১৭-১৮ শতকের কথা। আটলান্টিকের বুকে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশের সুনসান কোনো এক দ্বীপ। আমেরিকা সদ্য উপনিবেশের আওতায় আসায় ইউরোপের সাথে যোগাযোগের জন্য এই পানিপথ জাহাজ চলাচলের বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে।
কুয়াশার চাদরে জড়ানো কোনো এক ভোরে লাতিন গামী এক ইউরোপীয় জাহাজ যাচ্ছিল নাম না জানা এক দ্বীপের পাশ দিয়ে। হঠাৎ তাদের ঘিরে চক্কর দিতে লাগলো বেশ কয়েকটা জাহাজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ। চোখের নিমেষেই জলদস্যুদের কব্জায় চলে গেল মালভর্তি জাহাজ।
১৭-১৮ দশকের নিয়মিত চিত্র ছিল এই জলদস্যুদের বাণিজ্যিক জাহাজ আক্রমণ। তবে আলাদা করে একজন ত্রাস ছড়িয়েছে পুরো ফ্লোরিডা থেকে বাহামা অবধি। তার নাম এডওয়ার্ড টিচ। তার মুখের কিম্ভুতকিমাকার দর্শনের জন্য সে ব্ল্যাকবিয়ার্ড নামেও পরিচিত। বলা হয়ে থাকে এযাবৎকালের অন্যতম বিখ্যাত ও হাইলাইটেড জলদস্যু বা পাইরেটস ছিলেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড।
সে মূলত তার ভয়ঙ্কর চেহারা এবং ক্যারিবীয় দ্বীপে ভয়ঙ্কর সব অভিযানের জন্য বিখ্যাত। জানা যায়, সে তার চেহারা আরও ভয়ঙ্কর যেন দেখায় সেজন্য মুখের দুই পাশে মশাল জাতীয় কিছু লাগিয়ে রাখতো। কোনো অভিযানের সময় সে তার মুখের দুই পাশের মশালগুলো জ্বেলে দিতো, তখন আলোর ঝলকানিতে তার মুখ আরও ভয়ঙ্কর ও পাশবিক দেখাতো।
তার ফিতায় বাঁধা লম্বা কালো দাড়ি, টুপির নিচে ও মুখের দুইপাশে জ্বলন্ত আগুন, ক্রোধানল চাহনি, তার খ্যাতি, এসব কিছুই যথেষ্ট ছিল তার ভিক্টিম আর শত্রুর হাড় হিম করে দেওয়ার জন্য।

প্রারম্ভিক জীবন
এডওয়ার্ড টিচ, যাকে মূলত ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’ নামে চেনে ইতিহাস, তার জন্ম ১৬৮০ সালে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলের উপকূলে থাকতো সে। যেখান থেকে এশিয়া, ইন্ডিয়া, লাতিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে ইংলিশ জাহাজগুলো ছেড়ে যেত। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় তার দীক্ষা আছে কিনা সে সম্পর্কে বিশদ জানা না গেলেও সে যে মোটামুটি লেখাপড়া জানতো তা তার লাইফস্টাইলের দিকে লক্ষ্য করলে আন্দাজ করা যায়।
সমুদ্রে এডওয়ার্ড টেচ
এডওয়ার্ড টিচ ১৭ শতকের শেষের দিকে ক্যারিবিয়ানে পৌঁছায় একটা প্রাইভেটিয়ার শিপের ক্রু মেম্বার হিসেবে। সে কেন সমুদ্রের জীবন বেছে নিয়েছে সেই সম্পর্কে জানা যায়নি, তবে সেই সময়কার নব্য উপনিবেশবাদের জন্য তখন তৎকালীন শক্তিধর রাষ্ট্র, যেমন: ইংল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্সের নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য সমুদ্র অভিযান ট্রেন্ড হয়ে উঠেছিল।
সেই সময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর স্পেনের মধ্যে আমেরিকার সম্পদের জন্য সংঘাত পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। আর সেই সাথে বাড়তে থাকে জাহাজের ক্রু নিয়োগ। একইসাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল জলদস্যু, ডাকাতির মতো ঘটনাগুলো।
