সামুরাই: নির্ভীক যোদ্ধার প্রতীক

791
0

সামুরাই নামটা শুনেই মনের ভেতর আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুদক্ষ তলোয়ার বাজ এক সৈন্যের প্রতিচ্ছবি। আর হবেই বা না কেন, সামুরাই এক্স, সেভেন সামুরাই, দ্য ল্যাস্ট সামুরাই-এসব এনাইম আর মুভি তো কম জনপ্রিয় নয়। সামুরাইদের আসল পরিচয় তারা মূলত জাপানের শিল্প বিপ্লবের আগের যুগের জাপানি যোদ্ধা বা সামরিক বাহিনীর সদস্য। 

জাপানি ক্রিয়াবাচক শব্দ ‘সাবুরাই’ থেকে ‘সামুরাই’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ ‘কাউকে সেবা করা’। এর অন্য নাম ও আছে, যেটা হলো ‘বুশি’। তবে বিখ্যাত অনুবাদক সাহিত্যিক উইলিয়াম স্কট উইলসনের মতে, ১০ম শতকে জাপানী কবিতার প্রাথমিক সংকলন গ্রন্থ ‘কোকিন ওয়াকাশু’ (৯০৫-৯১৪)-তে প্রাচীন ও আধুনিককালের সংমিশ্রণের গড়া জাপানী কবিতায় ‘সামুরাই’ শব্দটির প্রথম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।  

সামুরাইদের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য: 

বিশ্বস্ততা: সামুরাইরা তাদের নিজস্ব একটা সত্ত্বা তৈরি করতে পেরেছে মনিবের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততার জন্য। তাদের পাহাড়সম অটল, দৃঢ়চেতা চারিত্রিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ গুণের কল্যানেই একটা সময় শুধুমাত্র ‘সেবা প্রদান’ বা জমিদারদের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব থেকে পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী এমনকি রাজ্য চালানোর ক্ষমতা লাভ করে। যেমনটি তারা ৯০০ শতকের দিকে রাজা হেইয়ানের সময়ে করেছিল।   

নিজস্ব জীবনবোধ: সামুরাইদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি যা তারা মনেপ্রাণে লালন এবং পালন করে। ‘কনসেপ্ট অফ বুশুদো’ হলো এমন এক দর্শন, যার মূল ভাবার্থ হচ্ছে ‘মৃত্যু ভয় থেকে মুক্তি লাভ’। মূলত মৃত্যু ভয় থেকেও যে সম্মান বড় এই মূলমন্ত্রই তারা বিশ্বাস করে থাকে। এমনকি যেকোনো ব্যক্তি যদি তাদের প্রাপ্য সম্মান না দেখায়, তাকে হত্যা করার ক্ষমতা সামুরাইদের দেওয়া হয়েছিল।  

সামুরাইদের রয়েছে নিজস্ব জীবনধারা। Image Source: pinterest.com

ব্যবহার্য অস্ত্র: প্রথম দিকের সামুরাইরা ছিল তীরন্দাজ, পায়ে বা ঘোড়ার পিঠে অত্যন্ত লম্বা ধনুক (ইউমি) নিয়ে যুদ্ধ করতো। তবে আহত শত্রুদের শেষ করার জন্য তলোয়ার ব্যবহার করতো। ১২৭২ এবং ১২৮১ সালের মোঙ্গল আক্রমণের পর, সামুরাইরা তলোয়ার, নাগিনাটা নামক অস্ত্র যা কিনা বাঁকা ব্লেড দ্বারা তৈরি শীর্ষে থাকা খুঁটি মতন এক ধরনের অস্ত্র এবং বর্শা ব্যবহার করতে শুরু করে। 

সামুরাই যোদ্ধারা দুটি তলোয়ার ব্যবহার করতো, কাতানা এবং ওয়াকিজাশি। এটি অবশ্য, ১৬ শতকের শেষের দিকে সামুরাই ব্যতীত অন্যদের এই অস্ত্র ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। 

