রেনেসাঁ যুগের একজন বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি একাধারে ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক, ভাস্কর এবং স্থপতি। জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্সের তুসকান অঞ্চলে। ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল। পুরো নাম, লিওনার্দো দা স্যার পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি।
তার বাবা পিয়েরো ছিলেন একজন জমিদার, কিন্তু মা ক্যাটেরিনা ছিলেন একজন সাধারন পরিবারের মেয়ে। পরবর্তীতে তিনি একজন কারিগরকে বিয়ে করেন এবং পিয়েরেকেও বিয়ে করেন। লিওনার্দো তার বাবার কাছে বৈধ সন্তান হিসেবেই বড় হতে থাকেন। সেখানে তিনি মাতৃস্নেহও লাভ করেন। তবে যতটুকু জানা যায়, পিয়েরের দ্বিতীয় স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান। লিওনার্দোর ছেলেবেলা নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কৌতুহলী এবং সৃষ্টিশীল।
তার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। চোখদুটো সর্বদা তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকতো। তিনি নানা বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং তার সৃজনশীলতার বহুমুখী ব্যবহার করে গেছেন। তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল গভীর। জীবনের শেষপর্যন্ত তিনি সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
ল্যাটিন বা গণিতশাস্ত্র তাকে তেমন আকৃষ্ট করতো না। তবে তার আকর্ষণ ছিল চিত্রকলায়। ১৫ বছর বয়সে আন্দ্রেয়া ডেল ভেরোকিও-এর কাছে তাকে শিক্ষানবিশ হিসেবে পাঠানো হয়। ভেরোকিওর সুপরিচিত বহুমুখী কর্মশালায় তিনি চিত্রশিল্প এবং ভাস্কর শিল্পে জ্ঞান লাভ এবং কারিগরি প্রয়োগ শুরু করেন। সেই সাথে প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা লাভ করতে থাকেন।
১৪৭২ সালে তিনি ‘ফ্লোরেন্স পেইন্টার গিল্ড’-এর অন্তর্ভুক্ত হন। পেশাদার চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন ১৪৮২ সালে। ‘দি অ্যাডোরেশন অব ম্যাজাই’ ছিল তার প্রথম পেশাদার কাজ। কিন্তু এই চিত্রকর্মটি আর কখনোও শেষ করা হয়ে ওঠেনি তার।
কারণ, কাছাকাছি সময়ে তিনি মিলান চলে যান শাসক স্পরৎজা ক্ল্যান পরিবারের জন্য কাজ করতে। তিনি একাধারে প্রকৌশলী, চিত্রকর, নকশাকার এবং বিশেষ করে ভাস্কর হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ক্ল্যান পরিবার তাকে ক্ল্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিসকো ক্ল্যানের একটি ১৬ ফুট লম্বা ব্রোঞ্জের ভাস্কর তৈরি করতে দেন। তিনি এই প্রজেক্টে ১২ বছর কাজ করেন। ১৪৯৩ সালে একটি কাদামাটির মডেল প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত করেন। তবে ১৪৯৯ সালে স্পরৎজা ক্ষমতাচ্যুত হলে, কাদামাটির।ক্লে মডেলটি ধ্বংস করে দেয়া হয়।
তার অনেকগুলো গোপন নোটবুক ছিল। নোটবুকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপাত্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সেগুলোর কারিগরি প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে আশ্চর্য হতে হয়। তার নোট বইতে তিনি চিত্রকর্ম, চিত্রকর্মের ধরণ, বৈজ্ঞানিক ডায়াগ্রাম, তার নিজস্ব ভাবনা এই সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। এত বছর পর এসেও তার সেই সব গবেষণামূলক কাজ দেখে চমকে যেতে হয়।
তার মৃত্যুর পর নোটবুকগুলো জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। শারীরবিদ্যা নিয়ে তিনি বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। কঙ্কাল, পেশী, মস্তিষ্ক, পরিপাকতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র এসব নিয়ে তার গবেষণা এবং অধ্যয়ন চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নেও অবদান রেখেছে।
নোটবুকের পাতার পর পাতা মুখাবয়ব, মুখের পেশী, স্নায়ু, ঠোঁটের সঞ্চালন নিয়ে পরীক্ষামূলক স্কেচ করে গেছেন। ১৫০৩ সালে শুরু করে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত তিনি মোনালিসাকে পরিপূর্ণ করার কাজে লিপ্ত ছিলেন। যার ফলে রহস্যময়ী মোনালিসা ৫০০ বছর পরও আমাদের অভিভূত করে। আজকাল স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে সবাই মাতামাতি করে। অথচ সেই যুগে তিনি তার চিত্রকর্মের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
