বাইপোলার ডিজঅর্ডার বর্তমান সময়ের খুব চেনা একটা অসুস্থতা। মানসিক এই রোগটিকে সহজ ভাষায় বলা যায় না। মানসিক অবস্থা খুব দ্রুত বদলে যাওয়া, এই খুব বেশি ভালো লাগছে, আবার মন খারাপ, খুব দ্রুত মন এবং মানসিক অবস্থা বদলে যাবার যে অসুস্থতা সেটাই বাইপোলার ডিজঅর্ডার। বাই পোলার মানে কিন্তু দুই প্রান্ত। অর্থাৎ মানসিক অবস্থার দুই অবস্থার কথা বলে।
ধরুন, কোন একটা ট্রমার শিকার হলেন আপনি, এর ফলাফল হিসেবে কাজের প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন, আবার অন্যদিকে অতিরিক্ত কাজে আগ্রহী ও হতে পারেন। আপনার প্রাত্যহিক জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, কাজ কিংবা পড়াশোনা, ঘুম অথবা আহার সব ক্ষেত্রে এটা বিরূপ প্রভাব ফেলে।
এটি এমন একটি সমস্যা, যেটি মূলত একেবারে নির্মুল সম্ভব না। নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মেডিকেশন, মেডিটেশন এবং যেটা প্রয়োজন সেটা হল নিজের ইচ্ছা শক্তি।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার-এর কারণ:
যেকোন মানসিক অসুস্থতার পেছনে যে কারণ আছে তা কম বেশি একই।
১. সামাজিক-ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি।
২. শারীরিক নানা অসুস্থতা, যা দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
৩. কাছের কারো মৃত্যু বা দুর্ঘটনা।
৪. চিকিৎসা পরবর্তী অসুস্থতা।
৫. ঘুম কম হওয়া।
৬. কাজের বা পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ ইত্যাদি।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার-এর লক্ষণ:
খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রতিটি মানুষের জীবনে ছোট বড় এমন কিছু ঘটনা আছে, যা আমাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। ম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশন নামে দুট ভাগ আছে এই মানসিক অবস্থাটির। যেটা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকতে পারে, আবার দীর্ঘ সময়ের জন্যেও।
প্রথমেই আসি ম্যানিয়ার কথায়। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে যদি, ম্যানিয়াক ফেইজে থাকেন তখন যে লক্ষণ দেখা যায় সেটা নিয়েই কথা বলি
১. অতিরিক্ত খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা।
২. প্রয়োজনের চাইতে বেশি কথা বলা।
৩. অতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ করা।
৪. সব কাজের জন্য অতি উৎসাহী মনোভাব।
৫. অনিদ্রা।
৬. সহজেই মনোযোগ বিচ্যুত হওয়া।
৭. অসম্ভব বিষয় কল্পনা করা।
৮. অতিরিক্ত খরচ করা কিংবা চিন্তাভাবনা না করে কাজ করা।
এরকম আরো অনেক অস্বাভাবিক আচরণ হলো ম্যানিয়া বাইপোলার ডিজঅর্ডারের উদাহরণ। এরপর আসে ডিপ্রেশনের কথা। ম্যানিয়ার লক্ষনের ঠিক বিপরীত এই ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো।
১। সব সময় প্রচন্ড দুঃখবোধ অনুভব করা, আশাহত অনুভব করা
২। ইনসমোনিয়া
৩। নিজেকে নিজেই সন্দেহ করা
৪। ক্ষুধামন্দা
৫। আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় ঘোরা
৬। নিজেকে অযাচিত আর ছোট মনে করা
৭। অসম্ভব বিষয়ে কল্পনা করা
৮। প্রাত্যহিক কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
এইগুলো হল ডিপ্রেশন বাইপোলার ডিজঅর্ডারের উদাহরণ।
ম্যানিয়া আর ডিপ্রেশন এর যে চরিত্র সেটা একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বিপরীতমুখী। ঠিক এই কারনেই এই অসুস্থতার নাম ডিপ্রেশন বাইপোলার ডিজঅর্ডার। এই রোগাক্রান্ত রোগীর দুটো দিকই দেখা যায়। যে কোন সময় এক ফেজ থেকে অন্য ফেজে দ্রুত পরিবর্তিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এই দুটো বিষয় এক সাথেও কাজ করে। যেমন ধরুন আপনি কাজ করছেন ঠিকই, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। এই বিষয়টাকে cyclothymia বলা হয়ে থাকে।
কখন যাবেন ডাক্তারের কাছেঃ
আমাদের একটা সমস্যা হল, আমরা মানসিক যে কোন সমস্যা কে পাগল আখ্যা দিয়ে বসি। যেটার কারনে ম্যানিয়া বলুন আএ ডিপ্রেশন কিংবা উদ্বিগ্নতার হাল নিজেরা খুঁজে নিজেদের ক্ষতি করি। ম্যানিয়া কিংবা ডিপ্রেশন এর কোন একটা লক্ষ্মণ যদি দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করেন কিংবা বুঝতে পারেন আপনার ভেতরে চলছে অস্থিরতা শরণাপন্ন হন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর।