আত্মগৌরব: যুদ্ধ করতে করতে বিজয় অথবা মৃত্যুই যেন ছিল তাদের জীবনের একমাত্র সার্থকতা। যুদ্ধে হেরে যাওয়া, পরাজিত হওয়া, আহত হওয়ার মতো কোনো ঘটনারই গ্রহনযোগ্যতা ছিল না সামুরাইদের কাছে। এই কারনে তৈরি হয়েছিল ‘সেপ্পুকু’ নীতিরও। যেকোনো সামুরাই লড়াই করতে করতে যদি বুঝতে পারে, এই লড়াইয়ে তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম তাহলে নিজ তলোয়ার বা ছুরি দিয়ে পেট কেটে আত্মহত্যা করে। এ যেন ‘পরাজয়’ বরণ করার চেয়েও সহজতর কাজ তাদের কাছে।  

পরাজয় নামক কোনো শব্দ মানতে নারাজ সামুরাইরা। Image Source: milwaukeeindependent.com

জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত সামুরাই মূলত এর দুটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামন্ততান্ত্রিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছিল: জেনপেই যুদ্ধ (১১৮০-১১৮৫) এবং পরবর্তীতে যুদ্ধরত রাষ্ট্রের সময়কালের শেষ বছরগুলিতে (১৪৬৭-১৫৯০)। শুরুতে যুদ্ধ কামাকুরা শোগুনেট (১১৮৫-১৩৩৩) তৈরি করলেও; দ্বন্দ্বের শেষ হয়েছিল টোকুগাওয়া শোগুনাত-এর সময়কালে। উনি মূলত ১৬০৩ থেকে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত জাপান শাসন করেছিলেন। বিখ্যাত সব সামুরাইদের মাঝে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে- 

টোমোয়ো গোজেন 

টোমো গোজেন (১১৫৭-১২৪৭) ছিলেন একজন ওনা-বুগেইশা (女武芸者, মহিলা মার্শাল আর্টিস্ট) যিনি গেনপেই যুদ্ধের (১১৮০-১১৮৫) সময় মিনামোতো নো ইয়োশিনাকার হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ইডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) সামুরাই একটি আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক যোদ্ধা হয়ে ওঠার আগে, নারীদেরকে নাগিনাটা বর্শা এবং কাইকেন ড্যাগার ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল পুরুষ যোদ্ধাকে সাথে নিয়ে সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য।  

প্রচলিত আছে, কিংবদন্তী সম্রাজ্ঞী জিঙ্গু তার সম্রাট-স্বামী যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর ২০০ সালে কোরিয়া আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টোমোয়ো গোজেন। এছাড়া, জেনপেই যুদ্ধে যা শক্তিশালী মিনামোটো (গেঞ্জি) এবং টাইরা (হাইকে) গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে টোমোর অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল, ১০০০ অশ্বারোহীকে নেতৃত্ব দেওয়া, ৬০০০  এর বিরুদ্ধে ৩০০ জনের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া এবং ডাকটিকিটের মতো বিরোধীদের মাথা সংগ্রহ করার মতন বীরত্বপূর্ণ এবং সাহসী কাজ তিনি করেছিলেন। 

টোমোয়ো গোজেন। Image Source: pinterest.com

দ্য টেল অফ দ্য হেইকে অন্তত ১৩০৯ সালে সংকলিত সংঘাত সম্পর্কে একটি মহাকাব্য, এটি লেখা হয়েছে যে টোমোয়ের সৌন্দর্যের পাশাপাশি, ‘তিনি একজন অসাধারণ শক্তিশালী তীরন্দাজ এবং একজন তরোয়াল-নারী হিসাবেও ছিলেন তিনি এক হাজার মূল্যের একজন যোদ্ধা ছিলেন, একটি দানব বা দেবতাকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুতমাউন্ট বা পায়ে।’ 

কুসুনোকি মাসাশিগে 

কুসুনোকি মাসাশিগে (১২৯৪-১৩৩৬) একজন সামরিক কৌশলবিদ হিসাবে এবং তার বিশ্বস্ততা উভয়ের জন্য বিখ্যাত। ১৩৩১ সালে, তিনি সম্রাট গো-দাইগো (১২৮৮-১৩৩৯) এর সামরিক দলে যোগদান করেন কামাকুরা শোগুনেট থেকে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য।  

