টমাস আলভা এডিসনের সেরা পাঁচটি আবিষ্কার

1500
0
টমাস আলভা এডিসন,Image source:linkedin.com

যদি প্রয়োজনীয়তা সকল উদ্ভাবনের জননী হয়, তাহলে টমাস আলভা এডিসন হবেন আধুনিক উদ্ভাবনের জনক। কারণ তিনি সর্বকালের অন্যতম সৃজনশীল উদ্ভাবক। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। কারণ তিনি তার উদ্ভাবনকে বিপণন করেছিলেন সঠিকভাবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন। 

এডিসনের ছিল উদ্ভাবনের প্রতি চরম আবেগ এবং একটি উদ্যোক্তা মনোভাব যার ফলশ্রুতি তার ১,০৯৩টি ছোট বড় পেটেন্ট। টমাস আলভা এডিসনের সেরা পাঁচটি আবিষ্কার ছিল বৈদ্যুতিক বাল্ব, ফোনোগ্রাফ, মোশন পিকচার ক্যামেরা, টেলিগ্রাফ এবং ইভিএম। যদিও এডিসন আরও অসংখ্য জিনিস আবিষ্কার করেছেন তবুও এই পাঁচটি আবিষ্কার তাকে অনেক খ্যাতি এনে দিয়েছে। 

Thomas Edison: Facts, House & Inventions - HISTORY - HISTORY
টমাস আলভা এডিসন। Image source: history.com

এডিসনের জীবনী

টমাস আলভা এডিসনের বাবা হলেন স্যামুয়েল এডিসন এবং মা ন্যান্সি এলিয়ট এডিসন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর মিলানে ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে এডিসন ছিলেন কনিষ্ঠতম। তার বাবা ১৮৫৪ সালে মিশিগানে চলে আসায় তিনি সেখানেই বেড়ে উঠেন। 

এডিসনের বাবা ছিলেন কানাডা থেকে বিতাড়িত রাজনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি কাঠের ব্যবসা করতেন আর তার মা ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি মিশিগানের একটি স্কুলে অল্প সময়ের জন্য ভর্তি হোন। ছোটবেলা থেকে টমাস একটু অসুস্থ ছিল আর পড়াশোনায় তেমন মনোযোগ ছিল না।  

ফলে স্কুলে শিক্ষকদের কাছে বকাঝকা খেতেন। তবে এসবের খারাপ প্রভাব যেন এডিসনের উপর না পড়ে সেজন্য তার মা তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন এবং বাড়িতে বসে পড়াশোনা করান। বাবার গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়েও পড়তেন। তার জীবনে মায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। 

Thomas Edison | Biography, Early Life, Inventions, & Facts | Britannica
ছোট টমাস আলভা এডিসন। Image source:Encyclopedia Britannica

টমাস এডিসন বারো বছর বয়সে তার শ্রবণশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন। শৈশবে হওয়া স্কারলেট জ্বরের ফলে এমনটি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে তিনি তার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারতেন। ছোট বয়স থেকেই তিনি যান্ত্রিক, রাসায়নিক জিনিসের প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং এগুলো নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন।  

টমাস এডিসন বারো বছর বয়সেই পোর্ট হুরন ও মিশিগানের ডেট্রয়েটের মধ্যে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেলরোডে ফল, চকলেট, বাদাম এবং সংবাদপত্র বিক্রি করতেন। এভাবে তিনি বেশ কিছু অর্থ জমিয়ে ১৮৬২ সালে পুরনো ও ছোট প্রিন্টিং প্রেস কেনেন যা ব্যবহার করে নিজেই সংবাদপত্র প্রকাশ করা শুরু করেন।  

সেই বছর তিনি একজন টেলিগ্রাফ অপারেটর হয়েছিলেন। তখন থেকেই তার বিভিন্ন আবিষ্কারের উদ্ভব ঘটে। পাশাপাশি তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। বিশেষ করে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের বিদ্যুৎ সম্পর্কিত লেখার প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। টমাস এডিসন তার বধিরতাকে প্রতিবন্ধকতা না ভেবে বরং আশীর্বাদ ভাবতেন। কেননা এতে করে তিনি যেকোন কাজে একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করতে পারতেন। 

এডিসনের সেরা পাঁচটি আবিষ্কার 

টমাস আলভা এডিসন তার জীবনে অসংখ্য জিনিস আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মধ্যে কোনটি মানব সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এডিসনের এমনই সেরা পাঁচটি আবিষ্কার হলো ফোনোগ্রাফ, ইভিএম, স্টক টিকার প্রিন্টার, বৈদ্যুতিক বাতি, মেশিন পিকচার ক্যামেরা। 

১. ফোনোগ্রাফ  

টমাস এডিসনের ক্যারিয়ারের বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল ফোনোগ্রাফ।যা দিয়ে একজন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে তা আবার শোনা যাবে। টেলিগ্রাফ ট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা উন্নয়নে কাজ করার সময় তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে মেশিনের টেপ একটি শব্দ সৃষ্টি করে যা অত্যন্ত জোরে উচ্চারিত শব্দের মতো শোনা যায়। এই ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল যে সে একটি টেলিফোন বার্তা রেকর্ড করতে পারে কিনা! 

