সময়টা ১৯৬০ সাল, ইসরায়েলের কারমেল উপকূলে হারিয়ে যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের খনন কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। ৮০’র দশকের এক শীতের সকাল, স্থান ইসরায়েলের হাইফার কাছে কারমেল উপকূল। খনন কাজ পুরোদমে চলছে।
গবেষক আর বিজ্ঞানীদের চেষ্টায়, পানির নিচে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার চিহ্ন আবিষ্কার হচ্ছে একের পর এক। কড়া রোদে শ্রমিকদের কাজেও আলস্য দেখা যাচ্ছে। গবেষক দলের প্রধান, পানির নিচে জাহাজ ধ্বংসের স্থান পর্যবেক্ষণে যান। দেখা যায়, বালির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে প্রাচীন স্থাপনার কোনো বাড়ির ছাদ। আর এভাবেই সন্ধান মেলে আতলিত ইয়ামের।
ভৌগোলিক অবস্থান
লেভানটাইন উপকূলের প্রাচীন জীবিকা ব্যবস্থার এক অন্যতম উদাহারণ আতলিত ইয়াম। এটি কৃষিসমাজ, পশুপালন এবং সামুদ্রিক জীবিকা ব্যবস্থার মিশ্রণে তৈরি এক পুরনো সভ্যতা। এটি ইসরায়েলের আতলিত উপকূলে নিমজ্জিত একটি নিওলিথিক গ্রাম। এর সময়কাল কার্বন-ডেটের মাধ্যমে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৬৯০০ এবং ৬৩০০ এর মধ্যে।
জায়গাটি বর্তমান সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ১০ মিটার নিচে ৪০,০০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে। ২১ শতকে এর অবস্থান পাওয়া যায়, ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের ৮-১২ মিটার (২৫-৪০ফুট) নিচে। নিমজ্জিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি, আতলিত উপসাগরের কারমেল উপকূলের ওরেন নদীর মুখে অবস্থিত।
আবিষ্কারের ইতিহাস
বরফ যুগের অবসানের পর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে, স্থানটি ৯০০০ বছর ধরে বালির নিচে চাপা পড়ে ছিল। ধারণা করা হয়, উপকূল রেখাটি বর্তমান উপকূল থেকে প্রায় ১ কি. মি. (আধা মাইল) পশ্চিমে ছিল। ইতালির ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ জিওফিজিকস অ্যান্ড ভলকেনোলজির’ মারিয়া প্যারেস্কির নেতৃত্বে প্রথম গবেষণা করা হয়।
সেখানে বলা হয়, ৮৫০০ বছর আগে মাউন্ট এটনার পূর্ব দিকের একটি আগ্নেয়গিরির পতন সম্ভবত ১০ তলা সমান (৪০ মিটার বা ১৩০ ফুট) সুনামি সৃষ্টি করেছিল। যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভূমধ্যসাগরের উপকূলের শহরগুলোকে গ্রাস করে। একই সময়ে আতলিত ইয়ামের পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনাও এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, এই ধরনের সুনামি সত্যিই ঘটেছিল।
১৯৮৪ সালের এক শীতের সকালে, সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক এহুদ গ্যালিলি জাহাজ ধ্বংসের এলাকা জরিপ করার সময় কারমেল উপকূলে প্রাচীন নিমজ্জিত বসতির অবশেষ দেখতে পান। এটি নিওলিথিক যুগের সেই সময়কে নির্দেশ করে, যখন মানুষ সবেমাত্র গাছপালা এবং প্রাণিদের গৃহপালিত করার উপায় আবিষ্কার করেছিল। গ্যালিলির মতে, এটি মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
আতলিত ইয়ামে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত বস্তুগুলো থেকে সেই সময়ের জীবনব্যবস্থা, স্থাপত্য, অর্থনৈতিক কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন- আয়তাকার ঘর এবং চুলার জায়গার অবশিষ্টাংশ। এছাড়া নৃতাত্ত্বিক পাথর, বিভিন্ন অস্ত্রের অংশ যেমন- তীরের মাথা, কাস্তে, ব্লেড এবং কুড়াল পাওয়া গেছে।
কুয়া
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসাবে একটি কুয়া পাওয়া গেছে। এটি বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০.৫ মিটার (৩৫ ফুট) নিচে রয়েছে। শুষ্ক-পাথরের দেয়াল দিয়ে নির্মিত কুয়াটির ব্যাস ১.৫ মিটার (৫ ফুট) এবং গভীরতা ৫.৫ মিটার (২০ ফুট)। এটিতে বিশেষ ধরনের চকমকি পাথর, মাটির পাথর এবং দুটি পৃথক স্তরে সাজানো প্রাণির হাড় পাওয়া গেছে।
স্থানটিতে পাওয়া অন্যান্য বৃত্তাকার কাঠামোও কুয়া হতে পারে। এগুলো সম্ভবত প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ৯ম সহস্রাব্দের শেষের দিকে খনন এবং নির্মাণ করা হয়েছিল। গ্যালিলির ধারণা, কুয়ার পানি ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানিতে দূষিত হয়ে গেলে, বাসিন্দারা তাদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
মেগালিথ
মেগালিথ হলো, প্রাগৈতিহাসিক যুগে পাওয়া বৃহৎ পাথরখণ্ড, যা স্থাপত্যশিল্পে বিশেষ করে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। একটি ঝর্ণার চারপাশে সাজানো সাতটি ৬০০ কেজি (১৩০০ পাউন্ড) মেগালিথ সমন্বিত পাথরের অর্ধবৃত্তাকার একটি নিদর্শন পাওয়া গেছে। পাথরগুলোতে কাপের চিহ্ন খোদাই করা আছে।
