সিউলের উত্তর-পূর্বে ইয়াংগু কাউন্টিতে অবস্থিত কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড জোন (DMZ), পানমুনজোম। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক সীমানাগুলোর একটি। এখানে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি শত্রুতার অবসান ঘটিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটি সত্যিকারের শান্তি চুক্তি কখনোই হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া এখনো অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। বর্তমানে এটি পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান।
অবস্থান
কোরিয়ার যুদ্ধের (১৯৫০-৫৩) পর, কোরিয়ান ডিএমজেড বা ডিমিলিটারাইজড জোন (DMZ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পূর্বে কুমগাং অঞ্চল এবং পশ্চিমে ইমজিন এবং হান নদীর মুখে, কোরিয়ান উপদ্বীপের প্রস্থ বরাবর ২৫০ কিলোমিটার (১৬০ মাইল) জুড়ে বিস্তৃত। এই গ্রামটি কোরিয়া প্রজাতন্ত্র (দক্ষিণ কোরিয়া) থেকে গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (উত্তর কোরিয়া)-কে আলাদা করে।
ইতিহাস
১৯৫৩ সালে, জাতিসংঘের বাহিনী এবং উত্তর কোরিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট বাহিনীর মধ্যে বৈরিতা শেষ করার জন্য কোরীয় অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির একটি অংশে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষেরই তাদের সৈন্যদের সামনের লাইন থেকে ২ কিলোমিটার পিছনে সরাতে হবে। এটি DMZ-এ ৪ কিলোমিটার প্রশস্ত বাফার জোন তৈরি করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন পানমুনজোমে একটি ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠক করেন। তারা এই অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং পুনর্মিলনের জন্য ‘পানমুনজোম ঘোষণাপত্র’ গ্রহণ করেন।
এটি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পেশ করা হয়। এরপর উক্ত এলাকা থেকে গার্ড পোস্ট, অস্ত্রশস্ত্র এবং হাজার হাজার ল্যান্ডমাইন অপসারণ করা হয়েছে।
DMZ: পানমুনজোম
পানমুনজোম ডিএমজেড-এর মিলিটারি ডিমার্কেশন লাইনের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। এটি ‘ট্রুস ভিলেজ’ নামে পরিচিত। এখানে ১৯৫১-৫৩ সালে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বের নাম ছিল ‘নিওলমুন-রি’ (Neolmun-ri) সরাই গ্রাম।
নিওলমুন মানে ‘কাঠের দরজা’ এবং রি মানে গ্রামের একটি প্রশাসনিক ইউনিট। এখানে একটি কাঠের দরজা এবং একটি সেতু ছিল অনেক আগে। সেতুর নাম ছিল ‘নিওলমুন (Neolmun) ব্রিজ’। পরবর্তীতে এর নাম রাখা হয়, ‘দ্য ব্রিজ অব নো রিটার্ন’।
পানমুনজোমে, উত্তর কোরিয়ার প্রধান ভবন পানমুঙ্গাক। দক্ষিণ কোরিয়ার ফ্রিডম হাউস এবং পিস হাউস। তিনতলা পিস হাউসে একটি প্রেস রুম এবং প্রথম তলায় একটি ছোট কনফারেন্স রুম রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় মিটিং রুম এবং একটি ওয়েটিং রুম রয়েছে, তৃতীয় তলায় একটি বড় মিটিং হল এবং অন্যান্য কক্ষ রয়েছে।
তবে আপনি উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করতে চাইলে, আপনাকে একটি বন্ড সাইন করতে হবে যে আপনি স্বেচ্ছায় একটি প্রতিকূল এলাকায় প্রবেশ করছেন, যেখানে শত্রুর যেকোনো পদক্ষেপের ফলাফল হতে পারে আঘাত বা মৃত্যু।
DMZ Panmunjom-এর পথ
