১৮৬০ সালের দিকে জার্মানীতে অদ্ভুত এক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যায়। যা নিয়ে গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, জীবাশ্মটা ছিল কিছুটা ডায়নোসর আর কিছুটা পাখির মতোর দেখতে এক অদ্ভুত প্রাণীর! হ্যাঁ, এভাবেই পৃথিবীর মানুষ প্রথমবারের মতো খুঁজে পেয়েছিল প্রাচীন এক পাখি আর্কিওপটেরিক্সের জীবাশ্ম। ধারণা করা হয়, এই পাখিটির অস্তিত্ব প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বছর পুরনো। জীববিজ্ঞানীদের অধিকাংশের মতে, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি। আমাদের আজকের আয়োজন এই পাখিকে নিয়েই।
গ্রীক শব্দ আর্কিওপটেরিক্সের অর্থ হলো ‘পুরনো ডানা’। প্রাচীন সুমেরিয়ান কিংবদন্তীতে অনুসারে, দেবতা মারদুক দেবী তিয়ামাতকে হত্যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টির সূচনা করেন। আর তিয়ামাতের শরীরের খন্ডিত অংশ থেকে জন্ম নিয়েছিল এক অদ্ভুত পাখি। যে পাখির ডানা দিয়ে স্বর্গের আলো প্রজ্জ্বলিত হতো। প্রাচীন সুমেরিয়রা এই প্রাণীকে ডাকতো আর্কপুত বলে; যার অর্থ স্বর্গের পাখির ডানা। সেখান থেকেই গ্রীক শব্দ আর্কিওপটেরিক্স এর উৎপত্তি।
বিজ্ঞানীরা সেই জীবাশ্মটি পরীক্ষা করা শুরু করলে দেখা গেলো যে, ওটা আসলে দোপেয়ে প্রাণী এবং হেঁটে চলা মাংশাসী ডায়নোসরদের মতোই ছিল ওগুলোর চালচলন। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা গেল, যা এর আগে কোনো ডায়নোসরের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। আর তা হলো পালক! প্রাণীটির দুটো ডানাতেই ছিল পাখির মতো পালক। এখান থেকেই এর নামকরণ করা হয় আর্কিওপটেরিক্স। কারণ পৃথিবীর প্রথম জীবাশ্ম যেখানে পালক পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের ভাষায়,
পৃথিবীর প্রাচীনতম ডানার অধিকারী এক প্রাণী।
এই পাখি আকারে বর্তমান সময়ের কাকের চাইতে একটু বড় ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি পুরোপুরি উড়তে পারতো না। তবে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে যাতায়াত করতো। ডানার সামনের দিকটা অনেকটাই দেখতে ছিল মানুষের হাতের মতো। তবে সেখানে থাকতো ধারালো নখ। আর পা দুটোও এরকমই ছিল। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, বর্তমান সময়ের পাখিদের সাথে ওটার কোনো মিলই নেই আসলে।
হাত আর পা দিয়ে ডাল আঁকড়ে ধরে গাছে উঠে যেতো পাখিটা। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে শিকার ধরতো এই গাছ থেকে ওই গাছে। কিন্তু সত্যিই কি আর্কিওপটেরিক্স পাখি ছিল? নাকি ওটা ছিল ডায়নোসরের একটা জাত? বিজ্ঞানীদের আরেকটি দলের মতে, আর্কিওপটেরিক্স আসলে বিবর্তিত এক প্রকার বিশেষ ডায়নোসর। যা আকারে ছিল খুবই ছোট। বেশ হালকাও ছিল এগুলোর শরীর। ১৮ আউন্সের বেশী কখনোই ওজন হতো না।
ছোট ছোট পোকামাকড় ছিল আর্কিওপটেরিক্সের প্রিয় খাদ্য। তবে মৃত ডায়নোসরদের শরীর থেকে মাংস খুবলেও খেতো এই পাখিগুলো। যদিও আকাশে উড়তে পারা ডায়নোসরের জাতদের এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করতো এরা। ২০০১ সালে একদল ওলন্দাজ বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে, বেশীরভাগ আর্কিওপটেরিক্সের পালকের রঙই দাঁড়কাকের মতো কালো হতো। এজন্য আর্কিওপটেরিক্সকে ‘র্যাভেন অফ দ্য ডায়নোসর এরা’ উপাধি দেওয়া হয়।
২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের একদল জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী গবেষণা করে প্রমাণ করে যে, আর্কিওপটেরিক্সের পালকগুলো বর্তমান যুগের পাখিদের চাইতে অনেক বেশী নরম ছিল। তাদের মতে, আর্কিওপটেরিক্স মাটি থেকে সর্বোচ্চ এক ফুট ওপরে উঠতে পারতো। এদের ব্যাপারে আর তেমন কিছু জানা যায়নি। শুধু এটুকু বলা যায় যে, এরা বিবর্তিত হয়ে নতুন কোনো প্রজাতিতে পরিণত হয়নি; বরং ১৫০ মিলিয়ন বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই প্রাণীটি। কিন্তু কেন?