কুসুনোকির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় ১৩৩২ সালে এসেছিল, যখন তিনি মাত্র ২০০০ জন সৈন্য নিয়ে শোগুনেটের ১০,০০০ জন সেনার বিরুদ্ধে ওসাকার দক্ষিণে অবস্থিত চিহায়া দুর্গকে রক্ষা করেছিলেন। 

কুসুনোকি মাসাশিগে। Image Source: pinterest.com

যুদ্ধ জয়ের পর কানসাই এলাকার বেশ কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ কুসুনোকিকে দেওয়া হয়। তবে, কেনমু পুনরুদ্ধার স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। কারণ আশিকাগা গোষ্ঠী কুসুনোকির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তিনি এখনও সম্রাটের প্রতি অনুগত্য ও ভক্তির প্রতীক, এবং টোকিওর ইম্পেরিয়াল প্যালেসের বাইরে তার একটি মূর্তি আছে।

ইয়াসুকে 

ইয়াসুকে ছিলেন একজন আফ্রিকান দাস যাকে ১৫৭৯ সালে জেসুইট ধর্মপ্রচারক আলেসান্দ্রো ভ্যালিগনানো জাপানে নিয়ে আসেন। জাপানে কেউ এর আগে একজন কালো ব্যক্তিকে দেখেনি, তাই তার উপস্থিতি বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। তার সুগঠিত শরীর আর রং দেখে সবাই এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে তাকে জনসম্মুখে ডাকা হয়। তার কোমরের অংশে ছুরি দিয়ে কেটে এবং শরীরের চামড়া ঘষে দেখা হয় যে আসলেই তিনি কোনো রঙ মেখেছেন কিনা।

নোবুনাগা ইয়াসুকের শক্তি এবং আকার দ্বারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন-যা প্রায় ১৮৮ সেন্টিমিটার (৬ ফুট ২ ইঞ্চি) লম্বা হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছিল-যে তিনি তাকে তার ব্যক্তিগত রক্ষক এবং দেহরক্ষী বানিয়েছিলেন। ১৫৮১ সালে, ইয়াসুকে সামুরাই পদে উন্নীত করা হয় এবং রাজপ্রাসাদে থাকা শুরু করলেন। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে তিনি যুদ্ধবাজের সাথে পরিচিতি হওয়া থেকে শুরু করে এমনকি তাদের সাথে ভোজনও করতে শুরু করেন। এছাড়া রাজার ব্যক্তিগত তলোয়ার বহনকারী হিসাবে কাজটাও করেন। 

ইয়াসুকের মূর্তি। Image Source: pinterest.com

ইয়াসুকের জন্ম কোথায় হয়েছিল তা কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, যদিও ধারণা করা হয়েছে যে তিনি মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা বা ইথিওপিয়া থেকে আসতে পারেন অথবা সম্ভবত পর্তুগাল থেকে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত ক্রীতদাস। তার আসল নামও অজানা, যদিও ইয়াসুকে নিজেকে জাপানিজদের সমতুল্যই বলে মনে করতেন।

মিনামোটো নো ইয়োশিটসুনে 

মিনামোটো নো ইয়োশিটসুনে (১১৫৯-১১৮৯) মিনামোটো (গেঞ্জি) এবং টাইরা (হাইকে) গোষ্ঠীর মধ্যে গেনপেই যুদ্ধের (১১৮০-১১৮৪) সময় একজন নেতা ছিলেন। শৈশবে, ১১৬০ সালের হেইজি বিদ্রোহে ইয়োশিটসুনের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য নিহত হয়েছিল এব্বং তার সৎ ভাই ইয়োরিটোমোকে ইজু উপদ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। আর ইয়োশিটসুনকে কিয়োটোর উত্তরে পাহাড়ে কুরামা মন্দিরের সন্ন্যাসীদের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। 

