ব্ল্যাক ডেথ: ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়

1707
0

Black Death শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় কালো মৃত্যু। আর কালো শব্দটাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অশুভ বা খারাপ কিছুর সংকেতবাহী হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। বিশ্ব ইতিহাসে সবচাইতে বীভৎস আর প্রাণঘাতী মহামারীকেই ব্ল্যাক ডেথ নামকরণ করা হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্বে করোনা মহামারীর পূর্বে পৃথিবী আরো যে ৯টি বিভীষিকাময় মহামারীর ছোবলে আক্রান্ত হয়েছিল তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই ব্ল্যাক ডেথ। এটাকে ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।  

ব্ল্যাক সী বা কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বলে একে ব্ল্যাক ডেথ নাম দেয়া হয়েছিল। তখনকার সময়ে ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছুই জাহাজের মাধ্যমেই হতো। আর তাই রোগটাও জাহাজের মাধ্যমেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৩৩০ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মহামারী। কোটি কোটি নিরীহ প্রান অকালে হারিয়ে যায় এই মহামারীর কবলে পড়ে। উন্নত বিজ্ঞান না থাকায় ছিল না সুচিকিৎসার সুযোগ। তাই কিছু বুঝে উঠার আগেই মহামারী তার ব্যাপকতা ছড়িয়ে ইউরোপকে গ্রাস করে ফেলেছিল। 

১৩৩০ থেকে ১৩৫০ শতাব্দীর মধ্যে প্লেগ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তার একটি চিত্রিত রূপ। Photos by ancient.eu

প্লেগ কি? এর লক্ষণ ও উপসর্গ

প্লেগ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। এই রোগ যেমন ছোঁয়াচে তেমনই মরণঘাতি। এই রোগটি মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহেই হয়ে থাকে সাধারণত। প্লেগ প্রধানত ৩ প্রকারের হয়ে থাকে। তবে এই রোগের উপসর্গগুলো এদের প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে। 

১. বিউবনিক প্লেগঃ এই ধরনের প্লেগে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে টনসিলের মত ফুলেও যায়। জ্বর হয়। আর টনসিলের মতো ফোলা জায়গাগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় ফেটে যায়। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যায়। লসিকা গ্রন্থি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং মূলত এখান থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। 

২. সেপ্টিসেমিক প্লেগঃ এই ধরনের প্লেগে শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভূত হয়। সাথে জ্বর আর ঠাণ্ডা-কাশিও থাকে। প্রচণ্ড পেট ব্যথা রোগীর শরীরকে আরো দুর্বল করে ফেলে। এছাড়াও, পায়ের নীচে কালো হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দেয়। 

৩. নিউমোনিক প্লেগঃ এই রোগে সাধারণত নিউমোনিয়ার প্রকোপই বেশী লক্ষ্য করা যায়। ঠাণ্ডা-জ্বর আর কাশির পাশাপাশি বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে অসুবিধাসহ নিউমোনিয়া রোগের উপসর্গগুলোই লক্ষ্য করা যায়। 

মধ্যযুগের এক শিল্পকর্মে প্লেগে আক্রান্ত রোগী। Photos by history.com

সংক্রমণ

যে সকল জীবানু রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী তাদেরকে প্যাথজেনিক বলা হয়। Yersinia pestis নামক এক ধরনের প্যাথজেনিক মূলত প্লেগ রোগের জন্য দায়ী। ধারণা করা হয়, উকুন এবং মাছি থেকেই এই রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে। তবে পূর্বে ইঁদুরকেও দায়ী করা হতো এই রোগের জন্য। 

ইউরোপের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল এই রোগটিতে; সংখ্যায় যা প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি। আলেকজান্দ্রায়ে ইয়ারনিস নামক একজন ফরাসি বিজ্ঞানী এই প্লেগ রোগের জীবাণু (ব্যাসিলাস) আবিষ্কার করেন। এই ব্যাসিলাস জীবাণুটি বাতাস, মাছি এবং ইঁদুরের সাহায্যে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। 

