১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিএমডব্লিউ (BMW) বিশ্বের জনপ্রিয় এবং নেতৃস্থানীয় অটোমোবাইল ব্র্যান্ডগুলোর মাঝে একটি। তবে জার্মান এই ব্রান্ডটি শুরুতেই অটোমোবাইল নির্মান শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না বরং শত বছরেরও প্রাচীন ব্র্যান্ডটি প্রথম দিকে বিমানের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক হিসাবে তাদের যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে আজও বিংশ শতাব্দীর এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে বিএমডব্লিউ দাপটের সাথে টিকে আছে এবং রাজত্ব করছে তার টেকসই, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক যানবাহনের কারণে।
বিএমডব্লিউ-এর শুরুর গল্প (১৯১৬-১৯২৮)
বিমান ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক হিসাবে যাত্রা শুরু করা বিএমডব্লিউ ১৯২০ সাল পর্যন্ত এটিই একমাত্র পণ্য ছিল যেটি নিয়ে কাজ করছিল। এবং এতে লভ্যাংশের পরিমানও ছিল নেহাত কম না। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে, বিমানের ইঞ্জিনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং প্রয়োজনের বিষয়টি চিন্তা করে ব্র্যান্ডটি মোটরসাইকেল উৎপাদনের দিকে ধাবিত হয়।
১৯২৩ সালে উন্মোচিত হওয়া বিএমডব্লিউর প্রথম মোটরসাইকেলটি ছিল আর৩২ (R32) যা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সকলের কাছে। আর৩২ এর ডিজাইন গ্রহনযোগ্যতার বিচারে এতটাই পারফেক্ট ছিল যে এখন পর্যন্ত বিএমডব্লিউ ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে এই মডেলটি ব্যবহার করছে।
উল্লেখ্য, আর৩২ মডেলটিতে বক্সার ইঞ্জিন ছিল যাতে সিলিন্ডারটি আড়াআড়িভাবে অবস্থিত। ফলে সাইকেল ব্যবহারকারীরা বাহনটি চালানোর ক্ষেত্রে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো তেমন দেখতেও মডেলটি ছিল বেশ আকর্ষণীয়। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা দৃষ্টিগোচর হতো সেটা হলো বিএমডব্লিউর আইকনিক ব্র্যান্ড লোগোটি। লোগোটি এখন পর্যন্ত একই রেখেছে কোম্পানিটি, আনেনি কোনো পরিবর্তন।
মোটরসাইকেল বাজারে সফলভাবে ব্যবসা করার পর বিএমডব্লিউর পালকে সংযুক্ত হয় নতুন একটি সফলতা। যাত্রা শুরু হয় বিএমডব্লিউ অটোমোবাইল শিল্পের। ফারজেগফেব্রিক আইসেনাচ্কে সাথে নিয়ে সেই যাত্রার প্রথম উন্মোচিত গাড়িটি ছিল ডিক্সি ৩/১৫।
কুপ, ট্যুরার এবং রোডস্টার নামক তিনটি ভিন্ন মডেল নিয়ে বাজারে আসা গাড়িটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ক্রেতাসাধারণের মাঝে। তবে যেহেতু অস্টিন মোটর কো-এর সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছিল গাড়িটি; সেকারণেই পরবর্তীতে চুক্তিটি যখন ১৯৩২ সালে শেষ হয়ে যায়, তখন থেকে ডিক্সি ৩/১৫ গাড়িটিও বাজারে আসা বন্ধ হয়ে যায়।
বিমান ইঞ্জিন নির্মাণে পুনরায় ফিরে যাওয়া (১৯৩৩-১৯৪৭)
সালটি ছিল ১৯৩৩, জার্মান সরকারের অনুরোধে কোম্পানিটি পূনরায় বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করতে শুরু করলো। শুধু তাই নয়, বিমানের যন্ত্রাংশসহ ব্র্যান্ডটি যুদ্ধের যন্ত্রপাতিও তৈরি করেছিল সেই সময়ে। যার ফলে, ওই সময়গুলোতে বিএমডব্লিউর অটোমোবাইল শিল্পে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারেনি।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে বিএমডব্লিউর কার্যাদি (১৯৪৮-১৯৬০)
বিশ্বযুদ্ধের সাড়া বিশ্বব্যাপী হয়ে যাওয়া ধ্বংসলীলার পরে এবার প্রতিষ্ঠানটি বাজারে নিয়ে আসে বিএমডব্লিউ আর২৪ মডেলের মোটরসাইকেল। নতুন করে আবার শুরু করে মোটরবাইকের যাত্রা। এভাবেই আস্তে আস্তে অটোমোবাইল শিল্পে বিএমডব্লিউ নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে।
আশ্চর্য রকম মজবুত গঠনশৈলী এবং রুচিশীলতার জন্য আর৩২ এর মতোই, এই মোটরসাইকেল সিরিজটিও ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য অর্জন করে।
