আদতে অ্যালোভেরার বাংলা নাম, ঘৃতকুমারী হলেও জনসাধারণের কাছে এটি বহুলভাবে অ্যালোভেরা নামেই পরিচিত ও প্রচলিত। কখনো রাস্তার পাশে তৃষ্ণার্ত নিবারণের উপাদান অথবা রূপচর্চার ঘরোয়া টোটকা হিসেবে বেশিরভাগ সময়ে এটি জনসাধারণের কাছে সমাদৃত।
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী উদ্ভিদটি শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে তার স্বাস্থ্যকর গুণাবলি, সৌন্দর্য চর্চার উপাদান, ঔষধি গুণ, ও ত্বকের পরিচর্যার এক অনন্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
ইংরেজি অ্যালোভেরা নামটি আরবি শব্দ Alloeh অর্থ চকচকে পদার্থ। সেখানে Vera শব্দটির ল্যাটিন অর্থ সত্য। দুই হাজার বছর আগে গ্রিক বিজ্ঞানীরা এই ঘৃতকুমারীকে সর্ব রোগের ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন।
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী উদ্ভিদটি আরব উপদ্বীপের স্থানীয় হলেও এটি বর্তমানে সারাবিশ্বে জন্মায়। গুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদটির এর প্রশান্তিদায়ক জেলের জন্যই হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ চাষ করে আসছে। ঘৃতকুমারী মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতে যেমন-নিউ মেক্সিকো, টেক্সাসের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী এলাকা, অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া এসব এলাকাগুলোতে চাষ হয়।
প্রায় ৬২ ধরনের ঘৃতকুমারীর প্রায় ৪২০টি প্রজাতি আছে, যার মধ্যে চারটি প্রজাতি তাদের স্বাস্থ্যকর গুণাবলির জন্য উৎপাদন করা হয়। Aloe Vera Barbadensis সবচেয়ে প্রচলিত ও চাষযোগ্য প্রজাতি, এবং এটি উত্তর আফ্রিকার স্থানীয়।
Aloidendron barberae অ্যালোভেরার সবচেয়ে বড় প্রজাতি (প্রায় ৩৬ ইঞ্চি), যেটি আফ্রিকাতে জন্মায়। আর Aloe Descoingsii অ্যালো পরিবারের সবচেয়ে ছোট প্রজাতি (২-৩ ইঞ্চি হয়ে থাকে)। বন্য প্রজাতির অ্যালোভেরা প্রায় শতাব্দী ধরে বেঁচে থাকতে পারে।
ঘৃতকুমারী গাছটির বাহিরের অংশকে আমরা তিনটি অংশকে বিভক্ত করা যায়। পাতা, অ্যালো-রিন্ড ও অ্যালোভেরা থর্নস বা এর গায়ের কাঁটা। এবং এর ভেতরে আছে অ্যালোভেরার জেল, যেটিতে ৯৬ শতাংশ পানি থাকে ও আরেকটি ল্যাটেক্স বা তরুক্ষীর।
এই তরুক্ষীর কখনো জোলাপ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কথিত আছে যে, রূপের রাণী ক্লিওপেট্রা তার রূপচর্চার অন্যতম উপাদান হিসেবে এই অ্যালোভেরার জেল ব্যবহার করতেন। ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা ব্যাক্টেরিয়া নিরোধী ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ একটি জনপ্রিয় ভেষজ উদ্ভিদ।
এটি দাঁতের ক্ষয়রোধ, ত্বকের বলিরেখা দূর, রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণসহ দ্রুত ঘা শুকানো ত্বরান্বিত করে। এছাড়াও অ্যালোভেরার জুসে প্রোটিয়োলাইটিক নামক পদার্থ আছে, যা মাথার ত্বকের খুঁশকি কমাতে, চুলের দৈর্ঘ্য বাড়াতে ও ইনফেকশন রোধে খুবই কার্যকরী। চুল নরম হওয়ার জন্যও কাজে দেয় এই উপাদানটি।
যারা বাড়তি ওজন নিয়ে খুবই চিন্তায় আছেন,তারা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারেন অ্যালোভেরা জুসের সাথে বরফ, মধু ও লেবু মিশ্রিত পানীয়। কারণ এতে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, এনজাইম ও স্টেরল থাকে। যা আপনার ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে।
ঘৃতকুমারীর Aloe barbadensis প্রজাতিটি ত্বকের যেকোন আঘাত এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। প্রসাধনযোগ্য পণ্য হিসেবে ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান এবং খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত এর জেলে উপকারী জৈবযৌগ বিদ্যমান যা ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামিনো এসিডসহ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ।
