‘বেগমপাড়া’ গালভরা এই নাম শুনলেই মন ও মস্তিষ্ক যেন গড়ে তোলে কোনো রাজা বাদশাহ আর তাদের বেগমদের জন্য গড়া বিলাসবহুল আবাসস্থল। পৃথিবী নামক গ্রহে, কানাডার টরেন্টোতে আছে তেমনই এক যায়গা। যেখানে ধন-সম্পদ, প্রাচুর্যের কোনো কমতি নেই, কমতি নেই সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের। যুগে যুগে এমনই তো হয়ে আসছে, এমনভাবেই নশ্বর পৃথিবীর মাটির বুকে এক টুকরো স্বর্গ তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের প্রশান্তির জন্য ক্ষমতাধর এই মানবজাতি যেকোনো মূল্যে।
রাজা-বাদশা, সুলতানা-বেগম আর তাদের সাম্রাজ্য নিয়ে বইয়ের পাতায় থাকা নানা সব কাহিনীর বাস্তাব চিত্র বর্তমান যুগে না দেখতে পাওয়া গেলেও, রূপ বদলে সে সকল ব্যক্তিরাই যেন নানা অবয়বে বসত করছে বর্তমানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত জুড়ে। তেমনই একটা যায়গা এই বেগমপাড়া।
রাজা না, বাদশা না, নেই রাজবংশের রক্ত শরীরে। তবুও জীবনকে তারা যাপন করছে রাজার হালে। তবে প্রশ্ন একটাই রাজকীয় এই জীবনের, বিলাসিতার চরম পর্যায়ে গা এলিয়ে এভাবে জীবন যাপন করাতে পারার পেছনের মূলে যে সম্পদের প্রয়োজন তার উৎস কি? রক্ত পানি করা শ্রমের বিপরীতে যেখানে একটি জীবন চলে, ঠিক কোন সেই জিনিস যা কিনা জীবনে-জীবনে এত ব্যবধান গড়ে দিলো?
বেগমপাড়া নামটি যেভাবে হলো
বেগমপাড়া নামটি এসেছে মূলত বেগমপুরা থেকে। বেগমপুরা হচ্ছে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের নাম যেটি তৈরি করেন রশ্মি লাম্বা নামক একজন ভারতীয় পরিচালক। ডকুমেন্টারি তৈরি হয় টরেন্টোর পাশে থাকা অন্য একটি শহর মিসিসাগায় অবস্থানরত দক্ষিন এশীয় অধিবাসীদের নিয়ে। শ্রম এবং মেধা পাচার হয় সবচেয়ে বেশি দক্ষিন এশীয় দেশগুলো থেকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন এমন নজির বহু আছে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে। বেশ কিছুটা স্বাবলম্বী হওয়ার পর সকলেই চেষ্টা করেন তাদের পরিবারকে সুখী, উন্নত এবং নিরাপদ একটি জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। আর তাদের এই উন্নত জীবন যাপনের জন্য পছন্দের যায়গা হিসেবে বেছে নেন কানাডাকে।
টরেন্টো বা এর আশপাশে নিজেদের পরিবারকে রেখে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চলে যান নিজ নিজ কর্মস্থলে। মূলত পরিবারের নারী সদস্য বা স্ত্রীরাই পরিচালনা করেন এই পরিবার৷ এসকল নারী সদস্যদের নিজ পরিবারকে একা আগলে রাখার যে সংগ্রাম সেটিই উঠে এসেছে বেগমপুরা ডকুমেন্টারিতে। পরবর্তীতে এই বেগমপুরা থেকেই স্থানীয়দের মাঝে টরেন্টোর বিশেষ স্থানটি বেগমপাড়া নামে ডাকা শুরু হতে থাকে৷
বেগমপাড়ার অবস্থান কোথায়?
খাতা-কলমে বেগমপাড়ার কোনো অস্তিত্ব কিন্তু নেই৷ অর্থাৎ কেউ যদি কানাডায় অথবা টরেন্টোতে বেগমপাড়া নামে কোনো জায়গা বা এলাকা খুঁজে পেতে চান তিনি কিন্তু তা পাবেন না৷ বিশেষ এই নামটি শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে দুর্নীতিবাজদের তথাকথিত দ্বিতীয় নিবাস হিসেবে গড়ে তোলা বিশেষ এলাকাকে।
কারা থাকে তথাকথিত এই বেগমপাড়ায়?