সম্ভবত একটা সময়ে, ক্রমাগত আকাশচর ডায়নোসরদের খাদ্যে পরিণত হতে থাকে এরা। ডায়নোসরদের সময়ে টিকে থাকা ক্রমাগতই কঠিন হয়ে যেতে থাকে এদের জন্য। এজন্যই সম্ভবত এদের বিলুপ্তি ঘটে। তবে এটা শুধুই একটা ধারণা। প্রতিষ্ঠিত কোনো মতবাদ নয়। আবার সুমেরিয়ান কিংবদন্তীতে ফিরে যাই। সেখানে আর্কপুতকে বলা হয়েছে স্বর্গের চিহ্ন আর দেবতা পাজুজুর প্রতীক। পাজুজুর প্রতীক তাকে কেন বলা হয় এই বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়।
সুমেরিয়ান কিংবদন্তীতে পাজুজু বাতাস আর রোগব্যধির এক অশুভ দেবতা। প্রচন্ড রাগী তিনি। কোনোরকম অবাধ্যতা মোটেই সহ্য করতে পারেন না। ব্যাবিলনে প্রাচীনকালে অনেকগুলো পাজুজুর মূর্তি ছিল। অসুখ থেকে বেঁচে থাকার জন্য লোকেরা এই দেবতার আধারনা করতো। পাজুজু পূজার বিশেষত্ব হল, এই দেবতার পূজা কখনো বন্ধ হতো না। একদল পূজারী পূজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আরেকদল ঢুকে পড়তো। পূজাতে আগুন জ্বালিয়ে তাতে পশু-পাখি উৎসর্গ করা হতো। পাজুজুর মন্দিরগুলো থাকতো সবসময় ধোঁয়া আর পোড়া মাংসের গন্ধে পরিপূর্ণ।
কিন্তু আর্কপুতকে কেন পাজুজুর প্রতীক বলা হতো? এই রহস্য এখনো কেউ বের করতে পারেনি। আর দিনের শেষে আর্কিওপটেরিক্সই যে আর্কপুত, এমনটাও কিন্তু নয়। কারণ মানুষ পৃথিবীতে আসার বহু আগেই আর্কিওপটেরিক্স বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু মানুষ এখনো মনে করে যে, সুমেরিয়ান কিংবদন্তীর আর্কপুতই আসলে আর্কিওপটেরিক্স।
১৯৭৬ সালে স্পেনের একটি প্রাচীন গুহার দেয়ালে আর্কিওপটেরিক্সের মতো একটি পাখির ছবি আবিষ্কার করে একদল অভিযাত্রী। পরে বিশেষজ্ঞরা গিয়ে নিশ্চিত করে যে, ছবিটি আসলেই আর্কিওপটেরিক্সেরই। তারা জানান যে, ওগুলো গুহামানবদের আঁকা। কিন্তু গুহামানবরা ওটা আঁকলো কী করে? কারণ মানুষ পৃথিবীতে আসার বহু আগেই তো এই পাখি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
তাহলে কি হিসাব ভুল? নাকি আর্কিওপটেরিক্সের মতো অন্য কোনো পাখি টিকে ছিল পৃথিবীর বুকে দীর্ঘকাল? এইসব রহস্যের সমাধান এখনো হয়নি। ভবিষ্যতে হবে হয়তো।
২০০৫ সালে আমেরিকার ডেনভার শহরের মিডল স্কুলের ছাত্র টেরির সাথে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। স্কুল থেকে ফেরার সময় নিখোঁজ হয় সে। চিন্তাতে প্রায় পাগল হয়ে যান ওর মা-বাবা। পুলিশের কাছে যান তারা। সারাটা দিন অক্লান্তভাবে টেরিকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না তার।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রাত দশটার দিকে হুট করে বাড়ি ফিরে আসে টেরি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান ওর মা-বাবা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসে এবং টেরিকে তারা প্রশ্ন করে, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে?” টেরি উত্তর দেয়, “স্কুল থেকে বেরিয়ে পাশের পরিত্যক্ত পার্কটায় গিয়েছিলাম। তখনই আকাশ থেকে বিরাট একটা পাখি এসে আমাকে তুলে নিয়ে যায়, সারাটা দিন পিঠে বসিয়ে নিয়ে আমাকে আকাশে ঘুরিয়েছে। একটু আগে ওই আমাকে বাড়িতে রেখে গেলো!”
