পহেলা বৈশাখ বাঙালির একাত্মতার উৎসব। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসাবে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যা এবং সমগ্র ভারতের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে উদযাপন করা হয়।
বছরের প্রথম দিন, পুরনো সব দুঃখ, হতাশা ভুলে নতুনের আহ্বান দিয়ে শুরু হয় এই দিন। উৎসবের এই দিনের রয়েছে বর্ণিল ইতিহাস। আজকের আলোচনা সেই ইতিহাসকে ঘিরেই।
সংস্কৃত ‘নভ’ থেকে নতুন এবং ‘বর্ষ’ থেকে বছর। অপরদিকে ‘পহেলা’ মানে ‘প্রথম’। পহেলা বৈশাখ (বাংলা: পয়লা বৈশাখ) হলো বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালি সম্প্রদায়ের মাঝেও এই উৎসব পালন করা হয়।
উৎপত্তি ও ইতিহাস
পহেলা বৈশাখ এর ইতিহাস শুরু মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৯) এবং তার শাসনামলে কর সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
বাংলায়, কৃষি তার ছয় ঋতুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। মুঘলদের অধীনে, আরবি বা হিজরি বছরের ভিত্তিতে কর আদায় করা হতো। যা এই অঞ্চলের এই ঋতুচক্রের সাথে মিলে না। যখন জমির মালিকদের কর আদায়ের সময় হতো, তখনও কৃষকরা ক্ষেত থেকে ফসল কাটার জন্য অপেক্ষা করতো৷
বিদ্যমান বর্ষ ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, বাদশাহ তার দরবারের প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে দায়িত্ব দেন।
নতুন ক্যালেন্ডারটি ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য, তাদের সময় এবং কৃষিতে তাদের ভূমিকাকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল। এই নতুন ক্যালেন্ডারের নামকরণ করা হয় ‘ফসলি সন’ (ফসল কাটার ক্যালেন্ডার), এবং পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’।
কর প্রদানের এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং আনন্দঘন করতে মূলত বৈশাখের উৎসবের আয়োজন। কেননা, জমির মালিকরা কর আদায় করে যা প্রায়শই তৃণমূল জনগণকে তাদের শক্তির অধীন করে। তাই কোনো গুরুতর বিদ্রোহ এড়াতে, বাদশাহ আকবর নববর্ষ উদযাপনের প্রথা নিপুণভাবে চালু করেছিলেন।
যা কর প্রদানের ঠিক পরের দিন হতো। বিনোদন এবং ভোজের আয়োজন কর প্রদানের কঠোরতাকে মসৃণ করতে এবং সবার মধ্যে একটি ভালো বছরের আশা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত একটি সমষ্টিগত রূপ পায়নি। পাকিস্তান থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ক্রমবর্ধমান আন্দোলন যা ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে শুরু হয়ে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল; সেই সময় পাকিস্তান সরকার অনেক নীতি বাস্তবায়ন করেছিল যার প্রভাব বাংলা নববর্ষের উপরও পড়েছিল।
একজন বাঙালি মুসলমানকে অন্যদের থেকে আলাদা করে, স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী, যৌথ আন্দোলন এড়াতে এই নীতিগুলো ছিল। এই ধরনের পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা হিসাবে, পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা নিষিদ্ধ করে। ছায়ানট-এর প্রতিবাদস্বরূপ পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
তখন থেকেই ঢাকার রমনা পার্কে আয়োজিত পহেলা বৈশাখ, রবি ঠাকুরের গান দিয়ে শুরু হয়। তার সাথে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে বৈশাখী প্যারেড (শোভা যাত্রা) যোগ করে এই দিনের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
পশ্চিমবঙ্গে পহেলা বৈশাখ
পশ্চিমবঙ্গে, বাঙালি নববর্ষ উদযাপনের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধেরও সম্পর্ক রয়েছে। বৈশাখের পুরো মাসটিকেই শুভ বলে মনে করা হয়। এই সময় অধিকাংশ হিন্দু বিয়ে হয়। হিন্দুদের জন্য দিনটি পূজা দিয়ে শুরু হয়।
পরিবারের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়। পূজার পরই ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা খোলা শুরু হয়। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
নারীরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি এবং পুরুষরা ধুতি এবং কুর্তা পরে। বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানাতে ভোরে শোভাযাত্রা হয়। গভীর রাত থেকে কালীঘাট মন্দিরের সামনে ভক্তদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। ভক্তরা সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদ পেতে পূজা দেয়।
পহেলা বৈশাখে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা পরিচালিত, নন্দন-রবীন্দ্র সদন মাঠে অনুষ্ঠিত বাংলা সংগীত মেলা।
গ্রামীণ জীবনে বৈশাখ
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাধারণত পহেলা বৈশাখে, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হয়, সুন্দর পোশাক পরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করা হয়। অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বিশেষ খাবার প্রস্তুত করা হয়।
দেশের অনেক জায়গায় বৈশাখী মেলা হয়। মেলায় বিভিন্ন কৃষিপণ্য, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, খেলনা, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার ও মিষ্টি বিক্রি হয়। এছাড়া যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা, গাজীর গান এবং আলকাপ গান অঞ্চলভেদে পরিবেশিত হয়।
পাশাপাশি তারা লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন, যেমন-বাউল গান, মারফতি, মুর্শিদি এবং ভাটিয়ালী গান। লায়লা-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা এবং রাধা-কৃষ্ণের মতো আখ্যানমূলক নাটক মঞ্চস্থ হয়। এই মেলার অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে পাপেট শো এবং মেরি-গো-রাউন্ড।
নববর্ষের দিনের সাথে যুক্ত অনেক পুরানো উৎসব হারিয়ে গিয়েছে। ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো এবং মুন্সীগঞ্জে ষাঁড়ের দৌড় খুবই বর্ণিল আয়োজনে হতো। অন্যান্য জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা ছিল ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই এবং নৌকা রেসিং। কিছু উৎসব অবশ্য এখনও পালন করা হয়; যেমন, চট্টগ্রামে বলি খেলা (কুস্তি) এবং রাজশাহীতে গম্ভীরা এখনও জনপ্রিয়।
ঢাকায় পহেলা বৈশাখ
নতুন বছরের ভোর শুরু হয় ছায়ানটের বৈশাখী গানের মধ্য দিয়ে। সর্বস্তরের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরেন। নারীরা বেশিরভাগ লাল বর্ডারসহ সাদা শাড়ি পরেন এবং নিজেদের সাজান বাঙালি ঢঙয়ে। পুরুষরা পরিধান করেন পায়জামা-পাঞ্জাবি।
অনেক নগরবাসী ঐতিহ্যবাহী পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ এবং ভাজা ইলিশ মাছ দিয়ে দিনের শুরু করেন। যদিও গ্রামে এই খাবার বেশি প্রচলিত। বর্তমানে, শহরে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে নববর্ষকে ঘিরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে এবং ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করে। সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা বের করে। রেডিও ও টেলিভিশনেও রয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম
পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি ভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে তাদের উৎসবকে পহেলা বৈশাখের সাথে একীভূত করে। ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজুফ- তিনটি উৎসবের প্রথম বর্ণ নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘বৈসাবি’।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
নববর্ষ উদযাপনের জন্য প্রথম ১৯৮৫ সালে যশোরে, শিল্পী এস এম সুলতান প্রতিষ্ঠিত শিল্প গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘চারুপীঠ’ উদ্যোগ নেয়। এই সময় স্থানীয় শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘বৈশাখী শোভাযাত্রা’র আয়োজন করে তারা।
১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক করতে জয়নুল উৎসব উপলক্ষে গোপনে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে তারা।
