বি ২ স্পিরিট – বিশ্বের সবচাইতে দামী সামরিক বিমান

550
0

কসোভো যুদ্ধের সময় ঘটেছিল এক অবাক করা ঘটনা৷ মাত্র অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে চললো ন্যাটো জোটের তান্ডবলীলা, বড় বড় সামরিক স্থাপনা মুহূর্তেই মিশে গেল মাটির সাথে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ধ্বংস করে দিয়ে ৬টি লংরেঞ্জ বোমারু বিমান ফিরে আসে যুক্তরাষ্ট্রে৷

সার্বিয়ান এয়ার ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের ততক্ষণে চক্ষু চড়কগাছ। শত্রুকে প্রতিহত করার সম্ভাব্য সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরেও শত্রুপক্ষ তাদের নাকের ডগা দিয়ে সব ধ্বংস করে দিয়ে চলে গেল এবং তারা কিছুই করতে পারেনি৷ তাদের শক্তিশালী রাডারে কিছু ধরা না পড়লেও শত্রুপক্ষের বিমান থেকে চলছে ভয়ংকর হামলা৷ ন্যাটো জোটের ভয়ংকর এই হামলা চলে ১৯৯৯ সালে, যাকে যুগোশ্লাভিয়া যুদ্ধও বলা হয়৷

এই যুদ্ধে ব্যবহৃত বিমানগুলো আগে আর কখনো কোনো যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় নি। যুক্তরাষ্ট্র এমন বিমান তৈরী করেছে সেই কথাও কেউ জানতে পারেনি এর আগে৷

প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্বিয়ায় হামলা চালিয়ে আবারো নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বিমানগুলোর সময় লেগেছিল প্রায় ৩০ ঘন্টা৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্বিয়ার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মাইল৷ এত দীর্ঘ সময় বিমানগুলো চলেছিল বিরতিহীনভাবে৷ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই লংরেঞ্জ বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন সেক্টরে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা, শত্রুর বিরূদ্ধে যুদ্ধকে করেছিল আরো সহজ ও বেগবান৷

বলছিলাম বি-২ স্পিরিটের কথা, যা এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিমান৷ আমাদের আজকের এই লেখাটির পুরোটাই বি ২ স্পিরিট নিয়ে৷

বি২ স্পিরিট যুদ্ধ বিমান। Image Source: pixabay.com

সৃষ্টির সূচনা

১৯৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে বোয়িং বি-৫২ এর বিকল্প বিমান খোঁজা হচ্ছিলো কারন এর ক্ষমতা ছিল তুলনামূলক কম। আরো উন্নত যুদ্ধবিমান তৈরীর লক্ষ্যে বি-৭০ এবং বি-১এ এর কয়েকটি বিমান তৈরী করা হলেও কিছুদিন পরই তাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ এর মাঝামাঝিতে কার্টার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো স্টেলথ বিমান তৈরীর যেটি রাডারের সিগন্যালের প্রতি কম সাড়া দিবে এবং সহজেই রাডারে ধরা পড়বে না।

সেই লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান DARPA (Defense Advanced Research Projects Agency) Advanced Technology Bomber বা এটিবি প্রজেক্ট হাতে নেয়। এই প্রজেক্টের জন্য তারা ওপেন টেন্ডার আহবান করে। উদ্দেশ্য ছিল সবচেয়ে কার্যকরী এবং অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান যুক্তরাষ্ট্রের ঝুলিতে যোগ করা৷ এই টেন্ডারে সাড়া দেয় নর্থরোপ গ্রুম্যান, লকহিড, ম্যাকডোনেল ডগলাসসহ নামী দামী সব বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান৷

এদের মধ্যে লকহিডের পূর্ব অভিজ্ঞ ছিল। কারণ তারা এর আগে লকহিড এ-১২ এবং এস.আর-৭১ তৈরী করেছিল যেগুলোতে স্টেলদি ফিচার, কি লোকেশনে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল এবং ওভার অল সার্ফেস রাডার এব্জরভিং পেইন্ট ছিল৷ এস আর-৭১ ছিল তখনকার সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান৷ ১৯৭৫ সালে DARPA এক্সপেরিমেন্টাল সারভাইব্যালিটি টেস্টবিড শুরু করে এবং প্রথম রাউন্ডে টেস্টিং এর জন্য নর্থরোপ ও লকহিড কন্ট্রাক্ট করে৷ লকহিড ১৯৭৬ এর এপ্রিলে সেকেন্ড রাউন্ড টেস্টের অনুমোদন পায়৷

যদিও লকহিডের অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান তৈরীর খেতাব ছিল; তারপরেও ওয়াই-বি৩৫ এবং ওয়াই-বি৪৯ উইং এয়ারক্র্যাফট তৈরীর অভিজ্ঞতা নর্থরোপকে লকহিড থেকে এগিয়ে রাখে। অবশেষে ১৯৮১ সালের ২০ অক্টোবর নর্থরোপের ডিজাইন এটিবি ডিজাইনের জন্য নির্বাচিত হয়৷ নর্থরোপের ডিজাইন বি-২ এর ডেজিগনেশন পায় এবং নাম হয় স্পিরিট৷