রোগটা প্রথমে কব্জি বা বোগলের নীচে ছোট ছোট টিউমারের মতো হয়ে ধীরে ধীরে পোষক দেহে বেড়ে উঠতে থাকে। পরে তা এমনকি আপেল বা ডিম্বাকৃতিও ধারন করে থাকে। আর সেগুলো দেখতে অনেকটা কালচে বর্ণের হয়ে থাকে। এরপর কব্জি বা বোগলের তল থেকে শুরু করে সারা শরীরে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে দেহে পচন ঘটিয়ে পোষক দেহকে তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্লেগে প্রতি বছর প্রায় ৩০০০টি কেইস ফাইল খোলা হয়। যার বেশিরভাগই এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে হয়ে থাকে।   

একজন নার্স প্লেগে আক্রান্ত এক রোগীর সেবা করছেন। Photos by arcgis.com

উৎপত্তি বা সূত্রপাত

ধারণা করা হয়, প্লেগ রোগের শুরুটা হয়েছিল মধ্য এশিয়ায়; বিশেষ করে চীনে। পরবর্তীতে তা বাণিজ্য পথ ধরে দ্রুত পশ্চিমের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার সময়ে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বানিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল সিসিলিয়ান বন্দর। কথিত আছে, ৬০-৭০ ভাগ বাণিজ্যই এই বন্দর কেন্দ্রিক হতো। 

সব সময়ের মতোই ১৩০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে ইউরপের কৃষ্ণসাগরের সিসিলিয়ান বন্দরে নোঙর ফেলে ১২টি বাণিজ্য জাহাজ। কিন্তু অন্যান্য সময়ের মতো সেবার সবকিছু স্বাভাবিক ঠেকছিল না। বাণিজ্য জাহাজগুলো নোঙর করামাত্রই বন্দর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের বিশ্রী বাজে গন্ধ। বাতাসে প্রচণ্ড বিশ্রী ও পচা গন্ধ পেয়ে আশেপাশের উৎসুক জনগণ জাহাজের ডেকে এসে দেখতে পান এক লোমহর্ষক দৃশ্য।

জাহাজের সব নাবিকই মৃত। এমনকি মরে পচে গলে গিয়েছে এমন লাশও দেখতে পায় তারা। সেইসব লাশের উপর শত শত মাছি ভনভন করে উড়ছে। তাদের গাঁ জুড়ে অসংখ্য পচা ঘা আর সেগুলোই যেন মাছির আহারে পরিণত হয়েছে। নাবিকদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল তাদেরও প্রায় মুর্মুর্ষু অবস্থায়ই ছিল। কেননা, তাদের সকলের শরীরেই সেই একই রকমের পচা ঘা। যেগুলো শরীরের অনেকাংশে ফেটে গিয়ে কালো রক্ত ঝরাচ্ছে। 

এই অবস্থা দেখে সিসিলিয়ান বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজগুলোকে তাড়াতাড়ি বন্দরের বাইরে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাতাস ও মাছির মাধ্যমে ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক রকমের সংক্রমিত এই রোগ। আর এর চরম খেসারত দিতে হয়েছিল পুরো ইউরোপবাসীকে।

সিসিলিয়ানে আঘাত হানার অল্প কিছুদিন পরেই ব্ল্যাক ডেথ ফ্রান্সের মার্সিলিস বন্দরে ও উত্তর আফ্রিকার তিউনিস বন্দরে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে তা বাণিজ্যকেন্দ্র রোম এবং ফ্লোরেন্সেও পৌঁছে গিয়েছিল। ১৩৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্যারিস, বোর্দো, লিয়ন ও লন্ডনে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। পরবর্তীতে উনিশ শতকে আবারো ইউরোপের অনেকগুলো অঞ্চলে দেখা দিয়েছিল এই রোগ। 

মধ্যযুগের বাণিজ্যের একটি চিত্রিত রূপ। Photos by theravenreport.com

ভ্রান্ত বিশ্বাস

সেই সময়ে বিজ্ঞান ছিল ধর্মের প্রথম ও প্রধান শত্রু। আর তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতিও ছিল খুবই মন্থর ধারায়। তবে, সেই সময় কুসংস্কার ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। বিজ্ঞানের সঠিক ব্যাখ্যা না থাকায় বেশীরভাগ মানুষজন নানা কুসংস্কার আর ভ্রান্ত মতবাদকে সত্য হিসেবেই আঁকড়ে ধরতেন। তাই মধ্যযুগের সেই মহামারীর সময়টাতে ধারণা করা হয়েছিল, প্লেগ হচ্ছে ঈশ্বরের দেয়া শাস্তির স্বরূপ। 

