মাদাগাস্কারের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আদিম সমুদ্র সৈকত, সবুজ রেইনফরেস্ট, ফোলা-চোখের সোনালি লেমুর এবং প্রাচীন ফরাসি উপনিবেশের বসতি দিয়ে ঘেরা স্বপ্নের মতো একটি জায়গা। আজ ঘুরে আসবো প্রাচীন এই দ্বীপে, জানা হবে জীববৈচিত্র্যের অদ্ভুত সব গল্প।
ভৌগলিক অবস্থান
আফ্রিকার বৃহত্তম দ্বীপ মাদাগাস্কার, যা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। মোজাম্বিকের উপকূল থেকে প্রায় ৪২০ কি.মি. (২৬০ মাইল) পূর্বে এবং মোজাম্বিক চ্যানেল দ্বারা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এটি বিচ্ছিন্ন। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপটি প্রায় ৮০ মিলিয়ন বছর ধরে বিচ্ছিন্ন এবং এর বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণির জন্য অনন্য।
গন্ডোয়ানার প্রাগৈতিহাসিক বিচ্ছেদ, প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকা থেকে মাদাগাস্কার-ভারতীয় ল্যান্ডমাসকে আলাদা করেছিল। ৭০ মিলিয়ন বছর পরে, মাদাগাস্কার ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
জীববৈচিত্র্য
দ্বীপের ৮০ শতাংশ প্রজাতি স্থানীয়, অর্থাৎ পৃথিবীর আর কোথাও এদের পাওয়া যায় না। যেহেতু এই জীবগুলো এতদিন ধরে একটি দ্বীপে বিচ্ছিন্ন ছিল, লক্ষ লক্ষ বছরের অভিযোজিত বিকিরণের ফলে খুব অনন্য এবং আশ্চর্যজনক প্রজাতির জন্ম হয়েছে।
দ্বীপটির বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণির মধ্যে আছে-লেমুর, ফোসা, মালাগাসি সিভেট, গিরগিটি, ব্যাঙ এবং অদ্ভুত আয়ে আয়ে। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চল হাম্পব্যাক তিমিদের জন্য বিখ্যাত।
মাদাগাস্কার এলিফ্যান্ট বার্ড বা বিশ্বের বৃহত্তম বিলুপ্ত পাখি ভোরম্বে টাইটানের বাসস্থান ছিল। যার উচ্চতা ৩ মিটার পর্যন্ত এবং ওজন ৭০০ কেজি পর্যন্ত।
উদ্ভিদ-বাওবাব
সম্ভবত মাদাগাস্কারের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্ভিদ হলো আইকনিক বাওবাবস (অ্যাডানসোনিয়া গ্র্যান্ডিডিয়ারি) এবং ট্রাভেলার্স পাম (রাভেনালা মাদাগাস্কারিয়েনসিস)। মাদাগাস্কারের পশ্চিম দিকে এই লম্বা বাওবাব গাছগুলো মোরোন্ডাভা এবং বেলোনাই সিরিবাহানার মধ্যকার রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
এর ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাওবাব গাছ স্থানীয়ভাবে রেনালা নামে পরিচিত যার অর্থ, ‘বনের রানি’। এই ৩০ মিটার লম্বা অদ্ভুত আকৃতির গাছগুলো ১০০০ বছর থেকে বিদ্যমান, এবং সূর্যাস্তের সময় এই গাছগুলোর দৃশ্য দেখার মতো।
মাদাগাস্কারের অনেক গাছেরই ঔষধি গুণ রয়েছে। মাদাগাস্কার পেরিউইঙ্কল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করার জন্য সবচেয়ে সুপরিচিত। এছাড়াও ভ্যানিলা, কফি, কোকো এবং কলার মতো আমাদের অনেক প্রিয় খাদ্যের উৎপাদন স্থান মাদাগাস্কার।
প্রকৃতপক্ষে, মাদাগাস্কার কলা বাণিজ্যিকভাবে জন্মানো ক্যাভেন্ডিশ কলাকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে! ক্যাভেন্ডিশ কলা সহজেই একটি ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় যা থেকে মাদাগাস্কারে উৎপাদিত কলা সুরক্ষিত।
রানোমাফানা জাতীয় উদ্যান
বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগতে সমৃদ্ধ, রানোমাফানা জাতীয় উদ্যানটি ৪০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। রানোমাফানা শব্দের অর্থ স্থানীয় ভাষায় ‘গরম জল’। যে কেউ পার্কের ভেতরে যেকোনো জলপ্রপাতের গরম জলে আরামদায়ক গোসল উপভোগ করতে পারে। এই পার্কটি বিপন্ন প্রজাতির সোনালী বাঁশের লেমুরের আবাসস্থল।
জাহামেনা জাতীয় উদ্যান
এই রেইন ফরেস্ট জাতীয় উদ্যানে পা রাখলে হলিউড সিনেমার সেটের অনুভূতি পাবেন। কুয়াশা এবং বৃষ্টিস্নাত মেঘে ঘেরা এই জাতীয় উদ্যানটি বেশ কিছু পাখির আবাসস্থল।
মাসোয়ালা জাতীয় উদ্যান
এই উদ্যান রেইনফরেস্টের নির্মল দৃশ্য এবং ফ্যালানোক এবং পাতার মতো লেজযুক্ত গেকো বা বিশেষ প্রজাতির টিকটিকির মতো বিরল প্রজাতির প্রাণির জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে টমেটো ফ্রগ বা ব্যাঙ এবং বিভিন্ন পাখি।