আর২৪-এর সাফল্যের পর, বিএমডব্লিউ নিজেদের ট্রাম্প কার্ডটি ব্যবহার করে। এবার আর দুই চাকার মোটরবাইক নয় চার চাকার গাড়ি নিয়ে আসে তারা। বিএমডব্লিউ ৫০১ মডেলের, ছয় সিটের চোখধাঁধানো গাড়ি সিরিজ উন্মোচনের ঘটনাটি মানব ইতিহাসে বিশেষ একটি দিন।
শুধু তাই নয়, ছয়-সিলিন্ডার ইঞ্জিনে সজ্জিত এই বিলাসবহুল গাড়ি সিরিজটি শীর্ষ-স্তরের অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক হিসাবে বিএমডব্লিউ -এর খ্যাতি আকাশচুম্বী করে তোলে।
বিএমডব্লিউ-এর সম্প্রসারণ (১৯৬১-১৯৯৮)
সালটি ছিল ১৯৬১, ফ্রাঙ্কফুর্ট মোটর শোতে বিএমডব্লিউ উন্মোচন করে তাদের ১৫০০ মডেলের সিরিজটি। এই সময়, বিএমডব্লিউ বেশ চতুরতার সাথে, গাড়ি তৈরির বাজারের শূন্যতাকে পুঁজি করে এবং চার জনের একটি পরিবারের জন্য উপযুক্ত চার দরজার এই গাড়িটি বাজারে সরবরাহ করে।
এই যুগে, বিএমডব্লিউ বিশ্বের অন্যান্য অংশে বিস্তৃত হতে শুরু করে এবং প্রথম যানবাহন উৎপাদন কারখানা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সাথে, কোম্পানি তাদের গাড়িগুলোর বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় সহায়ক সংস্থাগুলি চালু করা শুরু করে। আইকনিক বিএমডব্লিউর সদর দপ্তর ভবন এবং জাদুঘরও এই সময়েই নির্মিত হয়েছিল।
বিএমডব্লিউর একবিংশ শতাব্দীর দিকে যাত্রা (১৯৮৭- ১৯৯৮)
ক্রমবর্ধমান গাড়ির চাহিদা মেটাতে বিএমডব্লিউ রেজেনসবার্গে একটি উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। BMW 3 সিরিজ ছিল নতুন প্ল্যান্টে নির্মিত প্রথম মডেল। পরবর্তীতে ১৯৯০ এর দশকের মধ্যে, বিএমডব্লিউ উচ্চতর কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত যানবাহন তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে।
যার ফলশ্রুতিতে, ব্র্যান্ডটি মিউনিখে একটি গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এই গবেষণা কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিএমডব্লিউর গাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা এবং মডেলগুলিতে চমকপ্রদ এবং যুগোপযোগী বৈশিষ্ট্যগুলি প্রবর্তন করা। শুধু তাই নয় জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ডটি রোভার গ্রুপ এবং বিলাসবহুল গাড়ি কোম্পানি রোলস রয়েস এর স্বত্বাধিকার গ্রহন করে।
বিএমডব্লিউর ইলেকট্রিক কার-২০১৩ থেকে বর্তমান
বিএমডব্লিউ অনেক দিন ধরে বৈদ্যুতিক গাড়ির উপর কাজ করে আসছিল এবং অবশেষে, ২০১৩ সালে, ব্র্যান্ডের প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি সকলের সামনে আসে। চোখ ধাধানো অল-ইলেকট্রিক আই-এইট গাড়িকে চালিত করার জন্য একটি বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে এবং এটি সম্পূর্ণ নির্গমন-মুক্ত।
জ্বালানি তেল ছাড়া মাইলের পর মাইল ছুটতে পারে গাড়িটি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ এর সাহায্যে। রেসিং গাড়িগুলোর সমকক্ষ উচ্চগতি এবং মসৃণ চলনক্ষমতার কারণে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করা এই মডেলটি ২০২০ সালে ২০,০০০ সংখ্যা গাড়ি বিক্রিত হয়। যা সেরা বিক্রিত গাড়ির তালিকায় শীর্ষে নিয়ে যায় বিএমডব্লিউকে।
এয়ারক্রাফ্ট ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক হিসাবে যাত্রা শুরু করা বিএমডব্লিউ শতাব্দি প্রাচীন গাড়ির ব্র্যান্ড হিসেবে বর্তমানেও দাপটের সাথে ব্যবসা করছে এবং ক্রেতাদের ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গাড়ি প্রেমিকদের মতে সেরা ব্রান্ড হিসেবে গণনা করার মূল কারণ এর আকর্ষণীয় মডেল এবং অত্যাধুনিক বৈশিষ্ট্য।
Feature Image: caranddriver.com References: 01. BMW Car History. 02. The Most Important Cars in BMW History. 03. BMW History. 04. History of BMW.