পশ্চিমে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের কাছাকাছি, কয়েকটি সমতল পাথরের স্ল্যাব (০.৭-১.২ মিটার লম্বা) ভূমির উপর পাওয়া গেছে। যা থেকে ধারণা করা হয়, সেগুলো পানি সংক্রান্ত কোনো বিশেষ প্রথার জন্য ব্যবহার করা হতো। আরেকটি স্থাপনায় তিনটি ডিম্বাকৃতি পাথর (১.৬-১.৮ মিটার) রয়েছে, যা দুটি খাঁজ দিয়ে ঘেরা নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন তৈরি করেছে।
সমাধি
ঘরের ভেতরে এবং আশেপাশে দশটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। ২০০৮ সালে একটি নারী এবং শিশুর কঙ্কাল পাওয়া যায়। এটি যক্ষ্মা রোগের প্রথমদিকের ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ৪ অক্টোবর, ১০ মিটার পানির নিচে একটি সম্পূর্ণ মানব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় এবং কার্বন ডেটিংয়ে এর বয়স ৮০০০ +-২০০ বছর।
পুরুষরা সামুদ্রিক খাবার সংগ্রহের জন্য সমুদ্রে যেতো বলে মনে করা হয়। কারণ চারটি কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যাদের সম্ভবত ঠান্ডা পানিতে ডুব দেওয়ার কারণে কানের ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৬৫টি কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
মাছ
মাছের হাড়ের তৈরি হুক এবং ব্যবসা বা সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত মাছের হাড়ের স্তূপ দেখে তাদের জীবনব্যবস্থায় সামুদ্রিক সম্পদের গুরুত্ব বোঝা যায়। মাছের অবশিষ্টাংশের মধ্যে রয়েছে ৬০০০টিরও বেশি হাড়। তাদের বেশিরভাগই ব্যালিস্টেস ক্যারোলিনেসিস (ধূসর ট্রিগার মাছ) এবং কয়েকটি সিরানিডাই (Serranidae), স্পারিডাই (Sparidae) ইত্যাদি এবং অন্যান্য মৎস্য পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
প্রাণি
বন্য প্রজাতির প্রাণির হাড় পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও আছে, গৃহপালিত ভেড়া, ছাগল, শূকর, কুকুর এবং গৃহপালিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা গবাদি পশু।
গাছপালা
উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশের মধ্যে রয়েছে বন্য আঙ্গুর, পোস্ত এবং কেওড়ার বীজ। বিশেষ প্রজাতির গুবরে পোকার উপস্থিতি, সঞ্চিত শস্য যেমন- গম, বার্লি, মসুর ডাল ইত্যাদির উপস্থিতি নির্দেশ করে। পরাগ বিশ্লেষণ এবং জলজ উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ দেখে বুঝা যায়, আতলিত ইয়ামে জলাভূমিও ছিল।
নিমজ্জিত হওয়ার কারণ
যদিও প্রাথমিক গবেষণায় সুনামিকেই আতলিত ইয়ামের ধবংসের কারণ হিসাবে বলা হয়। কিন্তু গ্যালিলি বলেছেন, এই সিদ্ধান্তে খুব কম সময়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এবং অন্যান্য গবেষকরা বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্সে’ বলেছেন যে, সুনামির কারণে গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়নি।
তার মতে, ভূমধ্যসাগরে কোনো সুনামি ঘটেনি তা স্পষ্টভাবে বলা অসম্ভব। তবে তিনি যুক্তি দিয়েছেন, আতলিত ইয়ামে সুনামির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলি গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, সমাধিস্থ বেশিরভাগ লোক অসুস্থতার কারণে মারা গেছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়।
তাহলে বন্যার কারণ কী? তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রায় ৮০০০ বছর আগে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে হিমবাহ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিল। গ্যালিলির মতে, ভূমধ্যসাগরের স্তর ধীরে ধীরে বৃদ্ধির কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। যার ফলে গ্রামটি ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আতলিত ইয়াম নিমজ্জিত হওয়ার কারণ সুনিশ্চিতভাবে জানতে, হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে, মিশ্র জীবিকা ব্যবস্থার চমৎকার এমন উদাহারণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়া একেকটি সভ্যতা, একেকটি সময়ের গল্প বলে। কিছু ক্ষেত্রে সময়ের সাথে কিছু রহস্যও নিজেদের সাথেই নিয়ে যায়। আতলিত ইয়ামের হারিয়ে যাওয়ার রহস্যও হয়তো, তেমনই এক রহস্য হয়ে থাকবে।
Featured Image: bitLanders References: 01. Israelandyou.com/Atlit-Yam. 02. Newscientist.com/Atlit-Yam-Israel. 03. Antiquities.org. 04. Tsunami-Or-Melting-Glaciers-What-Caused-Ancient-Atlit-To-Sink.