বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদ সম্পর্কে আমরা খুব কম মানুষ জানি। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন হ্রদ হলো বৈকাল হ্রদ। শুধু প্রাচীনই নয় বরং, গভীরতম সুপেয় পানির হ্রদ হিসেবেও পরিচিত এই বৈকাল হ্রদ। আয়তনের দিক থেকেও এটি বৃহত্তম। এই হ্রদ রাশিয়ার সাইবেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত। প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি এই বৈকাল হ্রদকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয় ইউনেসকো। চলুন জেনে নেয়া যাক বৈকাল হ্রদ সম্পর্কে বিস্তারিত।
ইতিহাস
কমপক্ষে ২৫ মিলিয়ন বছর পুরানো, বৈকাল হ্রদ বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদ। এটি এবং আশেপাশের পর্বতগুলো ভূত্বক ভেঙ্গে গঠিত হয়েছিল। ধারণা করা হয় সম্ভবত এটি একটি নদীর তল ছিল। কিন্তু পৃথিবীর ভূত্বকের কম্পন এবং ফাটলের ফলে আকার বৃদ্ধি পেয়ে তীরের মধ্যবর্তী স্থানকে প্রশস্ত করেছে। বৈকাল অববাহিকার অংশগুলি টারশিয়ারি পিরিয়ড (৬৬ মিলিয়ন থেকে ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে) জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিকশিত হয়েছিল। এছাড়াও হিমবাহ গলে যাওয়ায় পানির স্তরও বেড়েছে।
গ্রেট লেকের মতো হ্রদের একটি সিরিজ প্রথমে বিকশিত হয়েছিল এবং তারপরে প্লায়োসিন যুগে তা একত্রিত হয়েছিল। একীকরণের কারন কী হতে পারে সেই সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পৃথিবী ডুবে যাওয়া, পতিত পাথর, ক্ষয় এবং ভূমিকম্প। সম্ভবত, এটি সমস্ত কারনের সংমিশ্রণ ছিল।
বৈকাল হ্রদ সম্পর্কে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, এখানে প্রতি বছর ২০০০ মিটার পর্যন্ত ভূমিকম্পের কম্পন সনাক্ত করা হয়। যা হ্রদকে আরও গভীর করে এবং আকার বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৬২ সালের ভূমিকম্পের ফলে প্রোভাল বে তৈরি হয়েছিল। বৈকাল কেন্দ্রের মতে, কিছু ভূ-পদার্থবিদ মনে করেন যে বৈকাল হ্রদ একটি মহাসাগরের জন্ম। উপকূলগুলি বছরে ২ সেমি দূরে সরে যায়, একই সাথে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা হয়ে যায়।
আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে বৈকাল হ্রদের চারপাশে বাস করে। হান-জিয়ংগু যুদ্ধের (১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮৯ খ্রিস্টাব্দ) স্থান ছিল এই হ্রদ। স্থানীয়দের মতে, যিশু বৈকাল হ্রদ পরিদর্শন করেছিলেন। তবে বৈকাল হ্রদ পরিদর্শনকারী প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তি ছিলেন রাশিয়ান কুরবাত ইভানভ। ১৬৪৩ সালে বৈকাল হ্রদ ঘুরতে আসেন। ১৭ শতকের সাইবেরিয়া জয়ের সময় রাশিয়া বৈকাল হ্রদকে অন্তর্ভুক্ত করে তার অঞ্চল প্রসারিত করে।
বৈকাল হৃদ সম্পর্কে কিছু তথ্য
বৈকাল হ্রদের আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম সুপেয় পানির হ্রদ। আয়তনে প্রায় ১২ হাজার ২০০ বর্গ মাইল (৩১ হাজার ৫০০ বর্গ কিমি), দৈর্ঘ্য ৩৯৫ মাইল (৬৩৬ কিমি) এবং গড় প্রস্থ ৩০ মাইল (৪৮ কিমি), যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ সুপেয় পানি অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কিউবিক মাইল (২৩ হাজার কিউবিক কিমি) ধারণ করে৷ এই হ্রদে ৩৩৬টি নদীর স্রোত প্রবাহিত হয়, যার মধ্যে সেলেঙ্গা, বারগুজিন, আপার (ভারখনিয়া) আঙ্গারা, চিকয় এবং উদা অন্তর্ভুক্ত।
সিএনএন ট্রাভেলার অনুসারে বৈকাল হ্রদকে বিশ্বের অন্যতম পরিষ্কার হ্রদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বৈকাল হ্রদ সাইবেরিয়ার অন্যান্য অংশের তুলনায় উষ্ণ হতে পারে, তবে শীতকালে এখনও খুব ঠান্ডা হয়ে যায়। এখানে শীতকালে বাতাসের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৬ ফারেনহাইট (মাইনাস ২১ সে.)। শীতকালে বরফে পরিণত হয় এবং সাধারণত মে বা জুন মাসে গলে যায়। বরফ ৬ ফুট (২ মিটার) পর্যন্ত পুরু হতে পারে।
মজার ব্যপার হলো, বরফের স্তরটি খুবই স্বচ্ছ। যার কারনে নিচের সবকিছুই উপর থেকে খুব পরিস্কারভাবে দেখা যায়। গ্রীষ্মে, গড় বায়ু তাপমাত্রা ৫২ ফারেনহাইট (১১ সে.) হয়। আগস্টে এই তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ফারেনহাইট (১০ সে.)। হ্রদের গভীরে খেলা করা মাছ, সবুজ পাথর, হ্রদের নিচে জন্মানো জলজ গাছগাছড়া – এর সবই আপনি খালিচোখে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাবেন। এই লেকের জল এতই স্বচ্ছ যে লেকের নিচে ৪০ মিটার পর্যন্ত দৃষ্টি অনায়াসে চলে যাবে।