হাই অলটিচিউড থেকে লো অলটিচিউডে মিশন চ্যাঞ্জ হওয়ায় বিমানটির ডিজাইনেও কিছু পরিবর্তন আনা হয় একই সালের মাঝামাঝিতে৷ রিডিজাইনের জন্য বি-২ এর উড্ডয়ন ২ বছর এর জন্য পিছিয়ে যায় এবং এর জন্য আরো ১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হয়৷ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় এর রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের জন্য৷

বি২ স্পিরিট দেখতে এমনই। Image Source: wallpaperflare.com

খরচ

বি ২ এর তৈরীর খরচ শুনলে অবাক হবে না এমন লোক বোধকরি খুব কমই আছে৷ কমবেশি সবারই চক্ষু চড়কগাছ হবে৷ ১৯৮৯ সাল পর্যন্তই বারবার ডিজাইন আপডেটের কারনে ব্যয় ২৩ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়৷ ১৯৯৭ সালের হিসেবে প্রতিটি বি-২ স্পিরিটের তৈরীতে খরচ হয় ৭৩৭ মিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তীতে বেড়ে হয় ৯২৯ মিলিয়ন ডলার৷ অতিরিক্ত ১৯২ মিলিয়ন ডলার খরচ হয় বিমানগুলোর স্পেয়ার পার্টস ও বিভিন্ন ইকুয়িপমেন্ট সংযোজন করার পেছনে৷

মার্কিন এভিয়েশন অথরিটি প্রথমে ১৩২টি বিমান কেনার করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে এর সংখ্যা ২১ এ নেমে আসে৷ কারণ তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধও শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল৷ প্রতিটি বিমান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাৎসরিক খরচ প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার, যা বিনা প্রয়োজনে খরচ হচ্ছিল৷ প্রতিটি বিমান একবার উড্ডয়ন করতে প্রতিঘন্টায় খরচ হয় ১.৩৫ লাখ ডলার এবং একটি মিশন শেষ করার পর পরবর্তী মিশনের জন্য বিমানগুলোকে তৈরী করতে লাগে প্রায় ১১৯ ঘন্টা৷

যেহেতু আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় ঘটেছিল। তাই বাজেটরী প্রেসার ও কংগ্রেস সদস্যরা এতগুলো বিমান কেনার বিরোধিতা করেন৷ তোপের মুখে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বিমানের সংখ্যা ২১ এ নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন৷ ২১টি বি-২ স্পিরিট বিমান তৈরী করা হয় এবং বর্তমানে আছে ২০টি৷ মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেজে আছে ১৯টি এবং অন্যটি আছে ক্যালিফোর্নিয়ার এডুয়ার্ড এয়ার ফোর্স বেজে, টেস্টিং এবং নতুন উন্নয়ন কাজের জন্য৷

২০০৮ সালে বি ২ এর একটি বিমান ‘দ্য স্পিরিট অব কানসাস’ গুয়ামের এন্ডারসন এয়ার ফোর্স বেজে অবতরনের সময় ক্রাশ করে৷ সেই যাত্রায় পাইলট দুজন বেঁচে গেলেও বিমানটি ধ্বংস হয়৷

বেইজে থাকা অবস্থায় বি২ স্পিরিট। Image Source: wallpaperflare.com

অনন্যতা

একদিকে এটি যেমন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিমান, অন্যদিকে এর রয়েছে ইউনিক সব ফিচার; যা অন্যান্য কনভেনশনাল সব বিমান থেকে একে আলাদা করেছে৷ পাইলটদের প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য রয়েছে টয়লেট, আছে মিনি কিচেনও। যেখানে খুব সহজেই খাবার গরম করা যায়। যেহেতু এই বিমানগুলো দীর্ঘসময় উড্ডয়ন করে,তাই পাইলটদের সুবিধার্থে এই ফিচারগুলো যোগ করা হয়েছে৷ সেই সাথে রয়েছে অটো পাইলট সিস্টেম৷ ফলে ককপিটে একজন পাইলট থাকলেও বিমান চলবে স্বাচ্ছন্দ্যে৷ অপরজন চাইলে এই সময় খানিকটা ঘুমিয়েও নিতে পারেন পেছনের করিডোরে৷

ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০,০০০ ফুট বা ১৫ কিলোমিটার উপরে উঠতে পারে এই বিমানগুলো৷ প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার বা ৬৯০০ মাইল রেঞ্জের এই স্টেলথ বোম্বারগুলো নিউ ইয়র্ক থেকে ভারত আসতে পারবে কোনোরকম রিফুয়েলিং ছাড়াই৷ ঘন্টায় এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ১০১০ কিলোমিটার৷ মাঝ আকাশে শুধুমাত্র একবার রিফুয়েলিং করলেই এর রেঞ্জ বেড়ে হবে ১৯ হাজার কিলোমিটার বা ১০০০ নটিক্যাল মাইল৷