১১৭৪ সালে তিনি হিরাইজুমিতে স্থানান্তরিত হন যা তখনকার সময়ে মুতসু প্রদেশ ছিল। তবে বর্তমানে এটি এখন উত্তর জাপানের তোহোকু অঞ্চলের পূর্ব অর্ধেক নিয়ে গঠিত। অবাক করার মতো বিষয় হলো বছরের পর বছর ধরে, শক্তিশালী উত্তর ফুজিওয়ারা গোষ্ঠীর প্রধান ফুজিওয়ারা নো হিদেহিরা দ্বারা ইয়োশিটসুন সুরক্ষিত ছিল। 

মিনামোটো নো ইয়োশিটসুনে। Image Source: pinterest.com

১১৮০ সালে ইয়োশিটসুনে ইয়োরিটোমোতে যোগদান করেন যখন তাইরা গোষ্ঠীর সাথে লড়াই করার জন্য একটি সৈন্যদল গঠিত করা হয় সরকারিভাবে। ইয়োশিটসুন তার গোষ্ঠীকে একের পর এক বিজয়ের দিকে নিয়ে যান, যা ড্যান-নো-উরার যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয়।

পরবর্তীতে যুদ্ধে জয়লাভের পর ইয়োরিটোমো ‘কামাকুরা শোগুনেট’ প্রতিষ্ঠা করেন। দিনকে দিন তার সৎ ভাইয়ের প্রতি সন্দেহ বাড়তে থাকে, তারই ফলশ্রুতিতে তিনি তার ভাইয়ের উপাধি বাতিল করে এবং ১১৮৫ সালে হিরাইজুমিতে তাকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ১১৮৭ সালে তার পৃষ্ঠপোষক হিদেহিরা মারা যাওয়ার পর, ইয়োশিটসুন তার ছেলের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হন। এবং নিজ ছেলে তার বাসভবন ঘেরাও করে যা তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।  

তবে তার এই ঘটনাটি বিশেষভাবে বিখ্যাত বেঙ্কেইয়ের মৃত্যুর জন্য। তিনি ছিলেন একজন ভয়ঙ্কর যোদ্ধা সন্ন্যাসী যিনি ইয়োশিটসুনের রক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ইয়োশিটশুনের প্রাসাদে আক্রমনের আগে কিয়োটোর একটি সেতুতে প্রথমে বেঙ্কেইকে পরাজিত করতে হয়েছিল শত্রুপক্ষকে। তার জীবনের শেষ দিনে, ধারণা করা হয়ে থাকে যে বেঙ্কেই এককভাবে ৩০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করেছিলেন।

সামুরাইদের নিয়ে নির্মিত গেইমের একটি দৃশ্য। Image Source: wallpaperset.com

সৈন্যরা তাকে তীর দিয়ে দূর থেকে আক্রমণ করতে থাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে নড়াচড়া বন্ধ করে রাজাকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে এবং অবাক করার বিষয় তিনি পড়ে যাননি তখনো। অবশেষে যখন সৈন্যরা ব্রিজটি অতিক্রম করার সাহস দেখায়, তখন তারা দেখতে পায় যে বেঙ্কেই তার পায়ে দাঁড়িয়ে মারা গেছে! 

ইয়োশিটসুনে জাপানের ট্র্যাজিক নায়কের প্রতীক। তিনি কাবুকিতে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, সেইসাথে মহাকাব্য, ‘দ্য টেল অফ দ্য হেইকের’ মহাকাব্যের তৃতীয় অংশের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যাতে গেনপেই যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

‘সামুরাই’রা আজও সকলের আদর্শ, আগ্রহ এবং কৌতুহলের প্রতীক হয়ে আছেন সাধারণ পাঠক এবং দর্শকনের কল্পনায়। তাদের সুনিপুণ রণকৌশল আর বীরত্ব দ্বারা অঙ্কিত পটভূমিতে জ্বলজ্বল করছে প্রাচীন সব অর্জন। 

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. samurai. 
02. Samurai. 
03. samurai-and-bushido. 
04. samurai-history. 
05. Samurai. 
06. Japan's 12 Most Famous Samurai.