বৈকাল হ্রদে প্রায় ৪৫টি দ্বীপ রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুটি দ্বীপ হলো ওলখোন এবং গ্রেট উশকানি। ওলখানের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭০ বর্গ মাইল (৭০০ বর্গ কিলোমিটার), এবং গ্রেট উশকানি, যা প্রায় ৩.৬ বর্গ মাইল (৯.৪ বর্গ কিলোমিটার) জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে।ওলখোন হল বন এবং তৃণভূমিতে ভরপুর একটি অঞ্চল যেখানে হরিণ, বাদামী ভালুক এবং বিভিন্ন পাখি বসবাস করে। সেখানে প্রায় ১৫০০ লোক বাস করে। গ্রেট উশকানি পাথুরে অঞ্চল। এখানে অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় পাথুরে স্থান বেশি দেখা যায়।
বৈকাল হ্রদে ২৭টি জনবসতিহীন দ্বীপ রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৬০ কিউবিক কিমি (১৫.৮ ট্রিলিয়ন গ্যালন) পানি ইয়েনিসেই নদী বহন করে। বাকি পানি আর্কটিক মহাসাগরে চলে যায়। সেলেঙ্গা নদী বৈকাল হ্রদে আসা পানির বৃহত্তম উত্স। মঙ্গোলিয়া থেকে উত্তরে প্রবাহিত, এটি হ্রদের জলের প্রায় ৫০ শতাংশ কাভার করে রেখেছে।
হ্রদের অবস্থান
বৈকাল হ্রদ মঙ্গোলিয়ান সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-মধ্য রাশিয়ায় অবস্থিত। এই হ্রদের নিকটবর্তী বৃহত্তম শহরটি হচ্ছে ইরকুটস্ক। বৈকাল হ্রদ ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ানদের মনে একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। রাশিয়ানরা একে পবিত্র সাগর মনে করে। স্থানীয় পৌরাণিক কাহিনীতে বৈকাল হ্রদের উল্লেখ পাওয়া যায় বেশ।
দক্ষিণ সাইবেরিয়ায়, বৈকাল হ্রদের আশেপাশের জমিগুলি অন্যান্য এলাকার তুলনায় সাধারণত উষ্ণ। সাইবেরিয়ানদের অনুযায়ী, বৈকাল হ্রদ বছরে ৫ লাখের এরও বেশি পর্যটকদের আনাগোণা এখানে।
ইকোসিস্টেম
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিশনের মতে, বৈকাল হ্রদকে ‘রাশিয়ার গালাপাগোস’ বলা হয়। কারন এখানে ব্যতিক্রমী জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান। বৈকাল হ্রদে পাওয়া ৩ হাজার ৭০০ টিরও বেশি প্রজাতির প্রায় ৮০ শতাংশই স্থানীয়। এদের পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।
এই প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল নর্পা, বিশ্বের একমাত্র মিঠা পানির সীল। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন যে কীভাবে নারপা বৈকাল হ্রদে এসেছিল এবং বিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু তারা সন্দেহ করে যে সীলগুলি আর্কটিক থেকে একটি প্রাগৈতিহাসিক নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে। অন্যান্য স্থানীয় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে তৈলাক্ত, আঁশবিহীন গোলোমিয়াঙ্কা মাছ এবং ওমুল, একটি সাদা মাছ যা বৈকাল হ্রদের অন্যতম বিখ্যাত খাবার।
বৈকাল হ্রদের চারপাশে অন্যান্য ভূমি-ভিত্তিক প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভাল্লুক, রেইনডিয়ার, এলক, বন্য শুয়োর, সাইবেরিয়ান রো হরিণ, পোলেক্যাটস, এরমাইন, সেবল এবং নেকড়ে। এছাড়াও কানাডা থেকে আমদানি করা আমেরিকান মিঙ্ক বৈকাল হ্রদের চারপাশে বাস করে।
৫০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ এই হ্রদে বাস করে। জলজ অমেরুদণ্ডী প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ১০০টিরও বেশি প্রজাতির সমতল কীট, ৭০০টিরও বেশি প্রজাতির অ্যানথ্রোপড (পোকামাকড়, আরাকনিড এবং ক্রাস্টেসিয়ান) এবং ১৭০টিরও বেশি প্রজাতির মলাস্ক। এই অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা পানি বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
বৈকাল লেক এলাকায় সিডার, ফার এবং স্প্রুসসহ কয়েক ডজন গাছের প্রজাতি রয়েছে। এমনকি জেনে অবাক হবেন যে কিছু গাছের বয়স ৮০০ বছর পর্যন্ত। আঙ্গারা পাইন এখানের অন্যতম একটি গাছ যা এই এলাকার স্থানীয়। যেহেতু রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার ক্রমবর্ধমানভাবে শিল্পের উন্নয়ন হয়েছে।
দিন দিন পর্যটক বৃদ্ধি পেয়েছে, বৈকাল হ্রদের পরিবেশের তত বেশি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। যা হ্রদের ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকিস্বররুপ। পানির তাপমাত্রা এবং বরফেের ঘনত্বে ইতিমধ্যে পরিবর্তন এসে গিয়েছে। তাই বৈকাল হ্রদ বিলীন যাতে না হয় সেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
Feature Photo: unsplash.com
References: