দুনিয়া হাতের মুঠোয় চলে আসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে দু’রকম। ইতিবাচক আর নেতিবাচক। তবে আমাদের প্রভাবিত করছে নেতিবাচক বিষয়গুলোই বেশি। বিশেষ করে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া কিছু গুজবকে আমরা প্রায়শই সত্য বলে ধরে নিই। এই বিশ্বাসের গণ্ডি অনেক সময় দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট এমনই একটি বিশ্বাস। একে আন্তর্জাতিক গুজব বললেও অত্যুক্তি হয় না।
সাধারণত অনলাইনে যেসব ক্রিপিপাস্তা ঘুরে বেড়ায় তার মধ্যে এই রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট সবথেকে জনপ্রিয়। এর সাথে জুড়ে দেয়া উদ্ভট ছবিটাও এর জনপ্রিয়তার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যদিও আদৌ এই এক্সপেরিমেন্টের গল্পের সাথে উক্ত ছবির কোনরকম কোন সংযোগ নেই। ব্যাপারটা এখনকার স্যোশাল মিডিয়া পোস্টগুলোর মত। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক চটকদার ছবি জুড়ে দেওয়া হয়। যাতে মানুষ সেটাকে এড়িয়ে যেতে না পারে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ঘুম মানবজীবনের অত্যাবশকীয় একটি বিষয়। মস্তিষ্কের বিশ্রাম আর সুস্থ সবল থাকার জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। বয়স এবং লিঙ্গভেদে মানুষকে দিনে কতটুকু ঘুমাতে হবে সেই তথ্যও গবেষণা করে খুঁজে বের করা হয়েছে। মানুষকে সময়মত এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর জন্য প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করা হয়। কম ঘুম কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়, মানুষকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। নিদ্রাহীনতা মানসিক বিষাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। ‘রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’ এই নিদ্রাহীনতা নিয়ে তৈরি এক উদ্ভট কল্পনা।
যাইহোক এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। গল্পটা আসলে কি ছিল? প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশ নিত্য নতুন অস্ত্র এবং যুদ্ধ কৌশল নিয়ে গবেষণা করত। এর মধ্যে প্রথম দিকের অগ্রসর একটি দেশ হচ্ছে রাশিয়া। তাদের রণকৌশল কিংবা বুদ্ধির সাথে আজও কোনো দেশ টক্কর দিতে ভয় পায়। প্রতিনিয়ত তারা সামরিক কৌশল নিয়ে চর্চা করছে। বের করছে অত্যাধুনিক, ক্ষেত্রবিশেষে উদ্ভট পন্থা।
যুদ্ধাস্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য এবং যুদ্ধ পদ্ধতি। অস্ত্র পর্যাপ্ত থাকলেও তাদের রণকৌশল যদি দূর্বল হয়, তাহলে তাদের জয়লাভের পথ বহুলাংশেই রুদ্ধ হয়ে যায়। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী রণকৌশলে নিজেদের কিংবদন্তীর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে তাদের নিয়ে নানা রকম গুজব ডালপালা মেলেছে। তার মধ্যে নির্ঘুম অতন্দ্র প্রহরী তৈরির গুজবটি সবচেয়ে জনপ্রিয়।
গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ব্যবহার করা হয়েছে। এই গল্প অনুযায়ী ৫ রাজবন্দীর উপর এই এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ৩০ দিন পর তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। একটি আবদ্ধ ঘরে বন্দীদেরকে রেখে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়। শুধুমাত্র খাদ্যগ্রহণ আর শৌচাগার ব্যবহার ছাড়া সকল সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সেই সাথে বাইরের দুনিয়ার সাথে সকল যোগাযোগ ছিন্ন করা হয়। ঘুম যেন না আসে এজন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ এক প্রকার গ্যাস। প্রাথমিকভাবে তৈরি এই গ্যাসের নাম দেয়া হয় পারভিটিন। তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয় টু ওয়ে মিরর। মাইক্রোফোনে তাদের কথা শোনার বিশেষ ব্যবস্থা রাখেন গবেষকরা।
৫ দিন পর বন্দীদের ভিতর অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে প্যারানয়া লক্ষ্য করা যায়। তারা তাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দোষারোপ করতে থাকে। নিজেরা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকে। নবম দিনে তাদের মধ্যে উন্মাদের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। একজন হঠাৎ চেম্বারের ভেতর ছুটে যায় এবং চিৎকার শুরু করে। তারা গ্লাস পোর্টহোলগুলো কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দেয়। দুই বন্দী টানা তিন ঘন্টা চিৎকার করে যায় যে পর্যন্ত ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে না যায়।
এরপর কেটে যায় আরো তিনদিন। গবেষকরা ঘন্টায় ঘন্টায় মাইক্রোফোন চেক করতে থাকে। তারা নিশ্চিত হতে চাইছিল বন্দীরা জীবিত আছে কিনা?