মূলত ব্যভিচার, মিথ্যা, লোভ, পরনিন্দা, ধর্ম বিরোধিতা ইত্যাদি কারণে ঈশ্বর মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্য এই রোগ স্বর্গ থেকে পাঠিয়েছেন, এমনটাই ধারণা ছিল তাদের। তারা মনে করতে শুরু করেছিল, চিকিৎসা বিজ্ঞান নয় বরং ঈশ্বরের ক্ষমা প্রাপ্তির মাধ্যমেই কেবল মাত্র মিলতে পারে এই রোগ হতে মুক্তি। এই ধারণা থেকে প্লেগে আক্রান্ত রোগীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বা গোসল করতে দেয়া হতো না। 

তারা মনে করতো এতে ঈশ্বর আরো রেগে যেতে পারেন। কুসংস্কার ডালপালা মেলে শাখাবিস্তার করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তখন ছড়িয়ে পড়া অন্যতম আরেকটি কুসংস্কার ছিল, রোগীকে গন্ধ শোকানো। অর্থাৎ লোকেরা ধারণা করতো যে, রোগীকে পচা মলমূত্রের, গুল্মের সুগন্ধী বা গোলাপ জলের গন্ধ শুঁকালে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এইসব কেবলই কুসংস্কার ছিল না বরং এগুলো তারা আমলেও নিত বটে। 

বাইবেলে চিত্রিত ব্ল্যাক ডেথের একটি দৃশ্য। Photos by livescience.com

প্লেগ রোগের একাল-অকাল

ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার আগেও এই রোগের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব ভুগেছে। চলুন তাহলে এবার জেনে নেই কবে, কখন আর কোথায় এই প্লেগ তার তাণ্ডব চালিয়ে ছিল। 

এথেনিয়ান প্লেগঃ ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইথিওপিয়াতে এই রোগের সংক্রমন শুরু হয়। এর উৎপত্তি হয়েছিল উত্তর আফ্রিকায় পরে তা মিশর ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারী মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, ধর্ম এবং সকল ধরণের নিয়ম-নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সবাই। মানুষ মৃত্যুভয়ে ছিল আড়ষ্ট। 

এন্টোনাইন প্লেগঃ রোম সাম্রাজ্যে আনুমানিক ১৬৫-১৮৫ খ্রিস্টাব্দে এন্টোনাইন প্লেগ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মূলত যুদ্ধফেরত সৈন্যদের মাধ্যমে সমগ্র রোম সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল এই মহামারীতে। জ্বর, গলা ব্যথা, ডায়রিয়া ছিল এই রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

জাস্টিনিয়ান প্লেগঃ বাইজেন্টাইনদের সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আমলে (৫২৭ থেকে ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ) দেখা দেয় এক মহামারি। সম্রাট নিজেও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পরে তার নাম অনুসারে এই মহামারির নাম দেয়া হয় জাস্টিনিয়ান প্লেগ। তখনকার সময়েও এই প্লেগ রোগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর। রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছিল এই জাস্টিনিয়ান প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে। 

মধ্যযুগের প্লেগের ভয়াবহতা। Photos by AFP/Bianchetti Leemage.

শেষ কথা

ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপের ধর্মীয়,বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালির মতো উন্নত দেশগুলোতে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ শ্রমিক সংকট। যার ফলে শ্রমিকের পারিশ্রমিক ছিল  আকাশচুম্বী। মিল, কল-কারখানার মালিকেরা তাদের উৎপাদন চালিয়ে যেতে হিমশিম খেয়ে যায়। একটা সময় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থাও দেখা দেয়। 

Feature Image: Bettmann Archive/Getty Images
তথ্যসূত্রসমূহ:

01. Plague (Yersinia Pestis)
02. দ্য ব্ল্যাক ডেথঃ ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক মহামারী
03. ব্ল্যাক ডেথ 
04. প্লেগের ইতিবৃত্ত
05. মহামারির ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন