্ডে এবং জন ফিট ভবনটি ডিজাইন এবং তৈরি করেছিলেন যা ১৭০৫ সালের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা শেষ হয়। পরবর্তীতে, ১৭৬২ সালে রাজা তৃতীয় জর্জ এই ভবনটি নিজের দখলে নিয়েছিলেন। ১৮৩৭ সালে এটি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বাসভবন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং তৎকালীন রানী ভিক্টোরিয়া সেখানে অবস্থান করতে শুরু করেছিলেন।
রাজা পঞ্চম জর্জের শাসনামলে বাকিংহাম প্যালেসের সর্বশেষ বৃহৎ কোনো সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। জর্জের স্ত্রী রানী মেরি বেশ শৌখিন স্বভাবের ছিলেন। তাই তৎকালীন সময়ে তিনি রাজপ্রাসাদকে ঢেলে সাজানোর কাজ সামনে থেকে পরিচালনা করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তেমন একটা মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে এই প্রাসাদ বেঁচে গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর রক্ষা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাকিংহাম প্যালেসের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় যে, নাৎসি বাহিনী মনে করত এই প্যালেস ধ্বংস হলে ব্রিটেনের মানুষেরা মানুষিকভাবে ভেঙ্গে পরবে। এজন্য তারা সাতবার এই প্রাসাদে বোমা ছুঁড়ে আক্রমণ করেছিল।
এরমধ্যে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং রাণী এলিজাবেথ প্রাসাদে অবস্থান করা অবস্থায় একবার বোমা ছুঁড়ে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে রাজা ও রানী অক্ষত ছিলেন। তবে তৎকালীন সময়ে এসব আক্রমণের খবর রাজপরিবার সবসময় মিডিয়ার আড়ালে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল।
যুদ্ধের পর বাকিংহাম প্যালেসেই লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে বিজয় উদযাপন করেন রাজা জর্জ ও রানী এলিজাবেথ। তবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রাসাদের সকল জরুরি ও মূল্যবান জিনিস উইন্ডসর দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
বাকিংহাম প্যালেসের বর্তমান অবস্থা
পৃথিবীর ১৩ তম বৃহত্তম রাজপ্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেসের আয়তন জানলে অবাক হবেন। ৮,২৮,৮১৮ স্কয়ার ফুট! এতে আছে ৭৭৫ টি রুম। এর মধ্যে ১৯টি স্টেট রুম; অতিথি এবং রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য ৫২টি বেড রুম। ১৮৮টি স্টাফ রুম, ৯২ টি অফিসরুম এবং বাথরুম।
প্যালেসের বাউ রুমের পিছনেই আছে ‘বাকিংহাম প্যালেস গার্ডেন’ যা লন্ডনের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত বাগান। একটি চমকপ্রদক তথ্য দেই! এই বাগানে একটি খুবই সুন্দর লেক রয়েছে। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০০২ সাল থেকে এই গার্ডেনে আড়ম্বরপূর্ণ পার্টির আয়োজন করা শুরু করেন।
প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে এই পার্টি আয়োজন করা হয়। রানীর গার্ডেন পার্টিতে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ বাউ রুমের মধ্য দিয়েই প্রবেশ করে পার্টিতে অংশ নেন। তবে এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কক্ষটি হচ্ছে রানীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটি কক্ষ যা একেবারে দক্ষিণে বিশেষভাবে সংরক্ষিত।
এখানে; বর্তমানে প্রায় সাড়ে চারশ সরকারি কর্মকর্তা কাজ করেন। বছরে আমন্ত্রিত অতিথির পাশাপাশি এখানে হাজার দর্শকের ভীর হয়। ট্রাফালগার স্কয়ার ও বাকিংহাম প্যালেসকে সংযুক্ত করেছে একটি রাস্তা যা ‘দ্য মল’ হিসেবে পরিচিত। দর্শনার্থীরা কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দ্য মল পর্যন্ত যেতে পারেন।