প্রাণি-লেমুর
মাদাগাস্কারের সবচেয়ে প্রিয় কিছু স্থানীয় প্রাণি হলো লেমুর। মানুষ ব্যতীত, দ্বীপে পাওয়া একমাত্র প্রাইমেট লেমুর। সম্ভবত প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর ধরে এরা মাদাগাস্কারে বসবাস করছে। আজ, লেমুরের প্রায় একশত বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে।
সবচেয়ে বড় আকৃতির লেমুর হলো ইনদ্রি। স্থানীয়দের কাছে এটি পবিত্র প্রাণি হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও আছে সিফাকা, রিং টেইলড, ইঁদুরের মতো দেখতে মাউস লেমুর নামের বিভিন্ন প্রজাতি।
লেমুরের বৈচিত্র্যের ফলে কিছু অবিশ্বাস্য অভিযোজন ঘটেছে, যা গবেষকদের প্রাইমেট বিবর্তন এবং এমনকি মানব জিনোম সম্পর্কে আরও বুঝতে সাহায্য করছে। দুর্ভাগ্যবশত, মাদাগাস্কারের বেশিরভাগ লেমুর প্রজাতি বর্তমানে বাসস্থানের ক্ষতির কারণে বিপন্ন, এবং বাকি স্থানীয় প্রজাতির জন্যও এটি হুমকিস্বরূপ।
আয়ে-আয়ে
মাদাগাস্কারের আরেকটি উদ্ভট প্রাণি হলো আয়ে-আয়ে। দেখতে বাদুড় এবং কাঠবিড়ালির ক্রস বা মাঝামাঝি এবং লম্বা মধ্যমা আঙুল যুক্ত, যা গাছের ছাল থেকে পোকামাকড় বের করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ফোসা
মাদাগাস্কারের বৃহত্তম স্তন্যপায়ী মাংসাশী ফোসা একটি ছোট কুকুর বা একটি বড় বিড়ালের আকারের কাছাকাছি এবং চেহারার দিক থেকে উভয়ের সাথে মিল রয়েছে।
সরীসৃপ
বিশ্বের প্রায় ৮০% গিরগিটির প্রজাতি মাদাগাস্কারে পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্রুকেসিয়া মাইক্রা এবং ২-ফুট লম্বা দৈত্যাকার মালাগাসি গিরগিটি। এছাড়াও মাদাগাস্কারে রয়েছে সাপ, টিকটিকি, গেকো এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় সরীসৃপ যেমন প্যান্থার গিরগিটি যাদের পুরুষদের ত্বকে উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয় রঙিন চিহ্ন থাকে এবং দৈর্ঘ্যে আট ইঞ্চি পর্যন্ত বড় হতে পারে।
টমেটো ফ্রগ বা ব্যাঙ এবং ম্যান্টেলার যা সাধারণত মালাগাসি বিষ ব্যাঙ নামে পরিচিত, একচেটিয়াভাবে মাদাগাস্কারে বাস করে। মাদাগাস্কারে সবসময় ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হতে থাকে এবং ২০০৯ সালে স্বীকৃত ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা পূর্বের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
কীটপতঙ্গ
মাদাগাস্কারে ১,০০,০০০ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। যেমন জিরাফ উইভিল এবং জাল নিক্ষেপকারী মাকড়সা। জাল-নিক্ষেপকারী মাকড়সা আঠালো রেশমের জাল ছুড়ে তার শিকারকে ছিনিয়ে নেয়। জিরাফ উইভিল তার লম্বা ঘাড়টি আক্রমণ করতে ব্যবহার করে।
ধূমকেতু মথের প্রায় ২০ সেমি (৮ ইঞ্চি) বিশাল ডানার স্প্যান এবং ১৫ সেমি-এর (৬ ইঞ্চি) একটি লেজ রয়েছে। হলুদ ডানায় বাদামি চিহ্ন এবং চোখের মতো প্যাটার্ন আছে। তবে এটি মথের স্ট্রিমারের মতো লেজ যা এর উপস্থিতি জানান দেয়।
পাখি
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাখি-পর্যবেক্ষকরা হেলমেট ভাঙ্গা, ক্রেস্টেড ড্রঙ্গো, মালাগাসি কিংফিশার, প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, ভাসা তোতাপাখির মতো অন্যান্য সুন্দর পাখি দেখতে মাদাগাস্কার আসে। হেলমেট ভ্যাঙ্গা একচেটিয়াভাবে উত্তর-পূর্ব মাদাগাস্কারের রেইনফরেস্টে পাওয়া যায়।
যেহেতু বিলুপ্তি বাড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন তীব্র হচ্ছে, মাদাগাস্কারের মতো জীববৈচিত্র্যের হটস্পটগুলো আমাদের সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই স্থানগুলো রক্ষা করা, পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুতন্ত্র এবং আমাদের গ্রহের সকলের জন্য একটি সুস্থ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে৷
Featured Photo: wallpapercave.com References: 01. Madagascar. 02. Places to visit in Madagascar. 03. lemur.duke. 04. Madagascar’s wildlife: A quirk of evolution.