সেই সময়কার জাদরেল জলদস্যু হেনরি এভরি এরই মধ্যে নিউ প্রভিডেন্স এবং পোর্ট রয়্যালে বিপুল পরিমাণ মালামাল লুট করে জলদস্যুতার মাধ্যমে। যার কারণে জলদস্যুটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল।
তবে ১৭১৬ সালটা ছিল একটা পরিবর্তনের বছর। সদ্য তথাকথিত ‘War of the Spanish Succession’ শেষ হওয়ায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যকার দ্বন্দ্বও কমতে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে প্রাইভেটিয়ার, নাবিক, ক্রু ছাটাই শুরু হয়। ফলে দারিদ্র্য মেটাতে অনেকে জলদস্যুতার দিকে ঝুঁকে পরে। এডওয়ার্ড টেচও ছিল তাদের মধ্যে একজন।

সে ১৭১৬ সালে বেঞ্জামিন হার্নিগোল্ডের জাহাজে ক্রু হিসেবে নিয়োগ দেয়। বেঞ্জামিন হার্নিগোল্ড ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ জলদস্যু, সাবেক নাবিক। নিউ প্রভিডেন্স, বাহামা অঞ্চলে জলদস্যুতা করে ত্রাস ছড়িয়েছে ইতিমধ্যেই। হার্নিগোল্ড শুরুতেই এডওয়ার্ড টেচ এর মধ্যে প্রতিভা, দক্ষতা, সামর্থ্যের ছাপ দেখতে পেয়েছিল।
এডওয়ার্ড টেচ থেকে ব্ল্যাকবিয়ার্ড হয়ে ওঠা
তার এই সামর্থ্য আর দক্ষতার জন্য অচিরেই সবার নজর কাটলো এবং হার্নিগোল্ড এর থেকে একটা ছোট জাহাজ ও ক্রু উপহার পেল সে। অন্যান্য জলদস্যুদের মতো তাদের ঘাটিও ছিল আটলান্টিক-এর বুকে নিউ প্রভিডেন্স দ্বীপগুলোতে।
তারা দুইজন একসাথে নর্থ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় ছেড়ে আসা জাহাজগুলো লুটপাটে নেতৃত্ব দিতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা জাহাজ হলো ‘কনকর্ড’ যা একটি ফ্রেঞ্চ জাহাজ। জাহাজটি আফ্রিকা থেকে স্বর্ণ, মুক্তাসহ বিভিন্ন দামী মালামালে ঠাসা ছিল। টেচ ১৭১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভিনসেন্ট দ্বীপের নিকটে জাহাজটিতে আক্রমণ চালায় এবং নিজের কব্জায় নিয়ে আসে। এরপর সে এটির নাম দেয় ‘কুইন আনা’স রিভেঞ্জ’।
১৮১৮ সালের শুরুর দিকে এডওয়ার্ড টেচ ধীরে ধীরে ব্ল্যাকবিয়ার্ডে পরিণত হতে শুরু করে। এর মধ্যেই হার্নিগোল্ড দস্যুতা থেকে নিজের নাম ইস্তফা দিলে তার পুরো মালিকানা ব্ল্যাকবিয়ার্ড এর হাতে চলে আসে। সেই সময় তার ক্রু’র সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪০০ এর আশেপাশে। তার ত্রাসের রাজত্বও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
শোনা যায়, সেই সময় সে তার জাহাজে একটা আইকনিক পতাকা লাগিয়ে রাখতো। পতাকাতে একজন লোকের এক হাতে বালিঘড়ি আর আরেক হাতে বর্ষা। বর্ষাটা একটা রক্তমাখা হৃৎপিণ্ডের দিকে তাক করা। এটা দিয়ে বোঝাতো যে, যেসব জাহাজ তার খপ্পরে পড়বে, তখনই তার আয়ু শেষ এবং মৃত্যু অবধারিত।

সে ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর আশেপাশে তার দস্যুতা চলমান রাখে। সম্মুখযুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় জয় ছিল যুদ্ধ জাহাজ ‘স্কারবোরো’ এর বিরুদ্ধে। ওই জাহাজটিও একটি বড় দস্যু জাহাজ ছিল। ১৭১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নর্থ ক্যারোলাইনাতে যাওয়ার সময় ওক্রেকোক দ্বীপে উপযুক্ত ঘাঁটি খুঁজে পায়।