একেবারে নির্মুল সম্ভব না হলেও এই যে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন, সেটা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডারের চিকিৎসাঃ
মানসিক সমস্যা অনেক ধরনের যেমন হয়, এদের চিকিৎসাও তাই। মেডিকেশন, মেডিটেশন, ইয়োগা, কিছু প্রাকৃতিক টোটকা, দৈনন্দিন জীবনে কিছু পরিবর্তন বা সাইকোথেরাপি হল চেনা আর সবচাইতে কার্যকরী।
মেডিকেশনঃ
মেডিকেশন এর ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিটি মানুষের সমস্যা, অসুস্থতা আলাদা। এই কারনে চিকিৎসা এবং ওষুধেও আসবে তারতম্য। এন্টি ডিপ্রেশন, এন্টি এংজাইটি, মুড স্ট্যাবিলাইজার ওষুধগুলো সাধারণত ব্যবহার বেশি করা হয়ে থাকে।
আবার এর ডোজ এর কম বেশি ও নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপর।
চিকিৎসক এর পরামর্শ ব্যতিরেকে ওষুধ এর ডোজ বাড়ানো, কমানো, ওষুধ পরিবর্তন কিংবা বন্ধ করে দেয়া মানে নিজের ক্ষতি করা।
কিছু ওষুধ আছে শর্ট টার্ম সমস্যার জন্যে, কিছু লং টার্ম। ওষুধ সেবনের আগে সমস্ত কিছু বিবেচনা করতে হবে। কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসক এর পরামর্শ গ্রহণ প্রয়োজন।
সাইকোথেরাপিঃ
অভিজ্ঞ সাইকোথেরাপিস্ট এর সাহায্যে বেশ কিছু ধরনের থেরাপী রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে আছে Cognitive behavioral therapy (CBT)। এটা হল কথার থেরাপী। কথার মাধ্যমে অসুবিধার শুরুটা কোথায়, এই যে মূড সুইং এর প্যাটার্ণ কী, কখন এই এটাকগুলো হয়। আবার এই কথা বলার মাধম্যে আপনি আপনার ইমোশন কিংবা মানসিক অবস্থাগুলো কীভাবে নিজের বশে আনা যায়, সেটাও বুঝতে পারবেন।
সাইকো এডুকেশনঃ
এছাড়া আছে সাইকো এডুকেশন কাজ করে এই অসুস্থতার হার কমাতে। এই জ্ঞান যেমন আপনার নিজেকে সাহায্য করবে বাইপোলার ডিজঅর্ডার কী বুঝতে এবং রোগীর অবস্থা বুঝতে, সে হতে পারেন আপনি কিংবা অন্য কেউ। প্রাথমক পর্যায়ে ধরা পড়া মাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
অন্যান্যঃ
উপরের উল্লেখিত চিকিৎসা ছাড়াও যা যা ব্যবস্থা গ্রহন করা যায়, খাবারের প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্টস , ঘুমের ওষুধ, আকুপাংচার। নিজেকে অন্যকাজে ব্যস্ত রাখাম নিজের পছন্দের আর প্রিয় কাজগুলো করাও অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের অসুস্থতার বারংবার আক্রমণ হ্রাস করে।
এছাড়াও প্রতিদিন কিছু ব্যায়াম, ইয়োগা বা জগিং কিংবা সকালে বা সন্ধ্যায় কিছুটা হাটাহাটি করা, সাঁতার কাটা, বাগান করা এই সব কাজ মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
মানসিক অবস্থা কিন্তু আসলেই কারো শতভাগ ভাল থাকে না। আমাদের জীবনে নানা ছোটবড় সমস্যা আছে। হুট করে শুরু হয়ে যেতে পারে।অনেকে এটা কে অবহেলা করে। কিন্তু এটা আসলে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা। যে কোন মানসিক কিংবা শারীরিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেইয়া উচিত। কোন ভিন্নতা চোখে পড়লে সাথে সাথেই প্রয়জনীয় ব্যবস্থা নিলে সেটা ক্রোনিক কোন সমস্যা হওয়া থেকে রক্ষা করে আমাদের।
শুধু নিজের সমসা না, আশেপাশের কারো সমস্যা হলেই সচেতন হতে হবে। এতে করে মানসিক সমস্যার হার কিছুটা হলেও হ্রাস করা যেতে পারে।
Sources:
- https://www.psychiatry.org/patients-families/bipolar-disorders/what-are-bipolar-disorders
- https://www.healthline.com/health/bipolar-disorder
- https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/bipolar-disorder/symptoms-causes/syc-20355955#:~:text=Bipolar%20disorder%2C%20formerly%20called%20manic,or%20pleasure%20in%20most%20activities
- https://www.nhs.uk/mental-health/conditions/bipolar-disorder/symptoms/
- https://www.nhs.uk/mental-health/conditions/bipolar-disorder/causes/#:~:text=A%20stressful%20circumstance%20or%20situation,physical%2C%20sexual%20or%20emotional%20abuse
Image sources: Pixabay