১৪ দিনের মাথায় বন্দিদের ভেতরের কথাবার্তা কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। হুট করেই নেমে আসে অসহনীয় নিরবতা। গবেষকরা ব্যাপারটাতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা বন্দীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে এবং মনে করিয়ে দেয় তাদেরকে সহযোগিতা করলে ৩০ দিন পর তাদের মুক্তি দেয়া হবে।
তারা সিদ্ধান্ত নেয় চেম্বার খোলার। কিন্তু ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ শোনা যায় যে তারা আর মুক্তি চায় না। ক্রমশঃ পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে। ভেতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে না পারার কারণে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে।
১৫ দিনের মাথায় গবেষকরা গ্যাসের প্রয়োগ বন্ধ করে দেয়। এরপরই শুরু হয় বন্দীদের আরো অদ্ভুত আচরণ। তারা গ্যাস বন্ধ না করার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে। চিন্তিত গবেষকরা দরজা খুলে এক বীভৎস দৃশ্য দেখতে পায়। পাঁচজন বন্দীর মধ্যে একজন মৃত এবং জীবিতরা একে অন্যের শরীর থেকে মাংস খুবলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তলপেট, পেশী ক্ষত-বিক্ষত। জীবিতদের দ্রুত ঐ কক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। তারা এক প্রকার দানবে পরিণত হয়েছিল।
৪ জন বন্দীর একজন ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। গবেষকরা ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে EEG পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেন কার্যত বন্দীরা ব্রেনডেড দশায় চলে গিয়েছিল। বাকি তিনজনকে আবার পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে এক পর্যায়ে একে একে সব বন্দীদের মেরে ফেলতে বাধ্য হয় তারা। নিজেদেরকে ক্ষতবিক্ষত করার কারণে তাদের অপারেশন করানো জরুরি হয়ে পড়ে।
কিন্তু সিডেটিভ তাদের উপর কোনোভাবেই কাজ করছিল না। পরবর্তীতে তাদের এভাবেই অপারশেন করতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তারা কেন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জিজ্ঞেস করাতে তারা উত্তর দিয়েছিল, তাদের যেভাবেই হোক জেগে থাকতে হবে।
এই গাঁজাখুরি গল্প লোকে বিশ্বাসও করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ক্রিপিপাস্তায় বহুল ব্যবহৃত ছবিটির সাথে আদৌ এই গল্পের কোনো সংযোগ নেই। মূলত এটি স্প্যাজম নামক একটি হ্যালোউইন প্রপস। এটি প্রথমদিকে এতটা জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু স্লিপিং এক্সপেরিমেন্ট গুজবের বদৌলতে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সর্বাধিক বিক্রি হওয়া প্রপসের মধ্যে ইতোমধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।
এবার আসা যাক এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে। Fandom.com নামের একটি ওয়েবসাইটে এই ক্রিপিপাস্তাটি প্রকাশিত হয়। লেখকের নাম হিসেবে পাওয়া যায় ‘অরেঞ্জ সোডা’। কিন্তু এই গল্পের সোর্স সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সমস্ত তথ্য প্রমাণ এর বিপরীতেই যায়।
এটি নিছকই একটি মনগড়া গল্প। তবে গল্পটি চমকপ্রদ হওয়াতে লাভ হয়েছে সৃজনশীল লোকেদের। বিভিন্ন বই, নাটক, সিনেমায় এই গল্পের ব্যবহার একে লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। ২০২২-এ ই দু’টি সিনেমা এবং একটি শর্টফিল্ম তৈরি হয়েছে। এসব কারণে লোকের আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছে।
বিচিত্র এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে, গুজব ডালপালা ছড়ায়। তবে গুজবও যে বাস্তব সত্যকে হার মানায় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই ‘রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’। আজও বহুলোক এটি বিশ্বাস করে।
Feature Image: laitimes.com Reference: 01. Russian-sleep-experiment-explained. 02. Russian-sleep-experiment. 03. The_Russian_Sleep_Experiment.