কানাডার টরেন্টোর বর্তমানে পরিচিত বেগমপাড়া আর ডকুমেন্টারির বেগমপুরার বেগমদের মধ্যে পার্থক্য অনেক। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের কোনো এক সদস্যের বাইরে থাকা এবং অন্যদের নিয়ে নারী সদস্যদের যেই ক্লেশ আর যাতনার চিত্র সকলে দেখেছিল তার রেশ মাত্র নেই বর্তমানে পরিচিত বেগমপাড়ার বেগমদের মাঝে। দুর্নীতিগ্রস্থ নেতা, ব্যবসার আর আমলাদের বেহিসেবী অসাধু উপায়ে অর্জিত টাকার পাহাড়ের এক একটি স্তুপ যেন বেগমপাড়ায় অবস্থিত এক একটি বাড়ি।
দেশের এবং জনগনের কোটি কোটি টাকা বিশেষ কূট প্রক্রিয়ায় আত্মসাৎ করে সেসব পাচার করে গড়ে তোলা হয় বেগমপাড়ার এক একটি বাড়ি। সাহেবদের পাচার করে আনা ‘কালো’ টাকায় নিজের এবং পরিবারের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে ব্যস্ত যেন বেগমপাড়ার বেগমরা।
কানাডার স্থানীয় অধিবাসীরা যারা আশেপাশেই থাকেন তাদের ভাষ্যমতে, এসকল বাড়ির সাহেবরা কি করে অর্থ উপার্জন করেন, এত সম্পদের উৎস কি? তারা এসবের কিছুই জানেন না। কারণ তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ তারা এদের করতে দেখেন না।
বেগমপাড়ার বেগমদের বা সাহেবদের সম্পদের উৎস কি?
আট থেকে দশ হাজার স্কয়ার ফিটের কোটি টাকার আলিশান এক একটি বাড়ি, সাথে আছে কোটি টাকার গাড়িও। বেগমরা যাপন করছে বিলাসিতায় ভরপুর স্বপ্নের জগতে, ছেলে-মেয়ারা শিক্ষাগ্রহণ করছে সব থেকে নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একসাথে সবকিছু সমান তালে এত সুন্দরভাবে চলতে থাকার পেছনের কারণটা কিন্তু মোটেও সুন্দর নয়! যাপিত জীবনে ব্যয় করা এসব অর্থের নেই কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব।
সাহেবেরা কেউ বা ব্যবসায়ী, কেউ বা সরকারি আমলা আর কেউ কেউ বহুমুখী পেশায় জড়িত। তবে তাদের এই পেশার মাধ্যমে সৎ উপায়ে এমন ব্যয়বহুল জীবন-যাপন কল্পনাতীত। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও পাচার করা দুর্নীতি আর লুটের টাকাই যে এসকল চাহিদা যোগায় তা সবার জানা।
এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যাটাই বা কত?
বর্তমানে ১,০০,০০০ (এক লাখ) এর মতোন বাংলাদেশী স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন কানাডায়। সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে টরেন্টো থাকলেও আশেপাশের শহরগুলোতেও তাদের আনাগোনা কম না। পূর্বে বসবাসকারীদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ হলেও বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত বিভিন্ন পেশাজীবির মানুষ এবং সরকারি আমলারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বেছে নিচ্ছেন।
আর বর্তমানের এসকল সচেতন বাংলাদেশিদের মধ্যে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে আনা এসব অর্থ কেলেংকারীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে দেখা যায়। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সাহায্য করে।
টরন্টোর বেলভিউ এলাকার কন্ডোমিনিয়াম অথবা প্রাণকেন্দ্র সিএন টাওয়ারের পাশের বিলাসবহুল কন্ডোমিনিয়াম সব স্থানেই বাংলাদেশীদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই ফ্লাট কিনে বসবাস করেন আবার অনেকেই শুধুমাত্র কিনে রাখেন, বসবাস করেন না। আর দিন দিন এই সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান বলা চলে৷
বাংলাদেশ এবং কানাডা সরকারের অবস্থান কেমন বেগমপাড়াকে ঘিরে?
কানাডার আইন-কানুন দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে বেশ কড়া। অবৈধভাবে পাচার করা অর্থ বা লেনদেন নিয়ে কাজ করে ফিনান্সিয়াল ট্রান্সেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার অব কানাডা বা ‘ফিনট্রাক’। আবার অন্যদিকে, কানাডার নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান এবং এর গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারেও বেশ সচেতন।
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন অবৈধভাবে পাচার করা এসব অর্থের পরিমাণ নির্ণয় করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে বেশ কিছুবার অভিবাসি ধনী ব্যক্তিদের তালিকা এবং তাদের সম্পদের পরিমান জানতে চাইলেও, নিরাপত্তার খাতিরে কানাডা সরকার তা প্রকাশ করেননি।
আর এদিকে তালিকা ছাড়া সন্দেহের বশে কাউকে অভিযোগ করাও অসম্ভব। তবুও বাংলাদেশ সরকার দেশের বাইরে থাকা এই বিপুল পরিমান অর্থকে দেশে আনতে যেমন কালো টাকা সাদা করতে পারার মতোন বিল পাস করেছেন সংসদে, তেমনই দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দিয়েছেন অনেক সুযোগ-সুবিধা।
Feature Image: References: 01. Canadas-begum-para-is-a-reversal-delusion-for-Bangladesh. 02. Begum-para-Canada-mostly-govt-officials-bought-houses. 03. Begum Para. 04. Begum Para.