ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান: যে সপ্তম আশ্চর্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

495
0

বিশাল করিডোরের শেষ মাথায় ঝুলন্ত ব্যালকনি। অভিজাত ব্যাবিলনের এই জায়গাটা একটু প্রশান্তি এনে দেয় অ্যামিটিসকে, নিয়ে যায় পাহাড়ি উদ্যান ঘেরা তার জন্মভূমি মিডিয়াতে। তার এই শূন্যতা বুঝতে পারে তার স্বামী, রাজা নেবুচাদনেজার। স্ত্রীকে এই শূন্যতা থেকে মুক্তি দিতে, জন্মভূমির সবুজ ফিরিয়ে আনতে তিনি শুরু করেন ঐতিহাসিক প্রকল্প-ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান।

যা আজকের দুনিয়াতে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য হিসেবে খ্যাত৷ মজার ব্যাপার হলো, এটিই বিশ্বের একমাত্র ৭ম আশ্চর্য, যার অস্তিত্ব ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কিত। ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বের রাস্তা ধরে আজ যাত্রা হবে প্রাচীন শহর ব্যাবিলনে। 

কিছু পণ্ডিত দাবি করেন যে, এটি ব্যাবিলনে নয় আসলে অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী নিনেভেতে ছিল। এখনও অনেকে বিশ্বাস করে যে, বাগানগুলো প্রাচীন কল্পনার একটি রূপক মাত্র। ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব এবং প্রাচীন ব্যাবিলনীয় গ্রন্থগুলো এই বিষয়ে নীরব। অথচ ব্যাবিলনীয় রেকর্ডগুলোতে নেবুচাদনেজারের সময়ের রাস্তার নাম পর্যন্ত রয়েছে। তবে প্রাচীন লেখকরা বাগানগুলোকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যেন তারা নেবুচাদনেজারের রাজধানীতে ছিল। এর বহিরাগত প্রকৃতি এবং রহস্যময় অস্তিত্ব, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানগুলো সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।  

ব্যাবিলন এবং ২য় নেবুচাদনেজার 

ইরাকের আধুনিক বাগদাদ থেকে প্রায় ৮০ কি.মি. (৫০ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন শহর ব্যাবিলনে বসতি স্থাপনের ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দে। অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্য বিজয়ের পর নেবুচাদনেজারের পিতা নবোপোলাসার (শাসনামল ৬২৫-৬০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নেবুচাদনেজার অ্যামিটিস অব মিডিয়াকে বিয়ে করেছিলেন মেডিস এবং ব্যাবিলনীয়দের মধ্যে একটি জোট সুরক্ষিত করতে। 

শিল্পীর চোখে রাজা ২য় নেবুচাদনেজার। Image source: worldhistory.org by Mohawk Games

এই শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের রাজত্বকালে। তখন শহরটি নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তার শাসনামলে ব্যাবিলন এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল এবং তিনি নিজেই পরিচিত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা-রাজা এবং শাসক হিসাবে।

তিনি তার রাজধানীকে বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শহরগুলোর একটিতে পরিণত করতে শুরু করেন। তিনি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পে তেরোটি শহরকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করেন। 

বর্ণনা

বাগানের এর প্রথম উল্লেখটি আনুমানিক ৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বেরোসাসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ পণ্ডিতরা মনে করেন যে, বাগানের ধারণা সম্পূর্ণরূপে আনন্দের জন্য, খাদ্য উৎপাদনের জন্য ছিল না। সেখান থেকে ধারণাটি প্রাচীন ভূমধ্যসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে অনেকেই বা অন্তত ধনী ব্যক্তিরা বাড়িতে ব্যক্তিগত বাগান চাষ শুরু করে। 

বাগানগুলো কেবল ফুল এবং গাছপালা সম্পর্কে ছিল না, সাথে স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং পানির ব্যবস্থা যুক্ত ছিল। উদ্যানগুলো এত জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে ফ্রেস্কো চিত্রশিল্পীরা, ভিলার পুরো দেয়ালকে বাগানের দৃশ্য দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। ঘরে প্রবেশ করার সময় মনে হতো যেন, কেউ একটি বাগানে প্রবেশ করছে। 

উনিশ শতকে শিল্পীর আঁকা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান Image source: wikipedia.org

বেরোসাস উচ্চ পাথরের সোপানগুলো বর্ণনা করেছেন যা পাহাড়ের অনুকরণ করে এবং যেগুলোতে অনেক ধরনের বড় গাছ এবং ফুল লাগানো হয়েছিল। ছাদগুলো এমন স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি করা হয়েছিল যে, কেবল ঝুলন্ত গাছপালাগুলোর একটি মনোরম নান্দনিক প্রভাব তৈরি করবে না, বরং তাদের সেচকেও সহজ করবে। 

ডায়োডোরাস সিকুলাস উল্লেখ করেছেন য, বাগানের ছাদগুলো একটি প্রাচীন থিয়েটারের মতো উপরের দিকে ঢালু ছিল এবং ২০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এটি স্তম্ভের উপর নল ও ইট দিয়ে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত বলে জানা যায়।

গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবো (আনুমানিক ৬৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ- ২৪ খ্রিষ্টাব্দ), উদ্যানগুলোর অবস্থান বর্ণনা করেছেন ইউফ্রেটিস নদীর তীরে, যা প্রাচীন ব্যাবিলনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল এবং একটি জটিল যন্ত্রের মাধ্যমে নদী থেকে পানি টেনে এনেছিল। তিনি বাগানের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছানোর জন্য সিঁড়ির উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করেছেন। 

