অ্যাজতালান (অ্যাজটালান বা অ্যাজলান নামেও পরিচিত) হলো অ্যাজটেকদের পৌরাণিক পবিত্র এক ভূমির নাম; যা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মেসোআমেরিকান সভ্যতায় যা মেক্সিকা নামেও পরিচিত। অ্যাজটেকদের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, দেবতা হুইটজিলোপোটলির নির্দেশে মেক্সিকারা নতুন আর পবিত্র এক ভূমির খোঁজে অ্যাজতালান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিল।
নাহুয়া ভাষায়, অ্যাজতালান শব্দের অর্থ ‘শুভ্রতার স্থান’ অথবা ‘সারস পাখির আবাসস্থল।’ তবে সত্যিকার অর্থেই এমন কোনো জায়গা ছিল কিনা সেই প্রশ্ন আসলে থেকেই যায়। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে আজকের আলোচনায়।
কেমন ছিল অ্যাজতালান?
অ্যাজতালান কেমন ছিল তা নিয়ে স্বয়ং মেক্সিকা অর্থাৎ অ্যাজটেকদের রয়েছে বিভিন্ন সংস্করণ। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মতবাদ অনুসারে, বিশাল আর সুন্দর এক হৃদের উপর বিলাশবহুল এবং আনন্দদায়ক এক জায়গা ছিল এই অ্যাজতালান। যেখানে বসবাসকারী সকলেই ছিল চরম সুখী এবং অমরত্ব ছিল তাদের সঙ্গি।
সম্পদের প্রাচুর্যে পূর্ণ এই হ্রদের ঠিক মাঝখানে কলহুয়াকান নামে একটা খাড়া পাহাড় ছিল আর সেই পাহাড়ে ছিল গুহা। সেইসব গুহায় সম্মিলিতভাবে বসবাস করতো চিকোমোজটক নামে পরিচিত অ্যাজটেকদের পূর্বপুরুষগণ। পুরো হ্রদ জুড়ে ছিল হাঁস, সারস এবং বিভিন্ন জলচর পাখির কলতান; মনের সুখে গান গেয়ে বেড়াতো হলুদ, লাল ও নীল রঙের এসব পাখি; মাছ মনের আনন্দে সাঁতার কাটতো আর চিকোমোজটকরা দেবতার আর্শীবাদে সুখ আর সমৃদ্ধিতে বসবাস করো।
কোথায় ছিল অ্যাজতালান?
অ্যাজটেক লোকসাহিত্যের সূত্রে বলা যেতে পারে উত্তর মেক্সিকোর (North Mexico) কোথাও ছিল অ্যাজতালানের অবস্থান। পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে ছিল অ্যাজতালান। কেউ কেউ বলেন অ্যারিজোনা, কলোরাডো এবং বর্তমানের নিউ মেক্সিকোর আশেপাশে কোথাও ছিল অ্যাজতালান ভূখণ্ড। অ্যাজতালান ভূখণ্ড আসলে পৌরাণিক অস্তিত্বের ওপর ভিত্তি করে অনুমিত একটা ভূখণ্ড।
অ্যাজতালান কেন্দ্রিক সংস্কৃতি
কোনো একটা নাম তখনই মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যখন তা ঐতিহ্যবাহী কোনো সংস্কৃতির অংশ হয়। অ্যাজটেক সংস্কৃতি বলতে মূলত অ্যাজতালানের সংস্কৃতিকেই নির্দেশ করা হয়। কৃষি ও ভূমিব্যবস্থা কেন্দ্রিক অর্থনীতি ছিল সেকালের অ্যাজতালানে। নিজস্ব লিখন ব্যবস্থা এবং পঞ্জিকার প্রচলন করেছিল তারা। মন্দির এবং উপাসনালয়ের যে গঠনগত সৌন্দর্য ছিল তা অ্যাজটেকদের স্থাপত্যরুচির পরিচায়ক।
অ্যাজটেকদের মধ্যে ধনী-গরিব ব্যবধান লক্ষ করা যেতো। ধনী যারা, তারা ইটপাথরের প্রাসাদোপম ঘরে বাস করতো। ধূমায়িত কক্ষ থাকতো সেসব ঘর অধিবাসীদের গোসলের জন্য। কতটা শান-শওকতের মধ্যে ছিল ধনীদের বাস! এরা পিপিলটিন শ্রেণিভুক্ত ছিল। সমাজ পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব এবং ক্ষমতা এদের হাতে ন্যস্ত ছিল।
অন্যদিকে বাগানঘেরা বাড়িতে মাটি এবং খড়নির্মিত কুঁড়েঘরে বেশিরভাগ গরিব অ্যাজটেক বাস করতো। বাগানে হতো মৌসুমি সবজির চাষ। বাড়ির ভেতর শোবার ঘর, রান্নাঘর ছাড়াও প্রার্থনার জন্য আলাদা ঘর থাকতো। আমাদের দেশের মুসলিমদের যেমন নামাজের স্থান, হিন্দুদের যেমন ঠাকুরঘর থাকে বাড়িতে, অ্যাজটেকরাও সে অর্থে ধর্মপ্রাণ ছিল বলা যায়।
