ডেথ ভ্যালি নামটা শুনলে আমরা অনেকে মনে করি যে, এটি একটি মৃত্যু উপত্যকা। কিন্তু বাস্তবে ডেথ ভ্যালি হলো একটি বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান। এটি প্রায় ৩৩,৭৩,০০০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। মূলত ডেথ ভ্যালি মরুভূমির জলবায়ু, অসাধারণ সব দৃশ্য এবং অনন্য ভূতাত্ত্বিক গঠনের জন্যই পরিচিত।
এছাড়া উদ্যানটিতে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণির আবাসস্থল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জোশুয়া গাছ, মরুভূমির কাছিম এবং বিঘর্ণ ভেড়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি, ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক হাইকিং, রক ক্লাইম্বিং এবং ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যকলাপের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে।
এজন্য ডেথ ভ্যালি জাতীয় উদ্যান দর্শনার্থীদের কাছে একটি অসাধারণ জায়গা। যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিনোদনের সুযোগ সুবিধা উপভোগ করতে আসেন। আজকের আলোচনা ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য।
ডেথ ভ্যালির অবস্থান
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া এবং নেভাদা রাজ্যের মাঝ বরাবর বর্ডারের কাছে এর অবস্থান। দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৫ কিলোমিটার লম্বা এবং ২৪ কিলোমিটার চওড়া এই ডেথ ভ্যালি। লাস ভেগাস থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ডেথ ভ্যালিতে যেতে হয়। ডেথ ভ্যালি নামক এই উপত্যকাটি, বর্তমানে বিশ্বের সবচাইতে বড় ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত।
ডেথ ভ্যালি নামকরণের ইতিহাস
তখন ছিল ১৮৫০ সাল। একদল স্বর্ণ সন্ধানী দল পূর্ব মরুভূমি পার হয়ে ভুল করে ডেথ ভ্যালিতে আটকা পড়ে যায়। তাদের মূল গন্তব্য ছিল উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সাটারস মিল এলাকা। কিন্তু পথিমধ্যে একজন সহযাত্রীর মৃত্যু ঘটে। তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
সেখানকার আবহাওয়া জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তবে দলের বাকিদেরকে অনেক কষ্টে মৃত্যুর দরজা হতে উদ্ধার করা হয়। তাদের মাঝে একজন মৃত্যুর সেই দরজা থেকে ফিরে আসার সময়, পিছনে ফিরে তাকিয়ে উক্তি করে বলেন,
Bye, Death Valley
অর্থাৎ, বিদায়, মৃত্যু উপত্যকা।
আর সেখান থেকে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ডেথ ভ্যালি।
ডেথ ভ্যালিতে মানবজাতির অস্তিত্ব
ডেথ ভ্যালি নামকরণের পর শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা। গবেষণার ফলে জানা যায় আনুমানিক প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে মানুষের বসবাসের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এখানে, টিম্বিশা শোশোন নামক একটি উপজাতির বাস ছিল। এই স্থানটি তাদের কাছে একটি প্রিয় স্থান ছিল।
ডেথ ভ্যালি গ্রহের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান
সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম এবং আশ্চর্যজনক একটি স্থান হিসেবে ডেথ ভ্যালি এখন বেশ সুপরিচিত। জানা যায়, ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে এখানকার তাপমাত্রা স্পর্শ করেছিল ১৩৪ ফারেনহাইট বা ৫৬.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অর্থাৎ এটা মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রা থেকেও অনেক অনেক বেশি। শুনতে খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয়।
তা সত্ত্বেও এটাই সত্যি যে, এখানকার যে ভূমি অর্থাৎ চলার যে মূল পথ, তা বাতাসে থাকা তাপমাত্রার থেকেও দ্বিগুণের বেশি গরম। তাই, এখানে হাঁটা অসম্ভব কষ্টকর। ১৯৭২ সালে এখানকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
