Wise and humane management of the patient is the best safeguard against infection.
– Florence Nightingale
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (১৮২০-১৯১০), দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প নামে সবার কাছে পরিচিত। তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন ব্রিটিশ নার্স, সমাজসেবী এবং পরিসংখ্যানবিদ। তাকে আধুনিক নার্সিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেও সবাই জানেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় নার্স হিসাবে তার অভিজ্ঞতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেয়। সাথে সাথে সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা জোগায়।
১৮৬০ সালের দিকে সেন্ট থমাস হাসপাতাল এবং নার্সদের জন্য নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বলে রাখা ভালো যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ১৮৫৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল-এর প্রথম জীবন
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর জন্ম আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ফ্রান্সেস নাইটিঙ্গেল এবং উইলিয়াম নাইটিঙ্গেলের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্লোরেন্স এর নামকরণ করা হয়, তিনি যে শহরে জন্মেছিলেন তার নাম অনুসারে। দুই সন্তানের মধ্যে ছোট ছিলেন তিনি।
পৈত্রিকভাবে বেশ ধনী ব্রিটিশ পরিবার এবং অভিজাত ছিল তারা। যদিও প্রথমে তাদের পারিবারিক পদবী ছিল শোর। ১৮১৫ সালে তার দাদার ভাই এর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার পরে তিনি তার নাম পরিবর্তন করে নাইটিংগেল রেখেছিলেন। ১৮২১ সালে পরিবারটি ইংল্যান্ডে চলে আসে।
শিশুকাল থেকেই ফ্লোরেন্স অত্যন্ত মেধাবী আর বুদ্ধিদ্বীপ্ত ছিলেন। তার বাবা তাকে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনবিদ্যাসহ নানান বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। এছাড়াও, তিনি গণিত এবং নানান ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। অল্প বয়সে ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, গ্রিক এবং লাতিন ভাষায় পড়তে এবং লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি তার বাবার সাথে গুরুতর রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনা করতে পারতেন।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এবং নার্সিং
খুব অল্প বয়স থেকেই, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পরোপকারে নিবেদিত ছিলেন। তিনি তার পরিবারের এস্টেটের প্রতিবেশী গ্রামের অসুস্থ ও ওসহায় লোকদের পরিচর্যা করে বেড়াতেন। তার বয়স যখন ১৬ বছর, বুঝে গিয়েছিলেন যে সেবা বা নার্সিং তার মনের মতো কাজ। মানব সেবাই তার জীবনের উদ্দেশ্য বলে তিনি মনে করতেন।
ভিক্টোরিয়ান যুগের যে সময় তার জন্ম সেই সময়, ফ্লোরেন্সের মতো উচ্চ সামাজিক মর্যাদার একজন তরুণীর কাছে আশা করা হয়েছিল যে তিনি উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদার একজন ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন। নার্সিং তো নিম্নশ্রেণীর মানুষের পেশা। ফ্লোরেন্স যে স্বপ্ন নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছিলেন, তিনি সেবা বা নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান এটা জানিয়ে।
স্বভাবতই তার বাবা মা রুষ্ট হয়েছিলেন। আর নিজের জেদ আর মানব সেবার প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৭ বছর বয়সে রিচার্ড মঙ্কটন মিলনেস নামের তথাকথিত উচ্চপদমর্যাদার এক ব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বাবা-মা এর আদেশ অগ্রাহ্য করে ১৮৪৪ সালে জার্মানির কাইজারওয়ার্থের পাস্টর ফ্লিডনারের লুথেরান হাসপাতালে (Lutheran Hospital of Pastor Fliedner in Kaiserwerth) নার্সিং এর ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন।
১৭ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ১৯ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কে ইতিহাসবিদ ফিল্ড গ্যারিসন নার্সিং এর অন্ধকার যুগ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ে নার্সরা সাধারণত দরিদ্র পরিবার থেকে আসত, তারা যেমন অদক্ষ এবং অপেশাদার ছিলেন এবং প্রায়শই অনৈতিক আচরণের সাথে যুক্ত ছিল। নাইটিঙ্গেল সেই প্রথা এবং ভ্রম ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৮৫০ সালে তিনি মিস নাইটিঙ্গেল নিজের শহর লন্ডনে ফিরে আসেন। মিডলসেক্স হাসপাতালে নার্সিং এর চাকরী নেন। তার দক্ষতা আর প্রতিভার কারণে এক বছরের মধ্যেই তিনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কলেরার বিরুদ্ধে তার যে লড়াই ছিল, তা জাদুর মতো হাসপাতালে মৃত্যুর হার হ্রাস করেছিল। তার দক্ষতা আর মেধার প্রমাণ এখানেই। কিন্তু অমানবিক পরিশ্রম তাকে অসুস্থ করে ফেলেছিল।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এবং ক্রিমিয়ার যুদ্ধ
