ইলেক্ট্রোলাইট কি এবং এর কার্যকারিতা

339
0
ইলেক্ট্রোলাইট,Image source:iStockphoto

মানবদেহে ইলেকট্রিসিটি বা তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে যেসব উপাদান তাদেরকে ইলেক্ট্রোলাইট বলা হয়। কারণ তারা কোষের মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। এগুলো মানবদেহের অনেক প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। এই উপাদানগুলো স্নায়বিক চাপ, পেশী সংকোচন,শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য বজায় এবং শরীরের pH বা এসিড ও ক্ষারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।

অর্থাৎ, শরীরকে সঠিকভাবে কাজ করতে হলে খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলেক্ট্রোলাইট পেতে হবে। এজন্য ইলেক্ট্রোলাইট কি এবং এর কার্যকারিতা কি তা জানা উচিত।  

ইলেক্ট্রোলাইট কি 

ইলেক্ট্রোলাইট হলো তড়িৎ প্রবাহযুক্ত একটি খনিজ। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি মানবদেহে রক্তে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশে থাকে। সাধারণত ক্যালসিয়াম, ফসফেট, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট ইত্যাদিকে ইলেক্ট্রোলাইট বলে। মানুষের শরীরের কোষ, পেশি এবং অঙ্গগুলি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য ইলেক্ট্রোলাইট প্রয়োজন। ইলেক্ট্রোলাইট শরীরে তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। 

এছাড়াও, ইলেক্ট্রোলাইট হার্ট, পেশি এবং স্নায়ু কোষ থেকে অন্যান্য কোষে স্নায়ু সংকেত প্রেরণ, নতুন টিস্যু নির্মাণ, রক্ত জমাট বাঁধা, রক্তের পিএইচ (pH) স্তর বজায় রাখা, পেশী সংকোচন দ্বারা হৃদস্পন্দন চালু রাখা এবং রক্তের প্লাজমাতে তরল স্তর নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।  

Electrolyte | Definition, Examples, & Facts | Britannica
ইলেক্ট্রোলাইট টেস্ট। Image source: Encyclopedia Britannica

ইলেক্ট্রোলাইটের কার্যকারিতা 

১. স্নায়ুতন্ত্রকে কার্যকর রাখা 

ইলেক্ট্রোলাইট মানবদেহের স্নায়বিক কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ক স্নায়ু কোষের মাধ্যমে সারা শরীরে বিভিন্ন সংকেত পাঠায়। শরীরের নানা অনুভূতি এর মাধ্যমেই বোঝা যায়। আর ইলেক্ট্রোলাইটের সোডিয়াম উপাদানটি মূলত এসব কাজ করে থাকে। 

২. পেশি সঞ্চালন

পেশির সঞ্চালনে ইলেক্ট্রোলাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম বেশি প্রয়োজন। এটি ছাড়া পেশি সংকুচিত বা প্রসারিত হবে না। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে হৃৎপিণ্ডের পেশির সংকোচন এবং বীট করার ক্ষমতাও রয়েছে। এই দুটি উপাদান মাংস পেশিকে সুন্দরভাবে চলতে এবং একে অপরের উপর দিয়ে যেতে সাহায্য করে। কারণ পেশি সংকুচিত হয়ে শিথিল হতে পারে।

৩. শরীরে জলীয় ভারসাম্য বজায় 

ইলেক্ট্রোলাইট মানুষের শরীরে পানি বা অন্যান্য তরল পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখে। বিশেষ করে সোডিয়াম অসমোসিসের মাধ্যমে এই কাজটি করে। অসমোসিস এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে পানি একটি পাতলা দ্রবণ (বেশি পানি এবং কম ইলেক্ট্রোলাইট) থেকে একটি কোষের ঝিল্লির প্রাচীরের মধ্য দিয়ে আরও ঘনীভূত দ্রবণের (কম পানি এবং বেশি ইলেক্ট্রোলাইট) দিকে চলে যায়৷  আর এই প্রক্রিয়াটি শরীরের কোষগুলিকে খুব বেশি পানি পূর্ণ হওয়া বা পানিশূন্যতার কারণে কুঁচকে যাওয়া থেকে বিরত রাখে।

 ৪. pH মাত্রা নিয়ন্ত্রণ 

সুস্থ থাকার জন্য শরীরের অভ্যন্তরীণ pH মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। pH হলো একটি দ্রবণ কতটা অম্লীয় বা ক্ষারীয় তার পরিমাপ। যদি রক্তে pH এর মাত্রা ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫ হয়ে যায় তখন শরীর সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর ইলেক্ট্রোলাইটের সঠিক ভারসাম্য মানবদেহে রক্তের অ্যাসিড এবং ক্ষারীয় ভারসাম্য রক্ষা করে। 

৫. জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া 

ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের মতো ইলেক্ট্রোলাইটগুলি শরীরের শত শত জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে রয়েছে ডিএনএ সংশ্লেষণ, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা, রক্ত ​​জমাট বাঁধা, রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ, পানির ভারসাম্য।  

ইলেক্ট্রোলাইটের উৎস 

শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখার সর্বোত্তম উপায় হলো একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট। অর্থাৎ, খাবারের মাধ্যমে এটি শরীরে গ্রহণ করা যায়। ইলেক্ট্রোলাইটের প্রধান খাদ্য উৎস হলো ফল ও সবজি। তবে সোডিয়াম এবং ক্লোরাইডের একটি সাধারণ উৎস হলো আয়োডিনযুক্ত লবণ। এছাড়া, নিম্নোক্ত খাদ্য উৎস থেকে এই উপাদানসমূহ পাওয়া যায়। 