এছাড়াও শিল্প ও চিত্রকলার দিক দিয়ে এটি অন্যান্য যেকোনো প্রসিদ্ধ প্যালসের থেকে এগিয়ে রয়েছে। স্টেট রুম সংযুক্ত আছে ব্লু এবং হোয়াইট ড্রয়িংরুম সাথে একটি করিডোরের মাধ্যমে। এই করিডোরের হরেকরকমের প্রসিদ্ধ শিল্পকলা সংগ্রহ করে এখানে প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। রুবেনস, রেমব্রান্ট, ভারমের, পুসান এবং ক্লডের মত কিংবদন্তীদের শিল্পকর্ম যেকোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
থ্রোন রুম এবং গ্রীন ড্রয়িংরুম নামে দুইটি রুম আছে । গ্রীন ড্রয়িংরুম হচ্ছে থ্রোন রুমের অভ্যর্থনা কক্ষ। তাছাড়াও আছে একটি বিশাল গার্ডরুম যেখানে দুইটি সাদা পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য রয়েছে। একটি হল রাণী ভিক্টোরিয়া এবং আরেকটি প্রিন্স আলবার্টের অবয়ব অনুযায়ী তৈরি হিয়েছে।
রাজা ফিলিপ ও রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সপ্তাহান্তে এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বাকিংহাম প্যালেসে থাকেন। তারা বাকি দিনগুলোতে উইন্ডসর দূর্গে বাস করেন। এটি কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের নিজস্ব সম্পত্তি নয় বরং ইংল্যান্ডের জাতীয় সম্পত্তি। পূর্বে রাজা-রানী মানে ছিল তারা পুরো রাজ্যেরই মালিক।
আর এখন সেখানে রাজা-রানীকেও রাষ্ট্রের কোষাগারে কর দিতে হয়। জানা গিয়েছে যে, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০১৫ সালে ক্রাউন এস্টেট থেকে ২৮ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড পেয়েছিলেন। সরকারি কোষাগার থেকে পাচ্ছেন ২০ লাখ পাউন্ড। সানডে টাইমস পত্রিকার দেওয়া ধনীর তালিকা অনুযায়ী ২০১৬ সালে রানীর সম্পদের পরিমাণ ৩৪ কোটি পাউন্ড।
কীভাবে আসবেন বাকিংহাম প্যালেস?
এই প্রাসাদ সেন্ট্রাল লন্ডনে অবস্থিত যার সবচেয়ে নিকটস্থ টিউব স্টেশনগুলো হচ্ছে ভিক্টোরিয়া, গ্রীন পার্ক এবং হাইড পার্ক কর্ণার। অনেক বাস ও কাছাকাছি স্থানে থামে। তবে আপনি যদি কোচে করে আসেন, তবে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হবে।
কখন ঘুরতে আসবেন?
বাকিংহাম প্যালেসে আপনি কিন্তু বছরের যেকোনো সময়, যখন তখন ঘুরতে যেতে পারবেন না। এখানে ঘুরতে যাওয়ার সময় হচ্ছে জুলাই থেকে অক্টোবর মাস। সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে। টিকেটে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা থাকে ঠিক সেসময়ে ঢুকতে দেয়া হয়। আপনি যদি ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী হন এবং স্টেট রুমগুলো ভিসিট করতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকে গুনতে হবে ১৯.৫০ ইউরো।
তবে আপনি যদি ২৪ বছরের বেশি বয়সী হন সেক্ষেত্রে লাগবে ৩০ ইউরো। ৫ বছরের উপরে শিশুদের জন্য টিকেট মূল্য মাত্র ১৬.৫০ ইউরো, তবে ৫ বছরের নিচে শিশুদের জন্য প্রবেশমূল্য একদম ফ্রি! যাওয়ার আগে অবশ্যই টিকেট কেতে যেতে হবে।
রয়্যাল কালেকশন ওয়েবসাইট থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে পারবেন। দুই ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময় লাগবে এই প্যালেস ভ্রমণ করতে। সাধারণ মানুষদের জন্য গ্রীষ্মকালে বাকিংহাম প্যলেস উন্মুক্ত করে দেয়া হয় কারন সে সময়ে রাণী রাজপ্রাসাদে থাকেন না। লন্ডনের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে এই বাকিংহাম প্যালেস। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতীকটি যেন একটি জীবন্ত আর্ট গ্যালারি। লন্ডনে কখনো ভ্রমণ করলে অবশ্যই ঘুরে আসতে ভুলবেন না!
ফিচার ইমেজঃ Unsplash.com
তথ্যসূত্রঃ
01. Buckingham Palace.
02. Facts-buckingham-palace-queen-king-royal-residence-london.
03. Buckingham-palace-tour-summer-opening.
04. Royal-residences-buckingham-palace.