তো, ধনী-গরিবের এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বেশিরভাগ অ্যাজটেককে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। সমাজে ছিল দুই শ্রেণির পেশাজীবী—যোদ্ধা আর কৃষিজীবী। শ্রেণিব্যবধান এখানেই স্পষ্ট যে ধনী যারা, তাদের জন্য যোদ্ধার মর্যাদা এবং যথারীতি তুলনামূলক গরিবদের জন্য মূলত কৃষিই অবলম্বন।
স্ত্রীলোকেরা ঘর-গেরস্থালি সামলাত, কাপড় সেলাই আর রান্নাবান্না করে সময় কাটাতো। এরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করতো। গোষ্ঠীগুলোর সাধারণ নাম ছিল কালপুলি।
কর্মমুখী শিক্ষা অর্জনে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। শিকার এবং খামারের কাজ শেখানো হতো ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য ছিল রান্নাবান্না আর ঘরকন্নার শিক্ষা। অর্থাৎ, আদিম যুগের গুহামানবদের শিকারি সমাজ এবং কৃষি সমাজের প্রভাব অ্যাজটেকদের ভেতর ছিল। তবে এরা সভ্যতার দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিল।
ধর্মীয় চেতনায় অ্যাজটেকরা
অ্যাজটেকদের ধর্মীয় চেতনা ছিল বহুত্ববাদী। অর্থাৎ, একাধিক ঈশ্বরের আরাধনা চলতো অ্যাজতালানে। এরা দেবতাদেরকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছিল—আকাশের দেবতা, বৃষ্টি ও চাষবাসের দেবতা এবং যুদ্ধ ও আত্মত্যাগের দেবতা। দেবতারা হচ্ছেন-হুইটজিলোপোটলি (Huitzilopochtli), কোয়েটজালকোটল (Quetzalcoatl), তলালক (Tlaloc) প্রমুখ।
পঞ্জিকা তারা ভাগ্য গণনার কাজে ব্যবহার করতো। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের পর্ব নির্ধারণ হতো এই পঞ্জিকা দেখেই। ধর্ম রক্ষার্থে, অন্য কথায় ঈশ্বরের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এদের মধ্যে নরবলির প্রচলন ছিল।
পালিত আচারাদি
নরবলির বিষয়টি একটা উৎসবের আমেজে সমাধা করতো অ্যাজটেকরা। এভাবে বলিকৃত লোকের বুক ফেড়ে হৃদপিণ্ড বের করে ব্লেড দিয়ে স্লাইস করে কাটতো তারা। শিকারের রক্ত এরপর মন্দিরের সিঁড়িতে ঝরানো হতো। সবচেয়ে লোমহর্ষক সত্য এটাই যে, তারা আয়োজন করে এসব মানুষের মাংস ভক্ষণ করতো। কারো জন্য মৃত্যু কারো জন্য উৎসবে এভাবেই বুঝি পরিণত হয়।
এই অসংযত আচারের বিপরীতে সংযমের আচারও ছিল বটে। এর আওতায় ছিল একটানা চারদিন বা তারও বেশি না খেয়ে, না নেয়ে থাকা। এ সময় যৌন সঙ্গমেও নিষেধাজ্ঞা থাকত।
এ সকল আচারের পাশাপাশি দেবতাকে খুশি করতে নৈবেদ্য তথা খাবারদাবার, ফুল, কাগজ, কাপড় ইত্যাদি দিতে হতো। ভক্তরা নাচ-গান করে, অনুমোদিত খাবার খেয়ে, বাদ্যবাজনা বাজিয়ে আচারের সময় কাটাত।
অ্যাজটেকদের পূর্বপুরুষদের বাস ছিল কলহুয়াকান নামের খাঁড়া এক পাহাড়ের গুহায়। তার চারপাশে হ্রদ। ফলে অজস্র হাঁসসহ রঙবেরঙের অন্যান্য জলচর পাখির কিচিরমিচিরে মুখর একটা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতো। মাছ ধরে, সবজি ফলিয়ে সেসব খেয়েই তারা জীবনধারণ করতো।
অ্যাজতালানের গুরুত্ব
আদিম ধরণের জীবনপ্রণালীই তাদের ছিল। আর ছিল আদি মিশরীয়দের সাথে স্থাপত্যকৌশলগত মননে আশ্চর্য মিল। তারাও মিশরীয়দের মতো পিরামিড তৈরি করতো। রাজা এবং দেবতাদের উদ্দেশ্য করে। তাদের মধ্যে অমরত্বের ধারণা ছিল। কত বছর বাঁচবে তা নিজেরাই ঠিক করতে পারত।
