প্রথমেই ইউএস নেভির সবচেয়ে বড় ফুয়েল শিপ ইউএসএস সাইক্লপ্স গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ইউএস নেভির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল এই ইউএসএস সাইক্লপ্স যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়।
১৯১৮ সালের মার্চে ৩০৯ ক্রু মেম্বার এবং ১০৮০০ টন ম্যাঙ্গানিজ ওরে নিয়ে ব্রাজিল থেকে বাল্টিমোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এজন্য জাহাজটিকে বারমুডা অঞ্চল পার হতে হয়েছিল, এবং পৌঁছে গিয়েছিল। এছাড়াও জাহাজ থেকে নেগেটিভ ম্যাসেজ দেয়নি এবং তাই ধরে নেওয়া হয় যে যাত্রাপথে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই জাহাজটির সন্ধান আর কখনও পাওয়া যায়নি। মার্চের ৪ তারিখে সর্বশেষ এই জাহজটি ভাসমান অবস্থায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৪১ সালেও ইউএসএস প্রোটিয়াস ও ইউএসএস নিরিয়াস একইভাবে নেই হয়ে যায়। এরকম অসংখ্য অমিমাংসিত ঘটনা রয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ঘিরে। সেসব রহস্য নিয়েই আজকের এই লেখা।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আবিস্কারের ইতিহাস ও নামকরণ
১৯৬৪ সালে ভিনসেন্ট এইচ গ্যাডিস বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামকরণ করেন। তিনি উত্তর আটলান্টিক সাগরের এক নামহীন জায়গায় অদ্ভুত সব হারিয়ে যাবার ঘটনা থেকে এ জায়গার নাম দেন বারমুডা ত্রিভুজ।
জায়গাটার ক্ষেত্রফল লেখকভেদে প্রায় ১,৩০০,৩০০ থেকে ৩,৯০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। তবে এর আগে ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর “দ্য মায়ামি হেরাল্ড” পত্রিকায় এ অঞ্চলে জাহাজের উধাও হওয়া নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল।
এছাড়াও আরও অনেক আগেই ঠিক পঞ্চদশ শতকে যখন ক্রিস্টোফার কলম্বাস ইউরোপ থেকে আমেরিকা যান, তখন তার জার্নালে এ ব্যাপারে লিখেছিলেন।
বর্তমান ফ্লোরিডা ও পুয়ের্তো রিকোর এ এলাকা যখন পার হচ্ছিলেন, তখন তার কম্পাসের কাটা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। সেখানে তিনি নাকি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল “ডেভিলস ট্রায়াঙ্গল” হিসেবেও পরিচিত।
ভৌগলিক অবস্থান
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার অঞ্চল যা ফ্লোরিডা, বারমুডা আইল্যান্ড এবং পুয়ের্তো রিকো মধ্যে অবস্থিত। এটি কোন ওয়ার্ল্ড ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কারন ইউএস বোর্ড অব জিওগ্রাফিক নেমস একে আটলান্টিক মহাসাগরের অফিশিয়াল অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও এই স্থানটি নাম প্রথমবার একটি পাল্প ম্যাগাজিনে উল্লেখ করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে, “ এটি এমন একটি স্থান যেখানে কোন ধ্বংসাবশেষ না রেখেই হাজারো জাহাজ ও প্লেন গায়েব করে দিয়েছে।”
- একটি মজার তথ্য হচ্ছে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের যতটা না কুখ্যাতি রয়েছে সে তুলনায় আটলান্টিক মহাসাগরের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে খুব কমই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
- ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ) এর ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বারমুডা ট্রায়াঙ্গল শিপিং এর জন্য বিপদজক অঞ্চল হিসেবে কুখ্যাত ১০টি স্থানের মাঝে জায়গা পায়নি।
- পৃথিবীর অনেকগুলো ব্যস্ত শিপিং লেনের মধ্যে এটি একটি অন্যতম অঞ্চল।
- বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একটি সময়কালে অ্যাগনিক রেখা কখনও কখনও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অ্যাগোনিক লাইন হল পৃথিবীর পৃষ্ঠের একটি জায়গা যেখানে সত্যিকারের উত্তর এবং চৌম্বকীয় উত্তর সারিবদ্ধ, এবং কম্পাসে চৌম্বকীয় পতনের জন্য হিসাব করার প্রয়োজন নেই।
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ঘন ঘন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় এবং হারিকেন হয়।
- উপসাগরীয় প্রবাহ – একটি শক্তিশালী সমুদ্র স্রোত যা স্থানীয় আবহাওয়ার তীব্র পরিবর্তন ঘটায় – বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মধ্য দিয়ে যায়। যা ইংরেজিতে “The Gulf Stream” হিসেবে পরিচিত।
- আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতম বিন্দু, মিলওয়াকি ডেপথ বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অবস্থিত। পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চ মিলওয়াকি ডেপথে ২৭,৪৯৩ ফুট (৮,৩৮০ মিটার) গভীরতায় পৌঁছেছে।
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নিখোঁজ হওয়া জাহাজ ও বিমানের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।তবে অনুমান করা হয় প্রায় ৫০টি জাহাজ এবং ২০টি বিমান গায়েব হয়েছে এখানে।
- এই অঞ্চলে নিখোঁজ হওয়া অনেক জাহাজ ও বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা যায়নি।
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে এভাবে রহস্যজনকভাবে বিমান এবং জাহাজের অন্তর্ধান মানুষের ভুল বা আবহাওয়ার ফলে হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে এখানে হয়তো কোন সুরঙ্গ আছে কিংবা এখানে আছে বিরাট কোনো চুম্বক যা জাহাজ এবং প্লেনকে আকর্ষিত করে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ঘটে যাওয়া আরও কিছু সাড়া জাগানো ঘটনা
আর্টিকেলের শুরুতে ইউএসএস সাইক্লপ্সের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছিল। তবে এটি ছাড়াও আরও কিছু গায়েব হয়ে যাওয়া জাহাজ এবং প্লেনের সাড়া জাগানো ঘটনা রয়েছে।
প্রথমেই মারি সেলেস্ত নামক মালবাহী জাহাজের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি দিয়ে শুরু করা যাক। ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর মালবাহী জাহাজটি নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু যেখানে মালামাল নিয়ে পৌঁছানোর কথা ছিল, সেখানে আর কখনওই পৌঁছায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জাহাজটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকায় ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেল। জাহাজটিতে ১১ জন কর্মী থাকার কথা ছিল কিন্তু কেউই ছিল না জাহাজে। ব্যক্তিগত এবং দামি মালামাল, খাবারদাবার, লাইফবোট সবই অক্ষত পাওয়া গেলেও শুধু মানুষগুলো উধাও। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, প্লেটে খাবার ছিল এবং সেগুলোতে পচন ধরে গিয়েছিল যখন উদ্ধারকারীরা পৌঁছায়। কী এমন হয়েছিল যে খাবার শেষ না করেই খাওয়ার মাঝ থেকে উঠে যেতে হয়েছিল?