ওর কথা শুনে অবাক হন পুলিশ অফিসার। তিনি হেসে উড়িয়ে দিতে চান সব কিছু, কিন্তু টেরি সাথে সাথে কাগজ কলম নিয়ে পাখিটার ছবি আঁকতে বসে যায়। ছবি আঁকা হয়ে যাওয়ার পর সে ওই ছবিটা অফিসারকে দেয়। অফিসার তখনই স্থানীয় হাইস্কুলের জীববিজ্ঞান শিক্ষকের সাথে দেখা করে ছবিটা তাঁকে দেখান। সেই শিক্ষক বলেন ছবিটা আর্কিওপটেরিক্সের, যা হাজার বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় পাখিটা আকারে অনেক ছোট হতো, টেরি যেমন বলেছে অতো বড় আকার ছিল না ওটার।
ধীরে ধীরে কথাটা পুরো শহরে ছড়িয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় খবরের কাগজেও চলে আসে সবকিছু। এমনকি আমেরিকার জাতীয় কতগুলো খবরের কাগজেও ব্যাপারটা এসেছিল। টিভি চ্যালেনগুলোতেও প্রচারিত হয়েছিল অদ্ভুত এই খবর। ওই সপ্তাহের শেষের দিকে একদল বিশেষজ্ঞ টেরি আর তার মা-বাবার সাথে দেখা করেন এবং তাদেরকে নিউইয়র্কে নিয়ে যান।
তিনদিন পর ফিরে আসে তারা। আসার পর টেরি বা তার মা-বাবা কেউই আর এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলেনি। এমনকি খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো থেকেও খবরটা সরিয়ে দেওয়া হয়। ইউটিউবে ২০১৬ সালে হুট করেই একজন ইউটিউবার তার চ্যানেলে টেরিকে নিয়ে বানানো একটা ছোট্ট ডকুমেন্টারি আপলোড দেন, যেটা ২০০৫ সালেই নির্মিত হয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় কথিত আছে, এফবিআইয়ের লোকেরা ওই ইউটিউবারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
এখন অনেকেই বলে যে টেরি মিথ্যা বলেছিল সেদিন। কিন্তু সে যদি মিথ্যা বলে থাকে তাহলে সেই খবরগুলোকে কেন লুকিয়ে ফেলা হলো? কেন এতো গোপনীয়তা? সেদিন কোথায় ছিল টেরি? এখনো কি আর্কিওপটেরিক্স বেঁচে আছে? আমাদেরকে কি ভুল শেখানো হয়েছে? হয়তো পাখিটা আকারে অনেক বড়!
এই নিয়ে প্রচুর কন্সপিরেসি থিওরি আছে যেগুলো বলতে শুরু করলে আর শেষ হবে না। যাইহোক, এখন পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে প্রায় আট জায়গাতে আর্কিওপটেরিক্সের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। জার্মানী, স্পেন আর ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে সেগুলো। এবং অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি যে এসেছিল বর্তমান সময়ের পাখিরা আসার অনেককাল আগেই!
Feature Image: spl/bbc.com
তথ্যসূত্র-