শহরায়ন এবং নগর পরিকল্পনার মতো প্রগতিশীল জ্ঞান তাদের মধ্যে ছিল। স্থানে স্থানে খাল খনন করতেও তারা জানত। অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে তারা পারেনি। কারণ চাকা আবিষ্কারের জ্ঞান তাদের ছিল না। বর্তমান মেক্সিকো ভূখণ্ডে তাদের রাজধানী টেনোচতিতলান বড়োসড়ো দালানের পাশাপাশি পর্বতশ্রেণি, আগ্নেয়গিরি এসবও রয়েছে। তাদের পরিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নগরায়নেও তারা বজায় রেখেছে।
বিভিন্ন ধরণের চকলেট, খাদ্য ও পানীয় তারা উদ্ভাবন করেছিল। তারা বিশ্বাস করতো পানীয় চকলেট ঐশ্বরিক উপহার। তাই সেসব খাওয়া ধর্মের কাজ বটে। সে কারণে বলা যায় তাদের মাধ্যমে চকলেট একটা বিরাট প্রচারণা পেয়ে যায়। শিশুখাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হতে সময় লাগে না খুব।
মূলত নগরায়ন প্রযুক্তিকৌশল এবং এর পাশাপাশি উন্নত জীবনব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারার গুণেই নতুন জায়গায় দ্রুত মানিয়ে নিতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি অ্যাজটেকদের।
অ্যাজতালানের পতন
আকস্মিক পারিবেশিক পরিবর্তনজনিত কারণে অ্যাজতালানে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে। পৌরাণিক বিশ্বাস অবশ্য অন্য কথা বলে। প্রাকৃতিক এবং অতিপ্রাকৃতিক—উভয় কারণেই এমনটা ঘটে থাকতে পারে বলা হয়।
অ্যাজটেকদের পূর্বপুরুষের ভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় চন্দ্রদেবী কোয়োলক্সেউকি (Coyolxauhqui)-কে দায়ী করা হয় কখনো কখনো। চন্দ্রদেবী একা নন। চারশ তারা দেবীর ভাই। এরা সকলে দেবীর সঙ্গে যোগ দিয়ে সূর্য অর্থাৎ হুইটজিলোপোটলিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল।
এই ঘটনা ঘটেছিল কোয়াটেপেক পর্বতশ্রেণিতে। ধারণা করা হয় এই পৌরাণিক ঘটনার রেশ ধরেই অ্যাজতালানের প্রাকৃতিক পরিবেশ অ্যাজটেকদের বিরুদ্ধে চলে যায়।
সমগ্র ভূখণ্ড আবর্জনা, কাঁটা আর পাথরটুকরোতে ভরে যায়। বিষাক্ত সাপ কিলবিল করতে থাকে মাঠে মাঠে। আরও দেখা যায় বিপজ্জনক সরীসৃপ ও বন্য প্রাণীর যূথ। এতে অধিবাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অন্যত্র চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
কোনো একটা সংস্কৃতির জন্মস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। মূল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া মানুষগুলো নতুন জায়গায় স্থির হতেও কিছুটা সময় নেয়। সমৃদ্ধ সংস্কৃতিও তখন হুমকির মুখে পড়ে।
অ্যাজতালানের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে ঘটনা। এর অধিবাসীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে। অ্যাজটেকরা মেক্সিকোর ভেতরে টেনোচতিতলান নামে নতুন রাজধানী গড়ে সেখানে কিছুকাল ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে একসময়কার শীর্ষস্থানীয় এক জাতিগোষ্ঠী।
Feature Image: project global References: 01. The Aztecs Facts for Kids. 02. Aztlán, The Mythical Homeland of the Aztec-Mexica. 03. Top 10 Things to Know About the Aztecs and Their Empire. 04. Human Sacrifice: Why the Aztecs Practiced This Gory Ritual. 05. Aztec Ritual and Sacrifice. 06. Vision That Inspires Some and Scares Others: Aztlan.