নেলসন ম্যান্ডেলা: বর্ণবৈষম্য দূর করতে ২৭ বছর কারাভোগ

357
0

A winner is a dreamer
who never gives up.

মানুষ প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধরার পেছনে কত জন ছুটে বলতে পারবেন? আর কয়জনই বা সফলতা পায়? স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে যে আমৃত্যু লড়ে যায় সেইই আসল বিজেতা। এমনই এক বিজেতার নাম পৃথিবী জানে নেলসন ম্যান্ডেলার নামে।  আজ জানবো যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেটা সত্যি করতে পেয়েছিল কি? আর কতটা কষ্ট তাকে ভোগ করতে হয়েছিল এই স্বপ্ন পূরণে? 

সাদা আর কালোর পার্থক্য অনাদিকাল থেকেই চলমান। বর্ণবাদী আন্দোলনের এই নেতা তার জীবনের ২৭ বছর ছিলেন কারাগারের অন্ধকূপে বন্দি। ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয় তার দীর্ঘ কারাজীবন, এর ১৮ বছর ছিলেন রবেন দ্বীপে। এরপরে তাকে অন্য কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। এই কারাজীবনেও ছিল নানা ঘটনার ঘনঘটা। 

জন্ম 

বিশ্ববিদিত এই নেতার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। বংগশগতভাবে তিনি ছিলেন সাউথ আফ্রিকার থেম্বু ডাইনেস্টির। পারিবারিকভাবে দক্ষিন আফ্রিকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। তার মা ছিলেন বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ম্যান্ডেলার তৃতীয় স্ত্রী নোসেকেনি ফ্যানি। ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারান ম্যান্ডেলা। ধারনা করা হয় যক্ষা রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। তার বাবা ছিলেন গ্রামের মোড়ল, পরবর্তীকালে দূর্নীতির দায়ে পদচ্যুত হোন। 

NELSON MANDELA
নেলসন ম্যান্ডেলার গ্রাফিতি। Image Source: pinterest.com

পড়াশোনা

নেলসন ম্যান্ডেলার ঘটনাবহুল জীবনের সূচনা সেই ছোটবেলায়। প্রথমে স্কুলের গন্ডি পার হোন। এই নেলসন নাম তার স্কুলে পাওয়া। এর আগ পর্যন্ত তার নাম ছিল রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা। এই নামের অর্থ বেশ অদ্ভত, ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’। তবে তার শিক্ষক কেন তার নাম নেলসন রাখেন সেটা বেশ রহস্যময়। 

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে জোহানেসবার্গে চলে আসেন এবং একজন আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। 

কর্মজীবন এবং রাজনীতি 

সময়টা ১৯৪০-৪১, বাড়ি থেকে বেরিয়ে জোহানেসবার্গে চলে আসেন নেলসন ম্যান্ডেলা। পারিবারিকভাবে ঠিক করা বিয়ে থেকে বাঁচতে তিনি ঘর ছাড়েন। প্রথমে একটি খনিতে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকরী নেন। নেলসন ম্যান্ডেলার সম্পর্কে জানতে পেরে পরবর্তীতে খনি মালিক তাকে কাজ থেকে ছাটাই করে দেন। 

পরে, উইটকিন-এ কেরানি হিসেবে যোগ দেন। কাজ চলাকালীন সময়ে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকাতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। উইটওয়াটার্সব্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন তার কিছুদিন পর স্নাতকোত্তর করার জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াকালীন সময়ে নানা দেশের নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৪২ সালে এএনসিতে যোগ দেন। তার অন্যতম অনুপ্ররণা ছিল ওয়াল্টার সিসুলু, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর অন্যতম সেরা নেতা।  

Nelson Mandela
নেলসন ম্যান্ডেলা। Image Source: pinterest.com

সিসু লু-এর বোনকে বিয়ে করেন কিছুদিন পর, ১৯৪৩-১৯৪৪ সালের দিকে। ধীরে ধীরে আইনজীবী হিসেবে বেশ সুনাম কামিয়েছেন তখন। ১৯৫২ সালে এই বার্গেই অলিভার নামের এক ব্যক্তির সাথে ওকালতি শুরু করেন, সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের উপর হওয়া অত্যাচার আর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। 

শ্বেতাঙ্গ ন্যাশনাল পার্টির করা অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশদ্রোহী হিসেবে তকমা পান। আরো অনেকের সাথে গ্রেফতার হোন, আস্তে আস্তে এই বর্ণবিদ্রোহ বিস্তৃত হয়ে যায় পুরো দেশজুড়ে। ১৯৬০ সালে নিষিদ্ধ হয় এএনসি। এই সময় ৬৯ জন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ । আবারও গ্রেফতার হন কিংবদন্তী এই নেতা। ছ’মাস পরে ছাড়া পেলেও আন্দোলন অব্যাহত থাকে।  

কারাদন্ড এবং. . .

নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগারে কাটিয়েছিলেন প্রায় ২৭ বছর। ১২ জুন, ১৯৬৪ সালে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৬২ সালের আগস্টে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। কী অদ্ভুত কষ্টের জীবন তাঁর তাই না? জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারের অন্ধকূপে থাকা? যথার্থই তিনি যুদ্ধ করে গেছেন, শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু তিনি কি সফল ছিলেন? এই দীর্ঘ কারাজীবন কতটুকু মূল্য দিয়েছে তাকে?

 I hate race discrimination most intensely and in all its manifestations. I have fought it all during my life; I fight it now and will do so until the end of my days.

Nelson Mandela
১০ বছর চলে নেতার মুক্তির দাবি। Image Source: pinterest.com

১৮ বছর রবেন দ্বীপে নিঃসঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন করেন। এরপরে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে আসা হয়। পলসমুরের এই জেলখানায় পরবর্তী কারাজীবন যাপন করেন। এই দীর্ঘসময়ে কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা কেউ জেলে, কেউ স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। তবে তাদের আদর্শ মেনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা নিজের মতো করে আন্দোলন চালিয়ে যান। রক্তের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল সমস্ত অঞ্চল সেই সময়। শ্বেতাঙ্গদের মতো সেই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রক্তের রঙও ছিল লাল। কিন্তু বৈষম্য ছিল অধিকারে, সুবিধায়, সুযোগে। 

আলোয় মুক্তি 

১৯৮০ সালে অলিভার তম্বো নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য এক দফা দাবিতে আন্দোলন চালান, ততদিনে আন্তর্জাতিক চাপও বেড়ে যায়। অবশেষে ঠিক ১০ বছর পর, ১৯৯০ সালে এফ. ডব্লিউ. ডি. ক্লার্ক, এএনসি-এর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। তিনি সেই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। 

নিষেধাজ্ঞা তোলার পর, ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রায় ২৭ বছর পর আলোর মুখ দেখেন অবিসংবাদিত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ফিরে এসে শুরু করেন সমঅধিকারের এক অন্য দেশ গড়ার কাজ।  

নোবেল শান্তি পুরস্কার

অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন এই নেতা। তিনি একদিকে যেন কৃষ্ণাঙ্গদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, অন্যদিকে লক্ষ রেখেছেন যাতে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে না পড়েন। তার চিন্তা-ভাবনা, কাজ আর মননশীলতার জন্য ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। গনতান্ত্রিক ভোটে একই বছর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হোন। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে-১৯৯০ সালে ভারত রত্ন পুরস্কার পান। একই বছর ১৮ অক্টোবর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডি লিট উপাধি দেয়া হয়। 

মৃত্যু 

১৮ বছর রবেন দ্বীপে থাকাকালীন নানা শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হোন তিনি। জীবনের শেষ দিকে সেই পুরানো অসুস্থতা আবার নতুন করে দেখা দেয়। নিউমোনিয়া এবং যক্ষার ফলে ফুসফুস আক্রান্ত হয়। বেশ ক’বার হাসপাতালে ভর্তি হোন। সমস্ত শুভানুধ্যায়ীদের আশঙ্কা সত্যি করে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর এই মহান নেতার জীবনাবসান ঘটে। সাথে ইতি ঘটে এক ইতিহাসের।  

নেলসন ম্যান্ডেলার বর্নাঢ্য জীবনকে কয়েকটি শব্দমালায় বোঝানো সম্ভবপর না। যদিও শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য আজো বিদ্যমান, তবে অতীতের চাইতে ব্যবধান কমে এসেছে। এর পেছনে নেলসন ম্যান্ডেলার ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।  তার জীবন সম্পর্কে, কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তারই লেখা “এ লং ওয়াক টু ফ্রিডম” বইটা পড়ে দেখা উচিত পাঠকদের। 

 

Feature Image: The New York Times 
References: 

01. Nelson Mandela Biography. 
02. Nelson-Mandela. 
03. Mandela Biographical
04. Nelson Mandela Biography.