পরবর্তীতে, ইনস্টিটিউট পরবর্তী পহেলা বৈশাখ ১৯৮৯ সালে অনুরূপ একটি শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ নেয় যা ছিল বাংলা ১৩৯৬। শোভাযাত্রাটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। পরের বছর ময়মনসিংহ ও বরিশালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। আর এভাবে এটি একটি জাতীয় ঘটনা হয়ে উঠে।
বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অনন্য ও নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে ইউনেস্কো একে অন্তর্ভুক্ত করে। সারা রাত ধরে প্রধান রাস্তা এবং দেয়ালে বিশাল আল্পনাও আঁকা হয়।
হালখাতা
এটি হলো পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা পুরানো হিসাবের খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খোলার রীতি। ব্যবসায়ীরা পুরোনো গ্রাহকদের নিমন্ত্রণ পাঠায় এবং তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে।
সীমান্তে পুনর্মিলন
প্রতিবছর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দুই বাংলার মানুষ এই পহেলা বৈশাখের দিন আপনজনের সাথে দেখা করতে আসে। মানুষের তৈরি সীমানা তাদের আলাদা করেছিল। কিন্তু রক্তের আর আত্মার বাঁধন তাদের আলাদা করতে পারেনি। দুপুরের পর তাদের সীমানার কাছে আসতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি বিভ্রাট
নতুন ক্যালেন্ডারটি প্রাথমিকভাবে তারিখ-ই-এলাহি নামে পরিচিত ছিল এবং ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ প্রবর্তিত হয়েছিল। সেই অনুসারে, ৯৬৩ হিজরির প্রথম মহররম তারিখ-ই-ইলাহির সূচনা। যেহেতু এটি বৈশাখ মাসের সাথে মিলে যায়, তাই বৈশাখ মাসকে চৈত্র মাসের পরিবর্তে প্রথম মাস করা হয় যা বাংলায় শকাব্দের প্রথম মাস ছিল।
বাংলা বারো মাসের নাম বারোটি নক্ষত্রের নামে রাখা হয়। বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, উত্তরাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, পূর্বভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মাগশীর্ষ (অগ্রহায়ণ), পৃষ্রা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফালগুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলা পঞ্জিকা সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক তৈরি করেছিলেন। বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) শব্দগুচ্ছ দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায় যা আকবরের রাজত্বের থেকে শত শত বছরের পুরোনো। অর্থাৎ আকবরের রাজত্বের আগেও একটি বাংলা ক্যালেন্ডার বিদ্যমান ছিল।
আবার, রাজা বিক্রমাদিত্যের ক্যালেন্ডারটি বিভিন্ন রাজাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল। পাল সাম্রাজ্যের যুগের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ এবং শিলালিপিতে ‘বিক্রম’ এবং ‘আশ্বিনের’ উল্লেখ করা হয়েছে, যা সমগ্র প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায়।
১৯৬৬ সালে, মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিশন বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধন করে। যা ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। তারপর থেকে, ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়। ২০১৮-১৯ সালে, পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যবহৃত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে আরও ভালোভাবে মেলানোর জন্য, ফাল্গুন এখন নিয়মিত বছরে ২৯ দিন এবং লিপ ইয়ারে ৩০ দিন স্থায়ী হওয়ার সাথে ক্যালেন্ডারটি আবার সংশোধন করা হয়েছিল।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়। এর সাথে যুক্ত আছে, বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী ধারণার ইতিহাস, অত্যাচারী শাসকের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং একটি জাতির সংস্কৃতির মাধ্যমে এক হয়ে ওঠার গল্প। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ নতুনের বার্তা নিয়ে আসে আর মনে জাগায় আশার আলো।
Featured Image: Syed Zakir Hossain/banglatribune.com Reference: 01. Pohela-Boishakh. 02. Heritage-And-History-of-Poila-Boishakh. 03. Bengali-Calendar. 04. observerbd.com.