প্রাকৃতিক সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্য সবচেয়ে বেশি যেই দুর্যোগের সম্মুখীন পৃথিবীকে হতে হয় সেটি হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়। ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড়ে তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন না হলেও, প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। পৃথিবীর যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে তীব্রতার দিক থেকে উষ্ণমন্ডলীয় ঘূর্নিঝড়ই সবচেয়ে ভয়াবহ বলা চলে।
ঘূর্ণিঝড় কিভাবে সৃষ্টি হয়?
ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে সংঘটিত হওয়া বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড গতির বাতাস সংবলিত এক প্রকার আবহাওয়ার অবস্থা, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রমুখী ও ঊর্ধমুখী বায়ুরূপে পরিচিত। এর কেন্দ্রস্থলে নিম্নচাপ এবং চারপাশে উচ্চচাপ বিরাজ করে।
সমুদ্রের মঝে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয় করে এটি একটি এলাকায় ভেতরের দিকে ঘুরতে থাকে। যেমন উত্তর গোলার্ধে এটি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এটি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে সাধারণত। পৃথিবীর ৩০° উত্তর এবং ৩০° দক্ষিন অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমূদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭° সে. এর উপরে থাকা প্রয়োজন। অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি ঘটে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে। সাধারণত ৫° উত্তর থেকে ৩০° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫° দক্ষিন অক্ষাংশ থেকে ৩০° দক্ষিন অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর উৎপত্তি ঘটে থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের যত নাম
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন নামে পরিচিত। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়কে আমেরিকা মহাদেশ ‘হারিকেন’ বা টর্নেডো, দূরপ্রাচ্যে বা চীন সাগরে উৎপন্ন হলে ‘টাইফুন’, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বলা হয় ‘সাইক্লোন’, জাপানে ‘টাইফু’, ফিলিপিনে ‘বাগুইয়ো’ এবং বাংলায় ‘ঘূর্ণিঝড়’ বলা হয়ে থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রকারভেদ
অবস্থান এবং ধরণ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের ভিন্ন ভিন্ন ধরন রয়েছে। তারই সূত্র ধরে আবহাওয়াবিদগণ ঘূর্ণিঝড়কে ৪ ভাগে বিভক্ত করেছে। যথাক্রমে-
১. ট্রপিকাল সাইক্লোন
২. পোলার সাইক্লোন
৩. মেসো সাইক্লোন
৪. এক্সট্রা-ট্রপিকাল সাইক্লোন
কিছু প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা
১. ভোলা সাইক্লোন, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান-বাংলাদেশ), ১৯৭০
আশ্চর্যের হলেও সত্যি, ভোলা সাইক্লোনকে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর দিয়ে এই ঝড় বয়ে যায়। তারিখটি ছিল ১৩ নভেম্বর, ১৯৭০। ঘন্টায় ২০৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া সেই ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় অনেক জনপদ। প্রাণ হারায় ৫ লাখের মতো মানুষ, যাদের মধ্যে জেলেদের সংখ্যাই ছিল ১ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জলোচ্ছ্বাস।
২. নিনা টাইফুন, চীন, ১৯৭৫
১৯৭৫ সালে হওয়া এই টাইফুন চীনের হেনান প্রদেশে আঘাত আনে। প্রাণ হারায় হতভাগ্য ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষ। এছাড়াও বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. নার্গিস, মিয়ানমার, ২০০৮
ভয়ংকর যে ঝড়গুলো তান্ডব চালিয়েছে সেই তালিকায় ‘নার্গিস’ অন্যতম। ২০০৮ সালে হওয়া মিয়ানমারের এই ঘূর্নিঝড়ে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। এবং ৪ লাখ ঘরবাড়ি ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাম্প্রতিককালে হওয়া সিত্রাং ঘূর্ণিঝড়