২০০ ফারেনহাইট, যা এযাবত কালের সর্বাধিক। জেনে রাখা ভালো, ডেথ ভ্যালির তাপমাত্রাকে অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়েছিল লিবিয়া। তবে মজার ব্যাপার হলো, ২০১২ সালে সেই তথ্য ভুল প্রমাণিত হওয়ায়, পূর্বের রেকর্ডটি আবারো ডেথ ভ্যালি দখল করে নেয়।
ডেথ ভ্যালিতে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে ডেথ ভ্যালি জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি, ১৯৯৪ সালে ডেথ ভ্যালিকে একটি ন্যাশনাল পার্কে (জাতীয় উদ্যানে) পরিণত করা হয়। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেথ ভ্যালিতে মানুষের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তবে নভেম্বর থেকে এপ্রিলে পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকে।
ফেব্রুয়ারি মাসে এখানকার তাপমাত্রা মানুষের জন্য সঠিক না হলেও, কিছুটা অন্তত সহনীয় থাকে। এই মৃত্যু উপত্যকায় কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা কিংবা কোনো পশুকে শিকার করা পুরোপুরি অবৈধ।
আনুমানিক কয়েক হাজার বছর পূর্বে গঠিত, এবং লবণের কঠিন আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত একটি স্থান আকর্ষণীয় স্থান হলো Devil’s Hole। একই সাথে Telescope Peak, এমন একটি জায়গা যা কিনা ডেথ ভ্যালি পার্কের সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে খ্যাত। এর উচ্চতা প্রায় ৩৩৬৬ মিটার।
আকর্ষণীয় এই স্থান ঘুরে দেখতে, বছরে কয়েক লক্ষ ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের আবির্ভাব ঘটে এই মৃত্যু উপত্যকায় অর্থাৎ ডেথ ভ্যালিতে। ২০১৪ সালে রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ১ মিলিয়ন পর্যটক এই স্থান ভ্রমণে আসেন।
ডেথ ভ্যালি সম্পর্কে অবাক করা তথ্য
সেলিং স্টোনস অর্থাৎ চলমান পাথর হলো ডেথ ভ্যালির অন্যতম রহস্যের মাঝে একটি। প্রকৃতি কতটা বৈচিত্র্যময় রূপ ধারণ করতে পারে, তার জীবন্ত উদাহরণ ডেথ ভ্যালির এই পাথরগুলো। এদের একেকটি পাথরের ওজন প্রায় কয়েকশো পাউন্ডেরও অধিক। তবে কিছু সময় এই পাথরগুলোকে ঐ আগের স্থানে আর পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করতেন, এটা কোনো মানুষ কিংবা পশুর কাজ হতে পারে।
কিন্তু এখানে কোনো পদচিহ্ন দেখা দেখতে পাওয়া যায়নি। আর এত ভারী পাথর মানুষের দ্বারা বহন করা অসম্ভবই বটে। এই অদ্ভুত বিষয়টি ১৯১৫ সালে সবার প্রথম জোসেফ ক্রোকের নজরে আসে।
তাদের মতে প্রচন্ড বাতাস, কিছু কাদামাটি, বরফ এবং তাপমাত্রার তারতম্যতার কারণে পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করতে পারে বলে, তারা ব্যাখ্যা দেন। তবে প্রতিটি পাথর ২ বা ৩ বছরে মাত্র একবার করে পথ পরিবর্তন করে। এরকম হওয়ার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা হলেও, এ নিয়ে এখনো অনেক গবেষণা চলছে।
হলিউড মুভি ‘Star Wars’ মুভি ও টিভি সিরিজটি বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র-প্রেমী দর্শকের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। এই মুভির, বিশেষ দুইটি এপিসোড A New Hope এবং Return of the Jedi এ যে দৃশ্যগুলো দেখানো হয়েছিল, তার বেশিরভাগ শ্যুটিংই করা হয়েছিল ডেথ ভ্যালিতে। এছাড়াও, এই স্থানকে নিয়ে আলাদা করে কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে।
ডেথ ভ্যালিতে প্রচন্ড তাপের কারণে মানবজাতি থেকে অন্যান্য প্রাণিদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। কিন্তু, লিজার্ড নামক এক ধরনের গিরগিটির এখানে সবসময় অবলীলায় ঘুরে বেড়ায়। এখানে প্রায় ৫২টি বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণি রয়েছে। তবে দিনের বেলা তাপ অনেকটা বেশি থাকলেও, রাতের বেলায় এখানকার প্রকৃতি কিছুটা শীতল থাকে।
পৃথিবীতে এমন বেশ আশ্চর্যজনক এবং বৈচিত্র্যময় স্থান রয়েছে। এগুলো যেমন আকর্ষণীয় তেমনি এগুলোর মধ্যে অনেক রহস্যও জড়িয়ে থাকে। এমনি একটি জায়গা এই ডেথ ভ্যালি।
Feature Image: discoverybicycletours.com References: The Death-Valley-National-Park. 12-things-you-didnt-know-about-Death-Valley. The Death-Valley.