মেসোপটেমিয়ার উদ্যান

মেসোপটেমিয়ায় বৃহৎ উদ্যানগুলোর নজির রয়েছে যেগুলো ব্যাবিলনে ছিল বলে জানা গেছে। এমনকি তাদের ছবিও রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, নিনেভের আশুরবানিপালের উত্তর প্রাসাদ (৬৬৮-৬৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) থেকে একটি প্যানেল, যা এখন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রয়েছে। 

নিনেভের আশুরবানিপালের উত্তর প্রাসাদের প্যানেল, যা এখন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রয়েছে Image source: SPL/AGE FOTOSTOCK

কিছু পণ্ডিতের মতে, পুরো বিষয়টি একটি সম্মিলিত ভুল ধারণার ফলাফল এবং নিনেভেতেই প্রকৃতপক্ষে উদ্যানটি ছিল। যেখানে সেনাকেরিব (আনুমানিক ৭০৫-৬৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) নির্মাণ করেছিল। এর প্রচুর লিখিত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে এবং শহরটিকে কখনও কখনও ‘পুরানো ব্যাবিলন’ হিসাবেও উল্লেখ করা হতো।  

বিতর্ক

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানকে কখনও কখনও সেমিরামিসের ঝুলন্ত উদ্যান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কারণ গ্রিকরা ভাবতো, কিংবদন্তি এবং ঐশ্বরিক নারী অ্যাসিরিয়ান শাসক খ্রিষ্টপূর্ব ৯ম শতাব্দীতে ব্যাবিলনকে পুনর্নির্মাণ করেছিল।  

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের অনারারি রিসার্চ ফেলো ড. স্টেফানি ডালি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ভাষার একজন পণ্ডিত। তিনি রাজা সেনাকেরিবের প্রাচীন গ্রন্থের নতুন অনুবাদে নিনেভের প্রমাণ পেয়েছেন। আধুনিক দিনের ইরাকের শহর মসুলের কাছে নিনেভের আশেপাশে সাম্প্রতিক খননে, একটি বিস্তৃত জলজ ব্যবস্থার প্রমাণ এবং শিলালিপি পাওয়া গেছে।  

ডালির মতে, বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে ৬৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরিয়ান ব্যাবিলন জয়ের কারণে। অধিগ্রহণের পরে, নিনেভেকে ‘নতুন ব্যাবিলন’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং সেনাকেরিব এমনকি ব্যাবিলনের প্রবেশদ্বারগুলোর নামানুসারে শহরের দরজাগুলোর নামকরণ করেছিলেন। 

ডালির দাবী, পুরনো অনেক ধারণা উড়িয়ে দিতে পারে। আবার এটাও প্রমাণ করতে পারে যে, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানগুলোকে ভুল নামকরণ করা হয়েছে এবং এটি নিনেভের ঝুলন্ত উদ্যান হওয়া উচিত। 

রাজা সেনাকেরিব Image source: wikipedia.org

খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস ব্যাবিলনের চিত্তাকর্ষক সেচ ব্যবস্থা এবং দেয়ালের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কোনো বাগানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেননি (যদিও গ্রেট স্ফিংসও তার গিজার বর্ণনা থেকে অনুপস্থিত)। 

অন্যান্য বেশ কয়েকটি উৎস বাগানগুলোকে এমনভাবে বর্ণনা করে যেন, সেগুলো এখনও খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে বিদ্যমান। কিন্তু সবগুলোই রচিত হয়েছিল নেবুচাদনেজারের রাজত্বের কয়েক শতাব্দী পরে এবং সবগুলো এমন লেখকদের দ্বারা রচিত যারা প্রায় নিশ্চিতভাবে কখনও ব্যাবিলনে যাননি। এবং যারা বাগান তৈরি বা প্রকৌশল সম্পর্কে খুব কমই জানতেন। 

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ধরনের সমস্ত বাগানে সাধারণত সেচ এবং ছায়া দেওয়ার উঁচু দেয়াল ছিল। সাধারণত পানির উৎসের কাছে এবং প্রাসাদের সাথে যুক্ত ছিল। তাই কিছু পণ্ডিত অনুমান করেছেন, ব্যাবিলনের উদ্যান যদি থাকত, তাহলে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে নেবুকাদনেজারের প্রাসাদের কাছে থাকত। 

শিল্পীর চোখে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান। Image Source: SANTI PÉREZ / Nat Geo

প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও, এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, এই উদ্যান কখনই ছিল না। বিশেষ করে প্রাচীন লেখকরা যেখানে উল্লেখ করেছেন। যদিও মূল তালিকাগুলো গ্রিক লেখকদের দ্বারা সংকলিত হয়েছিল। সম্ভবত, ব্যাবিলনে কোনও ধরনের বাগান ছিল এবং এটি তাদের মধ্য দিয়ে অতিরঞ্জিত হয়ে ওঠে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজই বলে দিবে এর সত্যতা। 

অন্তত এটা বুঝা যাবে, সপ্ত আশ্চর্যের ধারণাটি কেন তৈরি হয়েছিল। এটি সত্যিকারের বিস্ময়কর মানব প্রচেষ্টার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা, যা খুব কম লোকই কখনও নিজে দেখতে পারবে। অথচ তা এখনও বিস্ময় আর আলোচনার বিষয়, এবং অনুকরণীয়।  

 

 

 

Featured Image: nationalgeographic.com 
References:

01. Hanging_Gardens_of_Babylon. 
02. Hanging-Gardens-Existed-But-Not-in-Babylon.