এডিসনের ফোনোগ্রাফ,Image source:theatlantic.com

ফোনোগ্রাফ শব্দটি ছিল এডিসনের যন্ত্রের বাণিজ্যিক নাম, যেটি ডিস্কের পরিবর্তে সিলিন্ডার বাজাতো। এই মেশিনটিতে দুটি সূঁচ ছিল: একটি রেকর্ডিংয়ের জন্য এবং একটি প্লেব্যাকের জন্য। আপনি যখন রিসিভারে কথা বলবেন, তখন আপনার কণ্ঠের শব্দ কম্পন রেকর্ডিং সূঁচ দ্বারা সিলিন্ডারে ছিদ্র করবে বা ঘর্ষণজনিত শব্দ সৃষ্টি করবে। 

এজন্য তিনি একটি টেলিফোন রিসিভারের ডায়াফ্রামের সাথে একটি সূঁচ সংযুক্ত করে পরীক্ষা শুরু করেন এই যুক্তির ভিত্তিতে যে সূঁচটি একটি বার্তা রেকর্ড করার জন্য কাগজের টেপকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে। ফোনোগ্রাফে প্রথম রেকর্ডিং পরীক্ষা করার সময় এডিসন নার্সারি রাইম ‘মেরি হ্যাড অ্যা লিটল ল্যাম্ব’ সুর দিয়ে রেকর্ড করেছিলেন। আর এই প্লেব্যাক শুনে এডিসন এবং তার কর্মীরা অত্যন্ত হতবাক ও আনন্দিত হয়েছিল। 

২. বৈদ্যুতিক বাতি 

টমাস এডিসনের সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হলো বৈদ্যুতিক বাল্ব বা বাতি। যদিও এটি তার মৌলিক আবিষ্কার নয়, বরং বাল্বের উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। ইনক্যাডেসেন্ট লাইট বা কৃত্রিম স্বচ্ছ আলোর বাল্বটি ১৮৭৯ সালে পেটেন্ট করা হয়েছিল।  

lightbulb
এডিসনের বৈদ্যুতিক বাল্বের রেপ্লিকা। Image source:science.howstuffworks.com

এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন যে বাতিগুলো জ্বালানো অনেক খরচ সাপেক্ষ। তিনি বাল্বের উন্নয়নে কাজে নেমে পড়েন। কার্বন ফিলামেন্ট ব্যবহার করে স্বল্প ভোল্টেজে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করেন। 

এই গরম ফিলামেন্টটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসে পূর্ণ একটি কাচের বাল্ব দ্বারা বায়ু থেকে সুরক্ষিত ছিল। ফিলামেন্টটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ দ্বারা উত্তপ্ত হলে আলো দেয়। ধীরে ধীরে তিনি একটি নির্ভরযোগ্য, দীর্ঘস্থায়ী আলোর বাল্ব তৈরি করতে সক্ষম হোন।

৩. বৈদ্যুতিক ভোট রেকর্ডার বা ইভিএম 

এডিসন ১৮৬৯ সালে ইলেক্ট্রোগ্রাফিক ভোট রেকর্ডারের জন্য একটি পেটেন্ট তৈরি করেছিলেন। তার এই মেশিনটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল আইনসভা সংস্থাগুলিকে তাৎক্ষণিক এবং সঠিকভাবে ভোট রেকর্ড করতে সাহায্য করার জন্য। কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্রে ধীরগতির রোল কল ভোটিং চালু ছিল। 

এডিসনের সিস্টেমে মেশিনটি একটি সাধারণ সুইচ এবং বৈদ্যুতিক প্রবাহের সাহায্যে ব্যালট রেকর্ড করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। প্রতিটি বিধায়ক একটি সুইচকে ‘YES’ বা ‘NO’ অবস্থানে নিয়ে যাবে। একজন অপারেটর মেশিনটিতে বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাঠাবেন। ভোটদান শেষ হওয়ার পর, অপারেটর ধাতব ধরণের উপরে রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত কাগজের একটি শীট টাইপের কলামের উপর রাখবে এবং এটির উপর একটি ধাতব রোলার চালাবে।   