অ্যালোভেরা ডায়েবেটিক ফুট আলসারের জন্য ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় অধ্যয়ন করা হয়েছে। কিন্তু অ্যালোভেরা এই অবস্থার জন্য সহায়ক কিনা তা দেখানোর জন্য যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। ২০০৯ সালে একটি পর্যালোচনা থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বিভিন্ন ত্বকের অবস্থার জন্য অ্যালোর ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা অন্বেষণ করার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
একটি ছোট ইউরোপীয় গবেষণায়, আলসারেটিভ কোলাইটিসসহ ৪৪ জন প্রাপ্ত বয়ষ্ককে এক মাসের জন্য প্রতিদিন দুবার এই অ্যালোভেরা জেল গ্রহনের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। অ্যালোভেরার সাথে চিকিৎসা করা প্রায় অর্ধেক লোক চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিল, যেখানে ১৪ শতাংশ অ্যালোভেরা জেল থেকে প্রাপ্ত প্লাসিবো দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিল।
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী ব্যাক্টেরিয়া নিরোধক, ভাইরাস নিরোধক এবং অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে পরিচিত। এটি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ও ক্ষত সারাবার জন্য অনন্য এক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবেষকরা বলছেন, দাঁতের ক্ষত, মাড়ির বিভিন্ন সমস্যার জন্য অ্যালোভেরার জুস খুবই কার্যকরী।
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী প্রায় সময়ই ক্ষতস্থান সারানোর জন্য সাময়িক ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে শরীরের পুড়ে যাওয়া স্থানে, রোদে পোড়া শরীরের জন্য বহুকাল ধরে ঘৃতকুমারীর ব্যবহার সর্বজনস্বীকৃত।
গবেষনা বলছে, ঘৃতকুমারী লালচে ভাব, চুলকানি এবং সংক্রমন রোধেও কার্যকরী। প্রাকৃতিক জোলাপ হিসেবে অ্যালোভেরার কোন তুলনা নেই। কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে অ্যালোভেরা জেল কার্যকরী, তবে, সেটি গ্রহন করতে হবে পরিমানমতো।
বিভিন্ন স্টাডি বলছে ঘৃতকুমারী থেকে প্রাপ্ত জেল, বিভিন্ন শাক-সবজি, ফলমূলকে রাখে কীট-পতঙ্গ মুক্ত। যার জন্য ক্ষতিকারক কীটনাশকেরও ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
তবে এত উপকারিতা থাকা স্বত্ত্বেও ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। এই উদ্ভিদটি কখনো কখনো পেটের ব্যথা, ডায়রিয়া এসবের কারন হতে পারে। যদি কেউ অন্য কোন ঔষধ গ্রহন করতে থাকে, তবে অ্যালোভেরার কোন উপাদান না গ্রহন করাই ভালো। কারণ এটি শরীরে ঔষধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
এছাড়াও, অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী ত্বকের জন্য ভালো হলেও কখনো কখনো এটি নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যেমন ত্বকে চুলকানি সৃষ্টি করাসহ আরও অনেক জটিলতার জন্ম দেয়। যেমন বলা হচ্ছে, অ্যালো জেলের ট্রপিক্যাল ব্যবহার সাধারন মাত্রায় সহনীয়।
কিন্তু ঘৃতকুমারী জেলের সাময়িক ব্যবহারে জ্বলন, চুলকানি, এ্যাকজিমার তথ্য পাওয়া গেছে। এই ঘৃতকুমারীর পাতার নির্যাস হেপাটাইটিসের সাথে সম্পর্কিত। অ্যালো ল্যাটেক্সের অত্যাধিক ব্যবহার হৃদরোগের কারণও হতে পারে। কিছু কিছু নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ঘৃতকুমারী উদ্ভিদটি একটি কার্যকরী উদ্ভিদ। নিয়ম মাফিক ও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করলে ফলাফল আশানুরূপ হবে।
Feature Image: glam.com References: 01. 7 Amazing Uses for Aloe Vera. 02. Aloe Vera. 03. What are the benefits of aloe vera?