সেখান থেকেই জাহাজ ডাকাতি আর লুটপাটের মাধ্যমে দিন কাটাতে থাকে। এখানে থাকার সুবিধা হচ্ছে, কাছাকাছি বড় মার্কেট থাকায় লুটপাট করা মালামাল সহজে বিক্রি করা যায়। তাছাড়া, স্থানীয় সরকারকে ঘুষ দেওয়ায় সেও তেমন রা করতো না।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড ও তার ক্রু’রা শুধু সাধারণ বাণিজ্যিক জাহাজ না, ফ্লোরিডার দিকে ছেড়ে যাওয়া পাইরেটস জাহাজেও আক্রমণ চালাতো। তার শুধু নিজের ৪টা জাহাজ আর ৪০০ ক্রু’এর ওপরই কর্তৃত্ব ছিল না। ক্যারিবীয় দ্বীপের অন্যান্য মিত্র জলদস্যুদের ওপরও তার প্রভাব ছিল। তার মিত্রদের নিকট তার জনপ্রিয় হওয়ার অনেক কারণও ছিল।
১৭১৮ সালের একটা ঘটনা। তার এক ক্রু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে চার্লস টাউনের নিকটে। এরপর ব্ল্যাকবিয়ার্ড সেখানকার জাঁদরেল আসামী ও প্রোভিন্স অব ক্যারোলাইনার সদস্য স্যামুয়েল র্যাগকে নির্দেশ দেন, সেখানকার আটটি জাহাজ দখল করে তার বাহিনী এবং সবাইকে বন্দী করতে।
বন্দী করার পর স্থানীয় সরকারকে আল্টিমেটাম দেয় যে, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওষুধ পৌঁছানো না হয়, তাহলে সব জাহাজ পুড়িয়ে ফেলা হবে এবং বন্দীদের মাথা গভর্নরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

এরকম আরও বহু উদাহরণ আছে, যেসব কারণে সব ক্রু ও মিত্ররা সহজে তার আনুগত্য মানবে, তার দ্বারা প্রভাবিত হতো। চার্লসটাউনের ঘটনাটার মাধ্যমে তার জনপ্রিয়তা, তার অনুগতদের প্রতি দায়িত্বশীলতা দেখা যায়।
১৭১৭ সালের পর থেকে সে নিজেকে শুধু একজন অভিজ্ঞ কাপ্তান হিসেবেই নয়, একজন ভয়ঙ্কর, জাঁদরেল নেতা হিসেবে তৈরি করেছে। দূর্ভাগ্যবশত, চার্লস টাউনের ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই ব্ল্যাকবিয়ার্ড এর ‘কুইন অ্যানি’স রিভেঞ্জ’ সাগরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর ব্ল্যাকবিয়ার্ড হার্নিগোল্ড এর মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমা নিয়ে সাধারণ জীবনযাপনের পরিকল্পনা করে।
১৭১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সে ব্যাথ টাউনে ফিরে যায় এবং তার পুরনো বন্ধু গভর্নর এডেনের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। কিন্তু ব্ল্যাকবিয়ার্ডের সততার সাথে জীবনযাপনের ইচ্ছার চেয়ে সমুদ্রের ডাক আরও বেশী শক্তিশালী ছিল। তাই বেশীদিন সে এভাবে থাকতে পারেনি। কিছুদিন পরেই সাদাসিধে জীবন ছেড়ে সমুদ্রে পাড়ি জমায় এই ভয়ঙ্কর দস্যু নেতা।
এরপর তার সাথে দেখা হয় আরেক দস্যু নেতা ভ্যান-এর সাথে। তারা দুইজন মিলে ভার্জিনিয়া পোর্টেট নিকটে জাহাজে লুটপাট চালাতে থাকে। সেই সময় বাধ্য হয়ে সেখানকার গভর্নর লেফট্যানান্ট রবার্ট মেইনার্ড এর অধীনে ৫৭ জন সৈনিক পাঠায় ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে হত্যা করার জন্য। এরপর নানা ঘটনা ও সম্মুখ যুদ্ধের পর ১৭১৮ সালের শেষের দিকে মেইনার্ড ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে হত্যা করতে সামর্থ্য হয়।