দর্শনার্থীরা পিয়ংইয়ং থেকে সরাসরি ভ্রমণ করতে পারেন (২-৩ ঘন্টার ড্রাইভ) অথবা কাইসং-এ রাত্রিযাপন করে, সেখান থেকে ভ্রমণ করতে পারেন। ট্যুরিস্ট বাসগুলো প্রথমে একটি বিশাল কংক্রিটের খিলান দিয়ে পার্কিং লটে যায়। এই খিলানের উপরে বিশাল সাদা অক্ষরে লেখা আছে ‘পুনর্মিলন’ (Reunification)।
সামরিক কর্মীরা চেক করার সময়, পর্যটকরা গিফট শপ ঘুরে দেখতে পারেন। গিফট শপে রয়েছে, হাতে আঁকা প্রচারের পোস্টারের একটি বিশাল সংগ্রহ। কোরিয়ান পিপলস আর্মি গাইডের এই স্থান এবং এর ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা রয়েছে। তারপরে দর্শনার্থীরা আবার বাসে চড়ে প্রথম চেকপয়েন্ট দিয়ে পানমুনজোমের দিকে রওনা দেয়।
তারপর বাস চলতে থাকে পানমুনজোম জয়েন্ট সিকিউরিটি এলাকার দিকে। পথে যেতে যেতে দেখা যায়, ডানদিকে উত্তর কোরিয়ার পতাকা যা বিশ্বের বৃহত্তম ফ্ল্যাগপোলে উড়ছে। এরপর তাদের জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া এবং নীল সম্মেলন কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইন্টারনেট ব্যবহার ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া (ডিপিআরকে, বা উত্তর কোরিয়া)-তে কিছুটা অবৈধ। এন্টাররুমে প্রতিটি দলের সাথে, সফরটিতে দিকনির্দেশনা দিতে একজন সামরিক অফিসার থাকেন।
এই কক্ষটি কোরিয়ান উপদ্বীপের মানচিত্র এবং পানমুনজোমের আশেপাশের এলাকা দিয়ে সম্পূর্ণ। একজন সামরিক অফিসার প্রতিটি বাস পরীক্ষা করার পর বাস পুনরায় চলতে শুরু করে।
জয়েন্ট সিকিউরিটি
সীমান্ত জুড়ে বসে থাকা কুঁড়েঘরগুলোর মধ্যে, জাতিসংঘ দ্বারা পরিচালিত নীল ঘর এবং রূপালী ঘর DPRK দ্বারা পরিচালিত। দর্শনার্থীরা সাধারণত কেন্দ্রীয় নীল কুঁড়েঘরে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসলে, সেখানে বসা যাবে না বা আসবাবপত্র স্পর্শ করা যাবে না।
উত্তর কোরিয়া এবং জাতিসংঘের কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আলোচনা ও স্বাক্ষর করার জন্য যে ভবনগুলো ব্যবহার করত, সেখানে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। মূল পতাকা এবং চুক্তিটি সেই সময়ের ফটো এবং প্রত্নবস্তু সহ ঘরের মাঝখানে একটি টেবিলে কাঁচের নীচে রয়েছে। এখানে রয়েছে, রাষ্ট্রপতি কিম ইল সং-এর স্বাক্ষর সহ একটি বিশাল মার্বেল সৌধ। জানা যায়, এটি ১৯৯৪ সালে তার মৃত্যুর আগে তার চূড়ান্ত নথিতে লেখা স্বাক্ষরের একটি অনুলিপি।
কংক্রিট ওয়াল
পানমুনজোম জেএসএ এর উত্তরে একটি লুকআউট আছে পর্যটকদের জন্য। দেখলে মনে হবে যেন, এটি পাহাড়ের উপরে বসে DMZ এর দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী সমগ্র উপদ্বীপ জুড়ে একটি বড় কংক্রিটের প্রাচীর দিয়ে এটি তৈরি করেছে।
ডিএমজেড আর্মিস্টিস টকস হল এবং পিস হাউস
এই বিল্ডিংগুলোতেই যুদ্ধবিরতি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিল্ডিংগুলোর পেছনের পাহাড়ের উপরে, নিরপেক্ষ নেশনস সুপারভাইজরি কমিশন ক্যাম্প-চেক এবং পোলিশ শান্তিরক্ষীদের আগের বাড়ি রয়েছে যা, বর্তমানে মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁ হিসাবে ব্যবহার হয়। এরপর রয়েছে ফ্রিডম হাউস। বিখ্যাত তিনটি নীল ঘর সাতটি ঘরের একটি সেটের অংশ। যার বাকি অংশ নিরপেক্ষ সুইডিশ এবং সুইস শান্তিরক্ষীদের দ্বারা পরিচালিত হয়।
ইয়াংগু ইউনিফিকেশন হল
পুনরায় দুটো স্থানকে একত্র করতে এবং উত্তর কোরিয়ার কৃষিপণ্যের বাজার প্রদানের জন্য নির্মিত ইয়াংগু ইউনিফিকেশন হলে, সীমান্তের ওপারের জীবনের আকর্ষণীয় গৃহস্থালী সামগ্রী এবং ছবি রয়েছে। রয়েছে ইয়াংগু ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, যার বিশাল প্রদর্শনী হলে হার্টব্রেক রিজের যুদ্ধ সহ এই অঞ্চলে সংঘটিত অনেক উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের তালিকা আছে।