  • সোডিয়াম: আচার, পনির এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ।
  • ক্লোরাইড: আয়োডিনযুক্ত লবণ।
  • পটাসিয়াম: কলা,  মিষ্টি আলুর মতো ফল ও সবজি।
  • ম্যাগনেসিয়াম: সবজি,বীজ এবং বাদাম।
  • ক্যালসিয়াম: দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস এবং সবুজ শাকসবজি। 

তবে বাইকার্বোনেটের মতো ইলেক্ট্রোলাইটগুলি শরীরে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়, তাই সেগুলি খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই। মূলত শাক-সবজি, ফল, দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, বাদাম, ডাবের পানির পাশাপাশি ক্যাপসুল এবং কিছু স্পোর্টস ড্রিংকসেও ইলেক্ট্রোলাইট পাওয়া যায়।  

7 Best Electrolyte Powders of 2023, According to Dietitians
ইলেক্ট্রোলাইটের কিছু উৎস, Image source: Good Housekeeping

ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা কি কারণে হয়? 

সাধারণত মানবদেহে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ইলেক্ট্রোলাইট বিদ্যমান। কিন্তু যদি এটি কমে যায় বা বেড়ে যায় তখন শরীরে নানান ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত সমস্যাটি হলো ডিহাইড্রেশন। ব্যায়ামের সময় ঘামের মাধ্যমে সোডিয়াম এবং পটাসিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইট নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণেই কায়িক শ্রমের ফলে অতিরিক্ত ঘাম হলে স্পোর্টস ড্রিংকস বা ডাবের পানি দিয়ে ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি পূরণ করা হয়।

জ্বর, ডায়রিয়া, বমি ও প্রসাবের সাথে ইলেক্ট্রোলাইট শরীর থেকে বের হয়ে এর ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। অ্যালকোহল পান করার ফলে পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট হারাতে পারে। কিডনি রোগীদের মধ্যে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। কারণ শরীর থেকে কতটা ইলেক্ট্রোলাইট ফিল্টার করা হয় তা কিডনি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার কিডনি রোগীদের পটাসিয়ামের আধিক্য দেখা দিলে হাইপারকেলমিয়া হয়ে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। 

কিছু কিছু ওষুধ যেমন মূত্রবর্ধক ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিকও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে। কিছু চিকিৎসা অবস্থা যেমন টাইপ ১ ডায়বেটিস থাকলে, কেমোথেরাপি দিলেও এই ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। কেটোঅ্যাসিডোসিস এবং গুরুতর পোড়া ক্ষত ইলেক্ট্রোলাইটের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার লক্ষণগুলি কী কী?

ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার কিছু লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • ক্লান্তি
  • পেশির দূর্বলতা
  • অস্বাভাবিক পেশি সংকোচন (পেশি কামড়ানো বা পেশি খিঁচুনি)
  • অস্বাভাবিক হার্টবিট
  • রক্তচাপের পরিবর্তন (নিম্ন বা উচ্চ রক্তচাপ)
  • বিভ্রান্তি
  • শরীরের অসাড়তা 
  • খিঁচুনি এবং অন্যান্য স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধি
  • হাড়ের ব্যাধি। 
Electrolyte Disorders: Symptoms, Risk Factors, Types, and Treatment
ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা,Image source: Metropolis

ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা কীভাবে দূর করা যায়? 

সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখা সবচেয়ে সহজ হয়। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করা দরকার তবে  প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। কারণ বেশি পানি পান করলে শরীর থেকে ইলেক্ট্রোলাইট বের হয়ে যেতে পারে। 

খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে লবণ খেতে হবে। তবে অতিরিক্ত হলে তা আবার সমস্যার সৃষ্টি করবে। গরমের তীব্রতা বেশি থাকলে ঘরের বাইরে ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকতে হবে।যদি বেশি ঘাম হয় তাহলে ঘরের ভেতরেও ব্যায়াম করা কমিয়ে দিতে হবে।  

কয়েক ঘন্টার কঠোর পরিশ্রম করলে পরে পানি বা স্পোর্টস ড্রিংকসের মতো পানীয় গ্রহণ করা যায়। এছাড়া স্যালাইন ও ডাবের পানি পান করলেও ভালো লাগবে। তবে কেউ নিয়মিত কোনো ওষুধ গ্রহণ করার ফলে যদি কোনো ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করে তাহলে সেই সম্পর্কে ডাক্তারকে জানানো উচিত। ওষুধ পরিবর্তন জরুরি হলে সেটা করতে হবে। 

ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণে কিছু থেরাপি

ইলেক্ট্রোলাইট ঘাটতি যদি অনেক গুরুতর হয় তাহলে ডাক্তাররা মুখে বা IV ড্রিপের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোলাইট রোগীর শরীরে প্রবেশ  করাতে পারেন। যা সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে। 

Excessive Sweating: Why You Sweat Lots During Workouts
অতিরিক্ত ঘামের ফলেও শরীর থেকে ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায়,Image source: Men’s Health

তবে ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি যাদের অনেক বেশি গুরুতর যেমন- কিডনি রোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রতিরোধযোগ্য নয়।  এক্ষেত্রে সুষম খাদ্যাভ্যাস ইলেক্ট্রোলাইট স্তরের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। 

 

 

 

Feature Image: 
References: 

01. Electrolytes. 
02. Electrolyte. 
03. Electrolyte.