ব্ল্যাকবিয়ার্ড তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর চার্লস জনসন ও ড্যানিয়েল ডিফোর ‘দ্য জেনারেল হিস্টোরি অব দ্য রবারিস অ্যান্ড মার্ডার্স অব দ্য মোস্ট নটোরিয়াস পাইরেটস’ বইয়ে জায়গা করে নেয়।
বইটি সম্পাদিত হয় ১৭২০ সালে। ডিফো এই বইয়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে একজন স্যাডিস্ট মনস্টার, ঔদ্ধত্যপূর্ণ, ঠান্ডা মাথার দস্যু নেতা হিসেবে বর্ণনা করেছে। তার শারীরিক বর্ণনা বইটিতে এভাবে দেওয়া হয়েছে:
উল্কার মতো দেখতে ক্যাপ্টেন টিচের কালো দাড়ি এবং ঘন লম্বা চুল, তার পুরো মুখটা ঢেকে রাখতো। টিচ তার এই উল্কার মতো চুল-দাড়িওয়ালা চেহারা দিয়ে আমেরিকায় আঘাত হানা যেকোনো উল্কার চেয়েও বেশি ভীতি ছড়িয়েছিল।
তার দাড়িগুলো কালো এবং অত্যাধিক লম্বা ছিল। যার কারণে সে এগুলোকে ফিতা দিয়ে বেঁধে কানের পাশে গুঁজে দিতো। অভিযানের সময় সে তার কাঁধে পিস্তল, গুলিসহ হোলস্টার কার্তুজের পেটির মতো কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতো।
তাছাড়া, ছোট ছোট আলোকবাজির মতো মশালে টুপির দুপাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখতো, যেটা তার মুখের দুইপাশে ঝুলতো। এমনিতেই তার চোখ ও চেহারা পাশবিক দেখাতো, মশাল থেকে ঠিকরে আসা আগুনের আলোয় তার চেহারা হয়ে উঠতো আরও ভয়ঙ্করদর্শন। এই দর্শনটা শুধু তার ক্রোধই ফুটিয়ে তুলতো না, মনে হতো নরক থেকে আসা কোনো ভয়ঙ্কর কিছু।
:quality(70)/arc-anglerfish-arc2-prod-tronc.s3.amazonaws.com/public/GPGAERYO6VEFTK6HUKASOI35LY.jpg)
এছাড়া বেশ কয়েকটি মুভি ও বইয়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ড চরিত্রকে পোট্রের্ট করা হয়েছে। ব্ল্যাকবিয়ার্ড শুধু তার শিকারকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো, তেমনটা না। এমনকি তার ক্রু’রাও তার খামখেয়ালি আচরণ থেকে রেহাই পেতো না।
একবার সে বসে বসে মদ্যপান করছিলেন। হঠাৎ করে তার সামনে ক্রু’রা কিছু একটা নিয়ে হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয়। সে তখন তার সামনে থাকা দুটি পিস্তল নিয়ে সামনে ক্রু’দের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। গুলিবিদ্ধ হলো কয়েকজন। তারা জানতে চাইলো তাদের দোষ কী! তখন সে জবাবে বলে যে,
সে যদি এই মুহুর্তে তাদের উপর গুলি না চালাতো,
তাহলে তারা ভুলে যেতো যে সে আসলে কে।
Feature Image: FOTOTECA GILARDI/GETTY IMAGES
https://www.pirates-corsaires.com/pourquoi-avant-l-abordage-cri-t-on-pas-de-quartier-qr5912.htm
Content source: https://www.rmg.co.uk/stories/topics/blackbeard-edward-teach-piratehttps://
www.worldhistory.org/Blackbeard/
http://www.thewayofthepirates.com/famous-pirates/blackbeard/