টানেল
হল থেকে অল্প দূরত্বে একটি ‘অনুপ্রবেশ টানেল’ রয়েছে যা ১৯৯০ সালে আবিষ্কৃত হয়। উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর খনন করা এবং দৈর্ঘ্যে এক কিলোমিটার এবং বেশ প্রশস্ত এই সুরঙ্গ, দক্ষিণে হাজার হাজার সৈন্য ও হালকা অস্ত্র বহন করে আচমকা আক্রমণ করতে সক্ষম। এখন পর্যন্ত পাওয়া এই ধরনের চারটি সুড়ঙ্গের মধ্যে এখানেই দর্শনার্থীরা মিনি ইলেকট্রিক ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারে।
দেসোং-ডং (Daeseong-dong)
সমগ্র DMZ-এর সীমান্তের দক্ষিণ দিকের একমাত্র গ্রাম দেসোং-ডং (Daeseong-dong)। এখানে, ২০০ জন বাসিন্দা কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই বসবাস করে। তারা সরাসরি উত্তর কোরিয়ার ধানের ক্ষেত সংলগ্ন কৃষি জমির কঠোর নিয়ম এবং নিরাপত্তা প্রোটোকল মেনে চলে। উত্তর কোরিয়ার ডিমিলিটারাইজড জোনের গ্রামের নাম কিজং-ডং। যদিও তাদের বাসিন্দারা কখনই যোগাযোগ করে না, কিন্তু আশা সবসময়ই ছিল যে একবার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, এই দুটি গ্রাম এক হতে পারে।
দ্য ব্রিজ অফ নো রিটার্ন
একে ‘বিশ্বের নিঃসঙ্গ আউটপোস্ট’ বলা হয়। এটি একটি ছোট কাঠের সেতু যা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ডিমিলিটারাইজড জোন (DMZ) এর সীমানা রেখা অতিক্রম করে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের যুদ্ধবন্দিরা উত্তর কোরিয়ায় ফিরে যাওয়ার সময় তাদের বলা হয়েছিল যে, একবার এই সেতু অতিক্রম করলে; তারা আর ফিরে আসতে পারবে না। সেখান থেকেই এই নামকরণ।
এক্স (Axe) মার্ডার
১৮ আগস্ট, ১৯৭৬-এ এই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। ক্যাপ্টেন আর্থার বনিফাস এবং লেফটেন্যান্ট মার্ক ব্যারেট একটি বড় গাছের ছাঁটাই তদারকি করার জন্য ব্রিজ অফ নো রিটার্নে যান। এটি ইউএনসির সিকিউরিটির গুরুত্বপূর্ণ ভিউ বাধাগ্রস্ত করছিল। এতে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা জড়ো হয়ে বনিফাস এবং ব্যারেটকে আক্রমণ করে কুড়াল দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ব্রিজ অফ নো রিটার্নে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পানমুনজোম ভ্রমণ
পানমুনজোম পরিদর্শন পদ্ধতি এখন পূর্বের চেয়ে সহজ হয়েছে। ‘ইউনিফিকেশন (Unification)’ মন্ত্রণালয়ের নতুন পর্যটন সহায়তা কেন্দ্রের অধীনে দুই সপ্তাহ আগে আবেদন করতে হবে। পর্যটকদের বয়স সর্বনিম্ন আট। আগে শুধু ৩০-৪০ জনের গ্রুপ ট্যুরের অনুমতি ছিল। এখন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভাবেও ভ্রমণ করতে পারে।
পানমুনজোম কখনো কখনো দুই কোরিয়ার মধ্যের বৈরিতা প্রকাশ করেছে। আবার, আলোচনার স্থান হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, সীমানার দুই পাশের প্রকৃত শান্তি বা ঐক্য আসেনি। হয়তো, সুদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসতেও পারে। ততদিন পর্যন্ত, পানমুনজোম ঐক্যের আশা হয়ে থাকবে সবার মাঝে।
Featured Photo: Getty Images References: 01.Before-After-Panmunjom. 02. DMZ-Panmunjom-North-Korea. 03. DMZ-Panmunjom-North-Korea-Travel-Guide. 04. World.kbs. 05. Korea-70-Years-on/Bridges-at-Panmunjom. 06. South-Korea/Travel-Guide/Panmunjom. 07. Panmunjom-Declaration.