উইচক্র্যাফটের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বরের ঘটনা। মায়ামি থেকে বিলাসবহুল ২৩ ফুট ইয়ট উইচক্র্যাফট নামের কেবিন ক্রুজারে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দুই বন্ধু, ক্যাপ্টেন ড্যান বুর্যাক আর তার বন্ধুবর ফাদার প্যাট্রিক হরগ্যান। কিছুদিন পরেই বড়দিন। আর বড়দিনের উৎসবের আলোয় দূর থেকে মায়ামিকে পরখ করে দেখার আনন্দই যেন অন্যরকম এক অনুভূতি এনে দেয়। তবে তীর থেকে সবে এক মাইল দূরে পৌঁছাতেই কোস্ট গার্ড কল পেলেন যে, জাহাজটি কোনোকিছুর সাথে বাড়ি খেয়েছে, তবে বড় ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বিপদ এখানেই যেন ওঁত পেতে ছিল।
কোস্ট গার্ড কল পাওয়ার সাথে সাথেই রওনা দিয়েছিল। ১৯ মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, কিছুই নেই। কোনো চিহ্নই নেই জাহাজের। এ জাহাজটির ডুবে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না, কিন্তু ডুবে যাওয়া তো পরের কথা, জাহাজটি যে কখনো এসেছিল এখানে, তারই কোনো হদিস পাওয়া গেল না। সে জায়গাটি কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কিনারায় অবস্থিত ছিল। তাই ধারণা করা হয় গায়েব হওয়ার পেছনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলই দায়ী।
আরও একটি রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল ১৮৮১ সালে। এলেন অস্টিন নামের একটি জাহাজ একদিন সমুদ্রে একটি পরিত্যক্ত ভাসমান জাহাজ দেখতে পায়। জাহাজের ক্রুরা পরিত্যক্ত জাহাজের জিনিসপাতি নিজেদের জাহাজে নিয়ে নেবে ঠিক করলো। যেই ভাবা সেই কাজ। কয়েকজন নেমে পড়লো জাহাজটিতে। তারা আরও ভেবেছিল যে সেই জাহাজটিকে চালিয়ে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাবে। দুটো জাহাজ রওনা হলো একসাথেই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধেই এলেন অস্টিন নামহীন জাহাজটির খেই হারিয়ে ফেলল।
জাহাজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পুনরায় খুঁজে পাওয়া গেলেও, তাদের নিজেদের ক্রুরাও উধাও! তখন এলেন অস্টিন থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠাতে বার্তা পাঠানো হলো। যখন উদ্ধারকারী জাহাজ এসে পৌঁছালো, সে জায়গা অর্থাৎ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে এলেন অস্টিন ও নামহীন জাহাজ দুটোই উধাও। কোনোদিন তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কথিত আছে, অনেক জাহাজ নাকি এ দুটো জাহাজকে একসাথে সমুদ্রে ঘুরতে দেখেছে, তারা অন্য জাহাজদের পথভ্রষ্ট করতে চেষ্টাও করে যেতো।
এতক্ষণ জাহাজ গায়েবের কিছু ঘটনা আলোচনা করা হলেও এবার আসা যাক প্লেনের কথায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো ফ্লাইট নাইনটিন বিমানের গায়েব হওয়া। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে মার্কিন নেভির পাঁচ সেরা অ্যাভেঞ্জার বম্বার একটি রুটিন মিশনে বের হয়। লেফটেন্যান্ট চার্লস টেইলর নিয়মিত কথা বলছিলেন রেডিওতে বেজের সাথে। হঠাৎ করেই অর্ধেকেই কথা বন্ধ হয়ে যায়।
এমন না যে, ঝিরঝিরে বা অস্পষ্ট, একদম নেই হয়ে গেল। আর কোনোদিন সেই পাঁচ বিমানের দেখা মেলেনি। সেগুলোকে উদ্ধার করতে পাঠানো বিমানগুলোও ফেরেনি কোনোদিন। আর জায়গাটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। তদন্তে লেখা হয়েছিল ‘অজ্ঞাত কারণে’ তারা উধাও। বিমান প্রযুক্তি এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধার পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নতি আনার ফলে ২০১৪ সালে নিখোঁজ হওয়া মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের MH370 ফ্লাইটের সামান্য পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।
এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা এই কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ঘটেছে যা বলে শেষ করা যাবেনা। আজ অবধি এর রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে কিনা সেটাও অজানা। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চেষ্টা করেছে এ রহস্যের সমাধানের। ২০১৬ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত তাদের আর্টিকেল অনুযায়ী, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ৭৫টির মতো বিমান আর প্রায় ৩০০ টির মতো জাহাজ হারিয়ে গেছে ।
এছাড়াও আরও কিছু ব্যাখা রয়েছে তবে সেগুলো সন্তোষজনক নয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আদতে কোনো রহস্য যদি নাও থাকে তবুও এটি এখনও জনমনে একটি রহস্যের খোরাকই বটে! একজন পাঠক হিসেবে আপনার মতামত কি? এটি কি আসলেই রহস্যে নাকি সবকিছুই অতিরঞ্জন?
Feature Photo: iStock
Source