Thomas Edison's electrographic voting-recorder
এডিসনের ইভিএম পেটেন্ট। Image source:techtimes.com

বৈদ্যুতিক প্রবাহের কারণে কাগজের রাসায়নিকগুলি সেই পাশে দ্রবীভূত হবে যার জন্য ভোট রেকর্ডিং হবে। তারপর মেশিনের উভয় পাশের ডায়ালগুলি ভোটের ‘YES’ বা ‘NO’ এর মোট সংখ্যা রেকর্ড করে মোট ভোটের ফলাফলগুলি সারণি আকারে প্রকাশ করবে।   

তবে ইভিএম মেশিন আবিষ্কার তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। এছাড়া মার্কিন রাজনীতিবিদরাও চান নি ভোট দেওয়া সহজ ও তাড়াতাড়ি হোক। তাই দূর্ভাগ্যবশত যন্ত্রটি আর বাস্তবে তৈরি হয়নি।

৪. কিনটোগ্রাফ/মোশন পিকচার ক্যামেরা 

১৮৮৮ সালের দিকে এডিসন তার ল্যাবে একটি প্রযুক্তির উন্নয়নের তত্ত্বাবধান করেন। এই প্রযুক্তিটি চোখের জন্য তাই করে যা ফোনোগ্রাফ কানের জন্য করে। এডিসন একটি মোশন-পিকচার ক্যামেরা উদ্ভাবনের চিন্তা করেন। এজন্য তার একজন তরুণ ল্যাবসহকারী উইলিয়াম কেনেডি-লরি ডিকসনকে নির্দেশ দেন।  

তারা যে যন্ত্রটি বানান তা দিয়ে মূলত লাইট বাল্ব, লেন্স,শাটার ও ফিল্ম স্ট্রিপের মধ্যে সিঙ্ক্রোনাইজেশনের মাধ্যমে ছবি তোলা হত।যার নাম হয়েছিল কিনটোগ্রাফ। 

Kinetograph
এডিসনের ক্যামেরা। Image source:beachamjournal.com

কিনটোগ্রাফের প্রাথমিক পরীক্ষাগুলি এডিসনের ফোনোগ্রাফ সিলিন্ডারের ধারণার উপর ভিত্তি করে ছিল। আর ডিকসন মোশন-পিকচার ক্যামেরায় রেকর্ডিং এবং দেখার প্রযুক্তি দুটির চূড়ান্ত প্রয়োজনীয়তাকে একত্রিত করেছিলেন। কিনটোগ্রাফে ক্ষুদ্র ফটোগ্রাফিক চিত্রগুলি একটি সিলিন্ডারের সাথে ক্রমানুসারে সংযুক্ত করা হয়েছিল, এই ধারণায় যে সিলিন্ডারটি ঘোরানো হলে গতির বিভ্রম প্রতিফলিত আলোর মাধ্যমে পুনরুৎপাদিত হবে।  

এডিসনের ক্যামেরা আবিষ্কারের পর চলচ্চিত্র একটি বড় শিল্পে পরিণত হয়েছিল। কারণ ক্যামেরার সাথে সাথে লুমিয়ের সিনেমাটোগ্রাফ, প্রিন্টার এবং প্রজেক্টরের উদ্ভাবন করা হয়। এভাবে এডিসন সামঞ্জস্য করেন এবং তার কোম্পানি একটি সমৃদ্ধশীল মুভি স্টুডিওতে পরিণত হয়। 

৫. স্টক টিকার প্রিন্টার 

টমাস আলভা এডিসনের আরেকটি চমৎকার আবিষ্কার ছিল শেয়ার মার্কেটের স্টক টিকার প্রিন্টার। তবে এই যন্ত্র এডিসনের আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। এডিসন স্টক টিকার প্রিন্টারের পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তার এই কাজের জন্য শেয়ার মার্কেটের দর উঠা-নামার হিসেব দেখা সহজ হয়ে যায়।   

Stock Ticker | National Museum of American History
এডিসনের স্টক টিকার প্রিন্টার। Image source:americanhistory.si.edu

প্রিন্টারে একসাথে অনেকগুলো শেয়ারের দর দেখানো যেত। তার আবিষ্কৃত ও পরিবর্ধিত এই স্টক টিকার প্রিন্টার ১৮৭১ সালের দিকে ৪০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছিল। 

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. Father Modern Innovation Edisons Top 5 Inventions. 
02. Edison's Innovation. 
03. Kinetoscope.