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গেলে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। গত ২০ অক্টোবরে সংঘটিত হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নিহতের সংখ্যা ১০ জন। বাংলাদেশের দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মতে, ১৩ জেলায় ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা বেশি করা হচ্ছে। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে-সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল।
তবে সিত্রাং যেভাবে আঘাত হানবে বলে ভাবা হচ্ছিল তার চেয়ে প্রবলভাবে আঘাত হানে। শুরু থেকেই এর গতিপ্রকৃতি ছিল বেশ এলোমেলো। এছাড়াও বিশেষ ৩টি কারণ, যেমন-ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য এসবের জন্য ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বেশ প্রলয়ঙ্কারী রূপে আবির্ভূত হয়। সিত্রাং নামটি থাইল্যান্ডের দেওয়া। সিত্রাং শব্দের ভিয়েতনামি অর্থ ‘পাতা’।
এস্কেপের তালিকা অনুযায়ী সিত্রাং-এর পরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মন্দোস’। এই নামটি দিয়েছে সৌদি আরব। মন্দোস এর পরের ঘূর্ণিঝড়টির নাম ‘মোচা’। যা ইয়েমেনের দেওয়া একটি নাম।
উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্র অববাহিকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া দফতর (আরএসএমসি) এবং ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেমস (টিসিডব্লিউএস)-এর উপর। এবং বিশ্বজুড়ে ৬টি আরএসএমসি এবং ৫টি টিসিডব্লিউএস রয়েছে যারা এই কাজে সহযোগিতা করে থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রক্রিয়া
সিডর, আইলা, নার্গিস, ক্যাটরিনা ইত্যাদি নানা রকম আর ধরনের নাম শুনে মনে হতেই পারে ঘূর্ণিঝড়ের এসকল নাম কারা দিয়ে থাকে বা কেন দিয়ে থাকে? নামকরণের শুরুর দিকে অক্ষর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় চিহ্নিত করা হতো। তবে এক্ষত্রে দেখা গেল, ঝড়ের প্রকৃতি বোঝা বেশ কঠিন মনে হতো সাধারণ জনগণ, জেলে এমনকি নৌ-যানের পক্ষে। পরবর্তীতে, মেয়েদের নামে নামকরণ শুরু হলে, নারীদের প্রতিবাদের মুখে ১৯৭৮ সালে তা পরিবর্তন করে ছেলেদের নামেও ঝড়ের নামকরণ এর নিয়ম চালু হয়।
ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অরগানাইজেশন (World Meteorological Organisation-WMO) এবং ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিক-এর (United Nations Economic and Social Comission for Asia and the Pacific) সদস্য দেশগুলি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড।
সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়। পরবর্তীতে সংস্থার কর্মকর্তারা নামের একটি তালিকা করে, আসন্ন ঝড়ের নাম বাছাই করেন। তবে নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয় যেমন-নামটি আট অক্ষরের মধ্য হতে হবে, নিরপেক্ষ হতে হবে অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি, জাতি বা দেশের মানহানিকর কোনো নাম দেওয়া যাবে না, সহজবোধ্য এবং সহজেই উচ্চারণ করতে পারতে হবে। অবশ্য, ব্যবহৃত নাম পরবর্তীতে আর ব্যবহার করা যাবে না অন্য কোনো ঘূর্ণিঝড় নামকরণের ক্ষেত্রে।
অন্যান্য গ্রহে ঘূর্ণিঝড়
প্রশ্ন জাগতে পারে, ঘূর্ণিঝড় কি শুধু পৃথিবীতেই হয় নাকি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলোতেও হয়ে থাকে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। অন্যান্য গ্রহগুলোতেও ঘূর্ণিঝড়ের সংঘটিত হওয়ার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। নেপচুন গ্রহে ঘূর্ণিঝড়ের চোখের আকৃতির কালো অংশ দেখতে পাওয়া যায়, যা উইজার্ড’স আই বা ‘জাদুকরের চোখ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে মঙ্গলেও ঘূর্ণিঝড় দেখতে পাওয়া যায় যা, ‘মহা লাল বিন্দু’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Tropical Cyclones. 02. Types of cyclones.