মূলত তিনি চিত্রশিল্পী হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। তার প্রিয় মিডিয়াম ছিল হ্যান্ডমেইড ওয়েল পেইন্টিং। এছাড়া, ডিমের সাদা অংশ থেকে তৈরি টেম্পুরা, ক্যানভাস, বোর্ড, ম্যুরেলের জন্য পাথর ব্যবহার করতেন। মেটে বাদামী, সবুজ, নীল এই রঙগুলো খুব স্নিগ্ধ আঁচড়ে ব্যবহার করতেন। ‘মোনালিসা’-র ঠোঁটেও তিনি উজ্জ্বল লাল বা চোখে নীল রঙ ব্যবহার করেননি।
আলো-ছায়ার খেলা নিয়ে তিনি কাজ করতে ভালোবাসতেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি বেস আঁকা থেকে শুরু করে পরতে পরতে রঙের ব্যবহার, ত্রিমাত্রিক ইলিউশন তৈরি এবং রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করতেন। আলো ছায়ার খেলা একে অপরের সাথে ক্রমশ মিশে যেতো কোনো প্রকার আউটলাইন ছাড়াই। তার বেশিরভাগ চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে ল্যুভর মিউজিয়ামে।
অমর চিত্রকর্ম
মোনালিসা’ এবং ‘লাস্ট সাপার’ তার সব থেকে প্রভাব বিস্তারকারী এবং বিখ্যাত চিত্রকর্ম। তার প্রতিটি চিত্রকর্মই ছিল বিষয়, ধরণ, রঙের খেলা আর বৈচিত্র্যে অনন্য। ছবির ভেতরেও তিনি লুকিয়ে গেছেন বিজ্ঞান, ধাঁধা আর অমিমাংসিত রহস্য।
‘মোনালিসা’-র বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ৮৩০ মিলিয়ন ডলার। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী চিত্রকর্ম। কেউ বলেন এটা তার সেল্ফ পোট্রের্ট; আবার কারো মতে, এটি ফ্লোরেন্টাইন ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকোন্দার স্ত্রীর।
‘লাস্ট সাপার’ মূলত ফ্রেসকো ক্যাটাগরির একটি কাজ। এতে তিনি যিশুর অভিব্যক্তিহীন মুখচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্য বেশ পরিশ্রম করেছেন।
এছাড়া, তার আরেকটি আইকনিক কাজ, ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান।’ যেখানে শিল্প আর বিজ্ঞানের অপূর্ব মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। মানবদেহের ‘স্বর্গীয় অনুপাত’-এর ধারণা দেয়া হয়েছে এই ছবিতে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ যেসব চিত্রকর্ম তিনি করেছেন, তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো, ‘ম্যাজাই’, ‘দ্য ম্যাডোনা অ্যাণ্ড চাইল্ড’, ‘ম্যাডোনা অব দ্য রকস’। এই কাজগুলোতে তার নিজস্ব শিল্প কৌশল, চিন্তাভাবনা ফুটে উঠেছে। তার সময়ে তার করা এই ধরনের চিত্রকর্ম ছিল একেবারেই আলাদা আর অনন্য।
তার মোটামুটিভাবে ১৫টি ছবি বিশ্ববিখ্যাত। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ের অনুপাত, ডিটেইলিং, রঙের ভ্যারিয়েশন মাথায় রেখে তিনি ছবি আঁকতেন। তিনি তার ছবিতে চমৎকার ইলিউশনও তৈরি করেছেন। ‘মোনালিসা’-র রহস্যময় হাসি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান
একজন প্রকৌশলী হিসেবে তার চিন্তাধারা এবং কাজের গতিপ্রকৃতিতে তিনি নিজ সময়কে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার, কামান, সৌরশক্তি, ক্যালকুলেটর, টেকটোনিক প্লেট প্রভৃতি ধারণার উদ্ভাবক ছিলেন লিওনার্দো। তার জীবদ্দশায় এসবের ভিতরে খুব কম প্রজেক্টই সাফল্যের মুখ দেখেছে। তবে পরবর্তীতে এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
শারীরবিদ্যা, স্থাপত্য প্রকৌশল, অপটিকস এবং হাইড্রোডায়নামিক্সেও তার অবদান অনস্বীকার্য। শিল্প এবং বিজ্ঞানকে তিনি এক প্রকার সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এত এত পড়াশোনা, গবেষণা, আঁকিবুকি, পেশাদার কাজ সবকিছু করে গেছেন অক্লান্তভাবে। যার জন্য তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘রেঁনেসা মানব’ হিসেবে।
এত শত কাজের ভীড়েও তাকে নিজস্ব পরিচয় দান করেছে তার শিল্পকর্ম। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে তার ঘটনাবহুল জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৫১৯ সালের ২ মে। মৃত্যুকালে তিনি ফ্রান্সে ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই। তারা যুগ, কাল, শতাব্দী পার করে ঠাঁই করে নেন সকল সময়ের মানুষদের অন্তরে। তাদের কীর্তি তাদের অমর করে রাখে। এদের হাত ধরেই যুগ যুগান্তরের নাটকীয় সব পরিবর্তন ঘটে। এত এত পরিবর্তনের ভীড়েও তাদের অবদান থাকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
Feature Image: shorturl.at/fpO08
References:
01. Leonardo da Vinci.
02. LEONARDO DI SER PIERO DA VINCI.
03. Leonardo da Vinci.