এই তুরুপের তাসের ভরসায় যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যে কোন দেশের উপর হামলা করতে পারে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই৷ সবদিক বিবেচনায় বি-২ স্পিরিট এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে সেরা যুদ্ধবিমান, বলাই বাহুল্য৷ বি-২ আসলে একটি গ্রে প্রজেক্ট হিসেবে ডেভেলপ করা হয়েছে৷ যার মানে হচ্ছে প্রজেক্টটি জনগনের কাছে সিক্রেট হিসেবে থাকবে এবং শুধুমাত্র সরকারি কয়েকটি এজেন্সি এর ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে জানবে৷ ফলে বিভিন্ন দেশ বারবার চেষ্টা করেছে এর ডিজাইন চুরি করতে৷ ১৯৮৪ সালে নর্থরোপেরই এক কর্মচারী থমাস ক্যাভানাফকে আটক করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ২৫০০০ ডলারের বিনিময়ে বি-২ এর নকশার তথ্য পাচারের অভিযোগে৷

অক্টোবর ২০০৫ এ আবারো একই ঘটনা ঘটে৷ নোশির গোয়াদিয়া নামক বি২ এর পরিচালক সিস্টেমের একজন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারকে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে ৩২ বছরের জেল দেওয়া হয়৷ কারণ নোশির বিদেশে বি-২ এর ডিজাইন রিলেটেড ইনফরমেশন বিক্রি করেছিলেন৷ তবে সম্প্রতি চীনে এর কপি ভার্শন তৈরী করা হয়েছে৷

আকাশে উড্ডয়নরত বি২ স্পিরিট। Image Source: military.com

সক্ষমতা

বি২ বিমানগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি অন্য কনভেনশনাল বিমানের মতো বিভিন্ন সামরিক অস্ত্র তার ডানার ভেতর রাখে না। তার বদলে রাখে পেটের ভেতর! সর্বনিম্ন ১৮ টন থেকে শুরু করে ২৩ টন পর্যন্ত ওজনের বোমা এর মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়৷

প্রতিটি এয়ারক্রাফটের সক্ষমতা রয়েছে Mk-82 এবং GBU-38 নামক মোট ৮০টি বোমা বহন করার, যাদের প্রতিটির ওজন প্রায় ৫০০ পাউন্ডের মতো। এছাড়াও, বিমানগুলো ৩৬টি ৭৫০ পাউন্ড ওজনের CBU ক্লাস বোমা বহন করতে পারে; অথবা ২,০০০ পাউন্ডের মোট ১৬ Mk-84 বা GBU-31 বোমা বহন করতে পারে৷

২২-১৩০ কিলোমিটার রেঞ্জের মোট ৩৬টি AGM-154 মিসাইল বহন করতে পারে মাত্র একটি বি-২ বিমান৷ সেই সাথে বহন করতে পারে মোট ১৬টি B-61 বা B-83 নিউক্লিয়ার বোমা৷ প্রতিটি বি-৬১ বোমা ০.৩ থেকে ৪০০ কিলোটন এবং বি-৮৩ প্রায় ১.২ মেগাটন ধ্বংস করে দিতে পারে নিমিষেই! সেই হিসেবে একটিমাত্র বি-২ বোম্বার চোখের পলকেই ধ্বংস করে দিতে পারে একটি পুরো শহর৷

বি২ স্পিরিট। Image Source: military.com

শুধুমাত্র একটি বি২ বিমান মাটির প্রায় ২০০ ফুট নিচে থাকা যে কোনো বাংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে৷ কারণ, এটি Massive Ordinance Penetrator নামে প্রায় ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট দুটি GBU 57 নামক বোমা বহন করে যাতে ব্যবহার করা হয় পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি ওজনের বিস্ফোরক৷

ইতিহাস বলছে বি ২ বিমানগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায়৷ বি২ এর সবচেয়ে দীর্ঘতম ফ্লাইটের ব্যপ্তি ৪৪.৩ ঘন্টা, আফগানিস্তানে তালেবানদের উপর হামলা করা হয় সেই যুদ্ধে৷ রাশিয়ার আকাশপথ ব্যবহার করতে না পারায় সেবার বিমানগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর পার হয়ে পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে হামলা করে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হয়৷ এতে মোট সময় লেগেছিল ৪৪.৩ ঘন্টা; যা একইসাথে বি ২ এবং পৃথিবীর আকাশপথে কোনো যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে দীর্ঘসময় উড্ডয়নের রেকর্ড৷

২০৩২ সালে এই বিমানগুলোর চুক্তি শেষ হবে। এর বদলে আসবে একই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নর্থরোপের বি-২১ রেইডার, যা বি-২ স্পিরিটের চেয়েও শক্তিশালী৷

 

Feature Image: wallpaperflare.com
References:

1. http://thegrizzled.
2.http://britannica.
3.http://military-history.fandom.
4.http://nuke.fas.org.