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একাধিক ক্ষেত্রে তার সাক্ষর রেখে গেছেন, কিন্তু ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৬ ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় তার আত্মত্যাগের জন্য আজ পর্যন্ত তিনি স্মরণীয়। ১৮৫৪ সালের ৪ নভেম্বর নাইটিঙ্গেল এবং ৩৮ জন নার্সসহ কনস্টান্টিনোপলের বাইরে ব্রিটিশ শিবির স্কুটারিতে পৌঁছান। ইংরেজ যুদ্ধ শিবিরের হাসপাতালের ভয়াবহ অবস্থার বিবরণ দিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত নিবন্ধ প্রকাশিত হতো।
যুদ্ধ সচিব এবং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিডনি হার্বার্ট তাকে তুরস্কে মহিলা নার্সদের একটি দলকে নেতৃত্ব দিতে অনুমতি দেন। স্বভাবতই নিজেদের আত্মমর্যাদার খাতিরেই হোক কিংবা দম্ভে চিকিত্সকরা এই নবাগত মহিলা নার্সদের স্বাগত জানাননি। কিন্তু, অকুল পাথারে পড়েছিলেন তারা, রোগীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে জনাকীর্ণ, অল্প কিংবা শূন্য সরঞ্জামের মজুদ এবং অস্বাস্থ্যকর হাসপাতালে তাদের সহায়তার প্রয়োজন ছিল।
ফ্লোরেন্সের নেতৃত্বে নার্সরা শিবিরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা শুধরে দেওয়া, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেন এবং রোগীদের জীবনে আরাম নিয়ে আসেন। শুধু তাই না, নাইটিঙ্গেল সৈন্যদের জন্য বাড়িতে চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থাও করেছিলেন, যা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।
তার নেতৃত্বে একদল নার্স মাত্র ছয় মাসের মধ্যে হাসপাতালটির পুরো চিত্র বদলে দেন। সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রূপান্তরিত করেন। রোগীদের সুস্থতার হার যেমন বেড়ে যায়, ঠিক তেমন রোগীদের মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ২ শতাংশে নেমে আসে।
দিনে রোগীর সেবা করতেন, আর বিনিদ্র রজনী তাদের খেয়াল রাখতেন। প্রতি রাতে হাতে প্রদীপ বা ল্যাম্প নিয়ে অসুস্থ আর আহত সৈন্যদের খেয়াল রাখতেন। প্রদীপ হাতে তার এই চলার কারনে, সৈন্যরা তাকে লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প নামে অভিহিত করেছিল। তার এই জলন্ত প্রদীপ যেন সবাইকে নতুন জীবনের আলোর প্রতীক ছিল। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়াম ইন লন্ডন, ব্রিটেনে সেই ল্যাম্পটি সংরক্ষিত রয়েছে।
ক্রিমিয়ান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পরবর্তী কয়েক বছর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষায় ইয়নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ক্যাম্প হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে রানী ভিক্টোরিয়ার সাথেও তার আলোচনাই চলত। এছাড়াও, নাইটিঙ্গেলের বুদ্ধি, তার দেয়া গাণিতিক এবং পরিসংখ্যানগত তথ্য, তার করা বিশ্লেষণ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যের চমৎকার বদল ঘটেছিল।
এমনকি ভারতবর্ষের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও তার ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে। ১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল সেই ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। ১৮৬০ সালে সেন্ট থমাস হাসপাতালে নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল খোলা হয়েছিল।
ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন সময় নার্সিংয়ের উপর বইও লিখেছেন। তার স্মরণে প্রতি বছর, ১২ মে পালন করা হয়, ইন্টারন্যাশনাল নার্স ডে। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ নার্সেস (আইসিএন) ১৯৬৫ সাল থেকে এই দিনটি নিয়মিতভাবে পালন করা হয়।
নার্সিং পেশা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন পরিসংখ্যানবিদ। লিখেছেন প্রায় ২০০ টির মত বই। তার মৃত্যুর দুই বছর পর, রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মেডেল তৈরি করে, যা প্রতি দুই বছর এই পেশায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া, সেরা আর তুখোড় নার্সদের দেওয়া হয়।
দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অভিজাত শ্রেণীর মহিলা হওয়ার পরেও সাধারন জীবন যাপন করে গেছেন। তার শেষ চাওয়া অনুসারেই ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে তাঁর শেষকৃত্য খুব সাধারনভাবে সম্পন্ন করা হয়।
Feature Image: medium.com References: 01. Florence Nightingale. 02. Florence Nightingale. 03. Florence Nightingale. 04. The Middle Ages. 05. The Lady with the Lamp.